বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

স্বাস্থ্য

ডায়াবেটিস ও খাওয়াদাওয়া

| প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

পৃথিবীতে বর্তমানে সবচেয়ে উচ্চহারে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনে। বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশে খুব দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে, মানুষের দৈহিক ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে আনুপাতিক ও কাক্সিক্ষত হারের চেয়ে বেশি হারে, মানুষের দৈহিক শ্রম দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে মানসিক চাপ বেড়েছে অনেকগুণ। তবে উন্নত দেশগুলোতে ডায়াবেটিস রোগীর হার কমলেও সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বা একই রকম আছে।
আজকের ব্যস্ত জীবনে খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম হওয়াটা খুবই সাধারণ ব্যাপার বেশিরভাগ মানুষের কাছে। আর এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে জাঙ্ক ফুড খাওয়ার প্রবণতা। অনেকেই আছেন যারা সকালে কিছু না খেয়ে বেরিয়ে পড়েন। সারাদিন জাঙ্ক ফুড দিয়েই প্রায় লাঞ্চ সারেন। এর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গ দিচ্ছে সেডেন্টারি লাইফস্টাইল। এক্সারসাইজের অভাব, ঘুমের ব্যাঘাত, স্ট্রেস, টেনশন ও খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম ডায়াবেটিসের গুরুত্বপূর্ণ কারণ। আসলে ভারতীয়দের আপেলের মতো গড়ন অর্থাৎ স্ফীত মধ্যপ্রদেশ। বলাই বাহুল্য, অনিয়মিত জীবনযাপনের জন্য ওজন বাড়ছে দ্রুত হারে। আর তাই নানা লাইফস্টাইল ডিজিজের মতো ডায়াবেটিসও জাঁকিয়ে বসছে। তাই ওজন ঠিক রাখার পাশাপাশি ভুঁড়ি বাড়তে না দেয়াই হল ডায়াবেটিসকে দূরে রাখার উপায়। আর তাই তো প্রয়োজন লো ফ্যাট, হাই নিউট্রিয়েন্টস ও মডারেট ক্যালোরিযুক্ত খাবার খাওয়া ও মন ভাল রাখা। ব্লাড সুগারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে খাওয়াদাওয়ার জরুরি ভূমিকা রয়েছে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, সব ভাল খাবার থেকে সবসময় দূরে থাকতে হবে। সঠিক ডায়েট প্ল্যান করলে ডায়াবেটিসের রোগী এক আধদিন রসগোল্লা খেলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না; তবে যেটা দরকার, তা হলো- পরিমিতিবোধ, সময়ানুবর্তিতা এবং নিয়মানুবর্তিতা।
ডায়েটে কি রাখবেন
প্রথমেই আসি কার্বোহাইড্রেটের প্রসঙ্গে। রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট যেমন- ময়দা, মিহি পলিশড্ চাল, সাদা পাউরুটি ইত্যাদি রোজকার ডায়েট থেকে বাদ দিন। পরিবর্তে বেশি ফাইবার যুক্ত কার্বোহাইড্রেট যেমন- ভুষিযুক্ত আটার রুটি, ঢেঁকি ছাটা চাল বা ব্রাউন রাইচ, কর্নফ্লেক্সের পরিবর্তে ব্র্যানফ্লেক্স।
চিনিযুক্ত ব্রেকফাস্ট সিরিয়ালের পরিবর্তে হাই ফাইবার ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল, ইনস্ট্যান্ট ওটমিলের বদলে রোলড ওটস বা স্টিল কাট ওটস বেছে নিন।
এখানে আরও একটি কথা বলা জরুরি। ব্রাউন ব্রেড বা ব্রাউন রাইচের ক্ষেত্রে দেখে নেবেন সত্যিই খাঁটি জিনিসটি কিনছেন কিনা। তা না হলে কোনও লাভ নেই।
আলু ভাজা যতই ভালবাসুন না কেন, চলবে না। বরং রাঙা আলু, স্কোয়াশ, ফুলকপি খেলেই ভাল। আসলে যুক্তিটা খুব সহজ। একবার বুঝে গেলে দেখবেন নিজেই সুন্দর মেনে চলতে পারছেন। রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আর হাই ফাইবার কার্বোহাইড্রেট যেহেতু অনেকটা সময় নিয়ে হজম হয়, তাই শরীর অতিরিক্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না।
মিষ্টি খেতে যারা ভালবাসেন তাদের তো সমস্যা বটেই, যারা মিষ্টি ভালবাসেন না, তাদেরও ডায়াবেটিস হলে মিষ্টির প্রতি আকাঙ্খা বাড়ে। যেখানেই বাধা, সেখানেই আকর্ষণ প্রবল। তবে, ডায়াবেটিস হলে যে, মিষ্টি একেবারে বাদ, তা কিন্তু নয়। মাঝেমধ্যে একটা ছোট সন্দেশ বা রস চিপে রসগোল্লা, দু’এক চামচ পুডিং, কাস্টার্ড বা আইসক্রিম খাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু টোটাল ক্যালরি ইনটেক খেয়াল রাখতে হবে। আর যেদিন মিষ্টি খাবেন, মিনিট পনেরো বেশি হাঁটবেন। একটু হিসেবনিকেশ করে চলা আর কি।
ফ্যাট বা তেল জাতীয় খাবার খেতে হবে বুঝে শুনে। কিছু ফ্যাট না খেলেও সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা সম্ভব নয়। স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্র্যান্স ফ্যাট ডায়াবেটিকদের জন্য তো বটেই কারওর জন্যই ভাল নয়। এদের মধ্যে আছে বনস্পতি, দ লিকুইড ভেজিটেবল অয়েল, হোল মিল্ক, রেড মিট ইত্যাদি। এগুলো যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। এতে ওজনও বাড়ে দ্রুত। আবার নানা শারীরিক সমস্যার জন্যও এ ধরনের খাবার দায়ী। অন্যদিকে রয়েছে অলিভ অয়েল, ক্যানোলা অয়েল, ফ্ল্যাক্স সিড, বাদাম, অ্যাভোকাডো, স্কিমড মিল্ক, দই ইত্যাদি। এগুলো খেতেই পারেন।
উচ্চমাত্রায় ফাইবার যুক্ত সবজি যেমন বিন, ব্রকোলি, কড়াইশুটি, পাতাওলা সবজি ইত্যাদি রাখুন ডায়েটে। ডালজাতীয় খাবারও রাখতে পারেন। এগুলোর প্রতিটিই ডায়াবেটিকদের জন্য ভাল। উচ্চ ফাইবারযুক্ত ফল যেমন- পেঁপে, কমলালেবু, আপেল, নাসপাতি, পেয়ারা ইত্যাদি খান। কলা, আম বা আঙুরের মতো ফলে ক্যালরি বেশি থাকে। তাই এই ফলগুলো পরিমিত পরিমাণে খাবেন। একজন ডায়াবেটিকের ক্ষেত্রে বেশিমাত্রায় ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া জরুরি। ডায়েটে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম আর পর্যাপ্ত প্রোটিন থাকতে হবে। অ্যালকোহল এড়িয়ে চলাই ভাল। সারাদিনে ছোট ছোট মিল-এ ভাগ করে খাবার খান। একবারে বেশি খাওয়ার প্রবণতা মোটেও ভাল নয়।
এছাড়া ব্রেন ও হার্টকে সুরক্ষিত রাখতে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিডের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। পুনা মাছ, স্যামন মাছসহ যে কোনও সামুদ্রিক মাছ, ফ্ল্যাক্স সিড ইত্যাদিতে পাওয়া যায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড। তাই রোজকার খাবারে এদের মধ্যে যে  কোন একটি থাকলে ভাল হয়।
অতিরিক্ত ওজন অনেক সময় ডায়াবেটিসের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। তাই ওজন স্বাবাবিক রাখতে হবে। মাত্র সাত শতাংশ ওজন কমাতে পারলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে অর্ধেক হয়ে যায়। তবে ওজন কমাতে হবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে। অনেকেই ওজন কমাতে গিয়ে ব্রেকফাস্ট বা লাঞ্চ স্কিপ করেন। এরকম করা একেবারেই ঠিক নয়। দিনের শুরুতে পুষ্টিকর জলখাবার খাওয়া দরকার। ওটস বা মাল্টিগ্রেন আটার রুটি, নানরকম সবজি, এক কাপ স্কিমড মিল্ক বা ডিমের সাদা অংশ খেলে ভাল হয়। নিয়মিত হেভি ব্রেকফাস্ট স্টেডি ব্লাড সুগার লেভেল ধরে রাখার সঙ্গে সঙ্গে অফুরন্ত এনার্জি জোগাবে। ব্রেকফাস্ট ছাড়া অন্য কোন মিল বেশি করে খাওয়া উচিত নয়। দিনে ছ’টা ছোট ছোট মিল খেলে সুগার লেভেল স্বাভাবিক থাকবে। বিশেষত রাতে কখনই একগাদা খাবার খাবেন না। নিয়মিত সমান মাপের ক্যালরি গ্রহণ করা উচিত। কোন দিন বেশি খাওয়া হয়ে গেলে পরের দু’ একদিন কম ক্যালরির খাবার খেতে চেষ্টা করুন, এক্সারসাইজ করতে ভুলবেন না।
এক্সারসাইজের ভূমিকা
ডায়াবেটিসের নিরাময়ে খাওয়াদাওয়ার ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই এক্সারসাইজেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। ডায়াবেটিসের অন্যতম রিস্ক ফ্যাক্টও হল ওবিসিটি। তাই ওজন কমাতে ও ইনসুলিন লেভেল স্বাভাবিক রাখতে নিয়মিত ৩০ মিনিট দ্রুত পায়ে হাঁটা উচিত। ভুঁড়ি কমানোর এক্সারসাইজ করা দরকার। স্ট্রেচিং করুন। হাঁটা ছাড়াও সাঁতার বা ওয়াটার অ্যারোবিকস ট্রাই করতে পারেন। সেন্ট্রাল ওবিসিটি ডায়াবেটিসের অন্যতম বড় বন্ধু। একটার সঙ্গে আর একটার নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। ভুঁড়ি কমাতে এজন্য সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন ৩০ মিনিট মর্নিং বা ইভনিং ওয়াক করতেই হবে। তাহলেই দেখবেন রক্তে চিনির মাত্রার বাড়বাড়ন্ত নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
ষ ডা. শাহজাদা সেলিম
সহকারী অধ্যাপক, হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
মোবাইল নং ০১৯১৯০০০০২২
ংবষরসংযধযলধফধ@মসধরষ.পড়স
কর্মফোর্ট  ডক্টর’স চেম্বার, ১৬৫-১৬৬, গ্রীন রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা
ফোন :  ৯১৩৫৯৪৭-৮, ০১৭৩১ ৯৫৬০৩৩

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন