শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

অচল বন্দরমুখী সড়ক

প্রধান সমুদ্র বন্দরের সক্ষমতার সুফল নিয়ে সংশয় রাস্তাজুড়ে অঘোষিত টার্মিনাল : বেসরকারি ডিপোতে পণ্যবাহী যানবাহনের চাপ ব্যাহত আমদানি-রফতানি কার্যক্রম

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ৮ আগস্ট, ২০২২, ১২:১৩ এএম

চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ছে। পণ্য ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি যোগ হয়েছে। সম্প্রসারিত হয়েছে টার্মিনাল, ইয়ার্ড। তবে সে তুলনায় ব্যাকআপ সুবিধা বাড়েনি। বন্দর এলাকায় নেই ভারী যানবাহনের কোন টার্মিনাল। রাস্তায় রাখা হচ্ছে সারি সারি ট্রাক, কার্ভাডভ্যান, লরি। এতে বন্দরমুখী সবকয়টি সড়কেই স্থায়ী যানজটে অচলদশা। অপর্যাপ্ত বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী যানবাহনের চাপ বেড়েই চলেছে। ডিপোর সামনের সড়কেই পার্কিং করা হচ্ছে শত শত যানবাহন। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে যোগাযোগ ব্যবস্থায় এমন বিশৃঙ্খলায় বিঘ্নিত হচ্ছে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। এতে বন্দরের সক্ষমতার সুফল নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।

বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতায় এমন বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বন্দরের অভ্যন্তরে দ্রুত মালামাল খালাস এবং জাহাজিকরণ হচ্ছে। কিন্তু বন্দরকে ঘিরে সবকয়টি সড়কে জটের কারণে আমদানি কাঁচামাল যথাসময়ে কারখানায় পৌঁছানো যাচ্ছে না। আবার রফতানি পণ্যও জাহাজিকরণ বিঘ্নিত হচ্ছে। রফতানি পণ্যবাহী কনটেইনার ছাড়াই বিদেশি জাহাজের বন্দর ত্যাগ করার ঘটনাও ঘটছে।

বন্দরের সক্ষমতার সাথে তাল মিলিয়ে পর্যাপ্ত বেসরকারি ডিপো, টার্মিনাল নির্মাণ এবং বন্দরমুখী সড়ক যোগাযোগ মসৃণ করা না গেলে সার্বিক আমদানি-রফতানি কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়বে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে। অব্যবস্থাপনায় অতিষ্ঠ আমাদনিকারকরদের কেউ কেউ বিকল্প হিসেবে মোংলা বন্দরের দিকে ঝুঁকছে বলেও জানান অনেকে। বিশেষ করে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে তার সুফল নিতে অনেকে মোংলা বন্দরকে বেছে নিচ্ছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে কিছুটা হলেও চট্টগ্রাম বন্দর তথা চট্টগ্রাম গুরুত্ব হারাতে পারে।

দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের সিংহভাগ সামাল দিচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানির চাপ সামাল দিতে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। বন্দরসীমা সাত গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত এক দশকে পাঁচ লাখ ৮০ হাজার বর্গমিটার ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। নিউমুরিং এলাকায় ওভারফ্লো কনটেইনার ইয়ার্ড, সদরঘাট এলাকায় ৭৫ মিটার লাইটারেজ জেটি নির্মাণ করা হয়েছে। কনটেইনার ধারণক্ষমতা এখন ৫৫ হাজারে উন্নীত হয়েছে। ১২শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ে চার লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতাসম্পন্ন পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে।

কয়েক বছরে শীপ-টু-শোর কী গ্যান্ট্রি ক্রেন, মোবাইল হারবার ক্রেন এবং রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ বিভিন্ন ধরনের ৩৯০টি কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে। এর ফলে বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থানকাল কমে এসেছে।

এক থেকে দুই দিনের মধ্যে জাহাজ জেটিতে ভিড়ছে। ক্ষেত্রবিশেষে অন-এ্যারাইবল বার্থিং প্রদান করা হচ্ছে। বন্দর থেকে সরাসরি ইউরোপে রফতানি পরিবহন শুরু হয়েছে। গেল অর্থ বছরে ৩২ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের মাইলফলক অতিক্রম করেছে বন্দর। একই সময়ে প্রায় ১২ কোটি মেট্রিক টন খোলাপণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে। বে-টার্মিনাল এবং মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বন্দরের সক্ষমতা তিন থেকে চার গুণ বেড়ে যাবে।

বন্দরের পরিধি এবং সক্ষমতা বাড়লেও বন্দর সহায়ক আমদানি-রফতানির জন্য জরুরি অন্যান্য সুবিধাদি বাড়েনি। বন্দরে প্রতিদিন গড়ে আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী চার থেকে পাঁচ হাজার ভারী যানবাহন চলাচল করে। কিন্তু বন্দর এলাকায় স্থায়ী কোন টার্মিনাল নেই। বন্দর নীমতলায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা ট্রাক টার্মিনালে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা। টার্মিনালের গাড়ির বহর মূল সড়ক পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে। বন্দরের সাথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সংযোগ সৃষ্টিকারী তিনটি সড়কের অবস্থাই এখন বেহাল। ৮০’র দশকে চালু হয় পোর্ট কানেকটিং রোড। সম্প্রতি সড়কটি চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। এখন সড়কেই শত শত ভারী যানবাহন পার্কিং করে রাখা হচ্ছে।

বিগত ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তৎকালীন যোগাযোগ উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিনের উদ্যোগে চালু হয় বন্দর টোল রোড। কাস্টম ব্রিজ থেকে শুরু হয়ে এ রোডটি ফৌজদারহাটে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যুক্ত হয়েছে। পরবর্তিতে বন্দর থেকে ওই রোডের সাথে এক কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ফ্লাইওভারও যুক্ত হয়েছে। দীর্ঘ দেড় দশকেও রোডটি সম্প্রসারণ করা হয়নি। অব্যবস্থাপনায় ওই সড়কটিও এখন অবৈধ টার্মিনালে পরিণত হয়েছে।

ফিডার রোড ছাড়াই ২০২০ সালে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে সিটি আউটার রিং রোড। সে সড়কেও অবৈধ পার্কিং। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য বিগত চার বছর ধরে নগরীর প্রধান সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতিতে বন্দরকে ঘিরে বারিক বিল্ডিং থেকে কাস্টম হাউস, সল্টগোলা, ইপিজেড হয়ে সিমেন্ট ক্রসিং পর্যন্ত এখন বেহাল সড়কে রাতে-দিনে যানজট লেগেই আছে।

আমদানি-রফতানি কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বন্দরের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত বেসরকারি ডিপো। ২০১৬ সালের পর নতুন কোন ডিপো চালু হয়নি। ২১টি ডিপোর মধ্যে এখন সচল রয়েছে ১৭টি। আমদানি-রফতানি বেড়ে যাওয়ায় পণ্যবাহী যানবাহন সামাল দিতে ডিপোগুলোতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। গত ৪ জুন ভয়াবহ আগুন-বিস্ফোরণে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তার চাপ পড়েছে অন্যান্য ডিপোতে। কনটেইনার পণ্য রফতানির ৯৮ শতাংশ পরিবহন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। রফতানি পণ্যের ৯০ শতাংশ বেসরকারি ডিপোতে কনটেইনার বোঝাই করে জাহাজে তোলা হয়। বাকি ১০ শতাংশ ঢাকার কমলাপুর ডিপো এবং ইপিজেড থেকে কনটেইনার বোঝাই করে সরাসরি বন্দরে পাঠানো হয়।

বন্দর-পতেঙ্গা এলাকার ডিপোতে পণ্যবাহী যানবাহনের জট এখন স্থায়ী রূপ নিয়েছে। টোল রোড, বিমানবন্দর সড়ক, কাটগড় সড়ক ও আশপাশের এলাকায় সবকয়টি ডিপোর সামনে শত শত যানবাহন রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে। জটের কারণে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা পণ্যবাহী যানবাহন দিনের পর দিন ডিপোর সামনে অপেক্ষা করছে। এতে পরিবহন ভাড়া কয়েকগুণ বেড়ে গিয়ে আমদানি-রফতানি ব্যয়ও বাড়ছে। বন্দরকে ঘিরে এমন বেহাল অবস্থায় বন্দরের সক্ষমতার সুফল নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়ন ও গবেষণা পরিষদের সভাপতি ও বন্দরের সাবেক সদস্য কমোডোর (অব.) জোবায়ের আহমদ বলেন, বন্দরের সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা এবং দক্ষতা বাড়ানো না হলে সুফল মিলবে না। বন্দরের উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে হলে বন্দর ব্যবহারকারী সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে অবশ্যই সমন্বয় থাকতে হবে। কারণ সবাই একে অপরের পরিপূরক। আইএসপিএস কোড অনুযায়ী বন্দরের পাশপাশি বন্দর সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্ষম করে তুলতে হবে।

বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ প্রফেসর জেরিনা হোসেন বলেন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন এবং অব্যবস্থাপনার কারণে বন্দরমুখী সব সড়কে এখন অচলাবস্থা। এতে আমদানি-রফতানি ও অর্থনীতি গতিশীল হওয়া তো দূরের কথা, নগরীই অচল হয়ে পড়েছে। সড়ক দখল করে অবৈধ পার্কিং আধুনিক শহরে কল্পনাও করা যায় না। অথচ দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর এলাকায় তা হচ্ছে। এর পেছনে নিশ্চয় কোন সুবিধাভোগী রয়েছে। তাদের চিহ্নিত করতে হবে। অবৈধ টার্মিনাল সরিয়ে সড়কে অবশ্যই শৃঙ্খলা আনতে হবে। বন্দরমুখী সব সড়ক সার্বক্ষণিক সচল রাখতে হবে।
নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-পশ্চিম) তারেক আহম্মদ বলেন, পর্যাপ্ত টার্মিনাল না থাকায় এবং বেসরকারি ডিপোগুলোতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় সড়কের উপর পার্কিং করা হচ্ছে। ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযানেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। টার্মিনাল নির্মাণ ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, শুধু বন্দরের সক্ষমতা বাড়ালে হবে না এর পাশাপাশি আমদানি-রফতানি সংশ্লিষ্ট ব্যাকআপ সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে হবে। বন্দর এলাকায় অবশ্যই ভারী যানবাহনের জন্য টার্মিনাল রাখতে হবে। পর্যাপ্ত সংখ্যক বেসরকারি ডিপো বিশেষ করে রফতানিমুখী পণ্যের জন্য আলাদা ডিপো (কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন) নির্মাণ করতে হবে। দেশের সড়ক-মহাসড়ক পণ্য পরিবহনের জন্য মসৃণ করা না গেলে বন্দরের সক্ষমতার সুফল পাওয়া যাবে না।

বেসরকারি ডিপো মালিকদের সংগঠন বিকডার সেক্রেটারি রুহুল আমিন সিকদার বলেন, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ডিপোগুলোর কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। আমদানি-রফতানি বেড়ে যাওয়ায় ডিপোতে পণ্যের চাপ বাড়ছে। খুব শিগগির নতুন দুটি ডিপো চালু হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, বন্দর এলাকায় আপাতত পণ্যবাহী যানবাহনের জন্য টার্মিনাল নির্মাণের কোন সুযোগ নেই। তবে বে-টার্মিনালে পাঁচ হাজার ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ধারণক্ষমতার একটি টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। বেসরকারি কনটেইনার ডিপো নির্মাণেও বন্দরের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা দেয়া হবে বলে জানান তিনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন