শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

কেন এত বিতর্কিত সালমান রুশদি ও তার ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’?

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৩ আগস্ট, ২০২২, ৬:২৮ পিএম | আপডেট : ৯:৪৫ পিএম, ১৩ আগস্ট, ২০২২

বুকার জয়ী সাহিত্যিক সালমান রুশদি যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ এক হামলার শিকার হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তাকে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়েছে এবং তিনি কথা বলতে পারছেন না। রুশদি একটি চোখও হারাতে পারেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এ পর্যন্ত ২০টি দেশে নিষিদ্ধ হয়েছে তার ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’। সবার আগে বইটি নিষিদ্ধ করে রুশদির জন্মভূমি ভারত।

গত ৩৩ বছর ধরে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে পালিয়ে বেরিয়েছেন সালমান রুশদি। নিজের জন্মভূমি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন, নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। শুক্রবারের হামলার পর থেকে এখন পর্যন্ত তার শারীরিক অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত সালমান রুশদির চতুর্থ উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ বিশ্বজুড়ে বিতর্কের জন্ম ‍দেয়। বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তার এক বছর পর ১৯৮৯ সালে ইরানের তৎকালীন শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি রুশদির মাথার দাম ঘোষণা করেন ৩০ লাখ ডলার। ঘোষণায় তিনি বলেন, রুশদিকে হত্যা করতে গিয়ে কেউ নিহত হলে সে শহীদের মর্যাদা পাবে এবং জান্নাতে যাবে। এই ফতোয়া দেওয়ার চার মাসের মাথায় মারা যান খোমেনি। তবে তার সেই ঘোষণা এখনও বহাল আছে।

খোমেনির মৃতুর পর এ বিষয়ে আর এগোয়নি ইরান, কিন্তু ২০২১ সালে দেশটির সরকার সমর্থিত একটি ধর্মীয় ফাউন্ডেশন পুরস্কারের অংকের সঙ্গে আরও ৫ লাখ ডলার যুক্ত করে। তার বই ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ প্রথম নিষিদ্ধ হয়েছিল তার নিজের দেশ ভারতে। ফলে, মাতৃভূমি থেকে কোনো প্রকার সহযোগিতা-সমর্থনের আশা ছিল না। তাই খোমেনি মাথার দাম ঘোষণার পর থেকে প্রাণ বাঁচাতে ফেরারি জীবন শুরু হয় সালমান রুশদির। যুক্তরাজ্য তাকে আশ্রয় দিতে সম্মত হয়, তবে সরকারের তরফ থেকে শর্ত দেওয়া হয়— নাম পরিচয় গোপন করে থাকতে হবে। উপয়ান্তর না থাকায় সে শর্ত মেনে নিয়ে ‘জোসেফ অ্যান্টন’ ছদ্মনামে প্রায় ১৩ বছর ব্রিটেনে ছিলেন তিনি।

১৩ বছরে নিরাপত্তার প্রয়োজনে বেশ কয়েকবার ঠিকানা বদলাতে হয়েছে তাকে। তার এই নির্বাসিত জীবনকে আরও দুঃসহ করে তোলে তার সে সময়ের স্ত্রী মার্কিন ঔপন্যাসিক ম্যারিয়েন উইগিংসের সঙ্গে বিচ্ছেদ। ১৯৯৩ সালে বিচ্ছেদ হয় তাদের। এ প্রসঙ্গে নিজের ডারয়েরিতে তিনি লেখেন, ‘এখানে আমি বন্দির চেয়েও বন্দি। কথা বলার মতো একটা মানুষও এখানে নেই।’ ‘পরিবারকে সময় দেওয়া, আমার ছেলের সঙ্গে ফুটবল খেলা, আর দশজনের মতো সাদাসিধে জীবন কাটানো— এটাই এখন আমার একমাত্র স্বপ্ন এবং বর্তমান মুহূর্তে মনে হচ্ছে এটি একটি অসম্ভব স্বপ্ন।’

১৯৮৮ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থা ভাইকিং পেঙ্গুইন প্রকাশ করে রুশদির চতুর্থ উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’, যেটির জন্য বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের রোষের শিকার হন তিনি। উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট ছিল ইসলামপূর্ব আরব সমাজ এবং ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মহানবী (সা.)। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবে পূজিত তিন দেবী আল্-লাত (আলিলাত), আল্-উজ্জা (আলিজা) ও মানাহ এবং শয়তানকে উপন্যাসটির চরিত্র হিসেবে হাজির করেছিলেন তিনি।

উপন্যাসটির কাহিনী খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, ইসলামের প্রচারের সময় তৎকালীন আরবের পৌত্তলিক ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হন মহানবী (সা.)। সে সময় শয়তান তাকে প্রস্তাব দেয়, মহানবী সা. যদি আরবের পূজিত তিন দেবীকে তার হাতে তুলে দেন, সেক্ষেত্রে আরবে একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। মহানবী (সা.) সেই প্রস্তাব মেনে ওই তিন দেবীকে শয়তানের হাতে তুলে দেন। জাদু বাস্তবতা (ম্যাজিক রিয়েলিজম) ঘরানায় লেখা এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগে বিক্ষোভ শুরু হয় তার বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে দেশে দেশে নিষিদ্ধ হতে থাকে বইটি।

১৯৮৮ সালে বইটি প্রকাশের পর ভারতের মুসলিমরা বিক্ষোভ শুরু করলে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধী বইটি সে দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। পরের বছর, ১৯৮৯ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের উত্তরাঞ্চলীয় শহর ব্র্যাডফোর্ডে বিক্ষোভ মিছিল শেষে একদল মুসলিম প্রকাশ্যে বইটির বেশ কিছু কপি পোড়ায়। তার পরের মাসে রুশদির ফাঁসির দাবিতে ইসলামাবাদে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য কেন্দ্রে হামলা চালায় হাজারেরও বেশি পাকিস্তানি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গুলি ছুড়তে হয়েছিল পুলিশকে এবং তাতে নিহত হয়েছিলেন ৫ জন।

তার মধ্যেই খোমেনির ফতোয়া পশ্চিমা বিশ্বে উস্কে দেয় ভীতি। এই ভীতির কারণে ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক ২ বছরের জন্য বিচ্ছিন্ন ছিল। মুসলিমদের শান্ত করতে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনে ১৯৯০ সালে ‘সরল বিশ্বাসে’ (ইন গুড ফেইথ) নামে একটি নিবন্ধ লেখেন রুশদি। সেখানে তিনি বলেন, তার এই উপন্যাসের প্রধান এবং একমাত্র উদ্দেশ্য সাহিত্যসৃষ্টি। কাউকে আঘাত করার অভিপ্রায় নিয়ে তিনি এটি লেখেননি। কিন্তু তার এই আত্মপক্ষ সমর্থন কট্টরপন্থী মুসলিমদের শান্ত করতে পারেনি।

যুক্তরাজ্যে দুই বছরেরও বেশি সময় ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ থাকার পর ১৯৯১ সাল থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ করেন তিনি। কিন্তু উপন্যাসটি যিনি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন, তিনি ওই বছরই আততায়ী হামলায় নিহত হন। জাপানি অনুবাদক নিহত হওয়ার কয়েকদিন পর ছুরি হামলায় নিহত হন উপন্যাসটির ইতালীয় অনুবাদক। আর নরওয়েতে যে প্রকাশক বইটি প্রকাশ করেছিলেন তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব হত্যার পেছনে ইরানের ইন্ধন ছিল কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়। তুরস্কের লেখক আজিজ নেসিন তুর্কি ভাষায় বইটির অনুবাদ করছিলেন- এই অভিযোগে ১৯৯৩ সালে তুরস্কের মধ্যাঞ্চলীয় শহর সিভাসের একটি হোটেল জ্বালিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ মুসলিমরা। সেসময় হোটেলটিতে ছিলেন আজিজ।

তবে সৌভাগ্যক্রমে আজিজ নেসিন অগ্নিদগ্ধ হওয়া থেকে বেঁচে গেলেও হোটেলটিতে আগুনে পুড়ে মরেছিলেন ৩৭ জন মানুষ। ১৯৯৮ সালে ইরানের সংস্কারপন্থি প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি অবশ্য ব্রিটেনকে আশ্বাস দেন, রুশদির ওপর জারি করা ফতোয়া কার্যকর করা হবে না। তবে খোমেনির উত্তরাধিকারী আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ২০০৫ সালে ঘোষণা দেন, রুশদি একজন ধর্মত্যাগী এবং তাকে হত্যা করা ইসলাম কর্তৃক অনুমোদিত। এদিকে সম্ভাব্য হামলা থেকে বাঁচতে বছরের পর বছর ধরে নিজেকে লুকিয়ে রাখা রুশদি যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে সামাজিক জীবনযাপন শুরু করেছিলেন। বিভিন্ন সাহিত্য অনুষ্ঠানেও নিয়মিত যেতেন তিনি। পশ্চিমের অনেকে তাকে বলত ‘ফ্রি স্পিচ হিরো’। তার পরিচিতরা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর ধরে নিরাপত্তা নিয়ে তেমন উদ্বেগ দেখা যায়নি তার মধ্যে। সবকিছু যখন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে আসছিল, তখনই শুক্রবার অপ্রত্যাশিতভাবে এ হামলার ঘটনা ঘটলো।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন