মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪৩০, ০৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

তেজ কমেছে ডলারের

# ব্যাংকগুলোর দ্রুত রফতানি আয় নগদায়নের নির্দেশ # কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারি আমদানিতে শুধু ডলার জোগাচ্ছে ##শিগগিরই ডলারের বাজারে স্বস্তি ফিরবে- সিরাজুল ইসলাম

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৫ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

খোলাবাজারে কদিন আগেও ডলার বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকায়, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া কিছু পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাজারে। এই ধারাবাহিকতায় ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে এবার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলার কেনাবেচায় দামের ব্যবধান (স্প্রেড) সর্বোচ্চ কত হতে পারবে, তা বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যে দরে ডলার কেনা হবে, বিক্রির দাম হবে তার চেয়ে সর্বোচ্চ ১ টাকা বেশি। ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে গতকাল ব্যাংক প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সঙ্গে বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নেয়। বৈঠকে চলমান সঙ্কট নিরসনে ব্যাংক প্রধানদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি এ দিক নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালের সভাপতিত্বে এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন, বাফেদা চেয়ারম্যান এবং সোনালী ব্যাংকের এমডি ও সিইও মো. আতাউর রহমান প্রধানসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। সভাশেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, ব্যাংকগুলো যে দরে ডলার কিনবে, তার সঙ্গে বিক্রয় মূল্যের একটি সিলিং করতে হবে। সব ব্যাংক এটি ফলো করবে বলে তারা জানিয়েছেন। তবে বৈঠকে উপস্থিত একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, আলোচনা হয়েছে ডলার কেনা ও বেচার ওই ব্যবধান এক টাকার বেশি হবে না। এছাড়া ব্যাংকগুলোকে রফতানি আয়ের দ্রুত নগদ আদায়ের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কি দামে ডলার বেচাকেনা করছে, তার রিপোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংকে দেয়ার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে চলার কথা জানান ব্যাংকাররা।
খোলাবাজারে গতকাল ডলারের দাম পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বর্তমানে কার্ব মার্কেটে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১২-১১৪ টাকায়। যদিও আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে গত সোমবার থেকে এক ডলারের জন্য খরচ করতে হচ্ছে ৯৫ টাকা। অবশ্য ব্যাংকগুলো এর থেকে অনেক বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। অনেক ব্যাংক পণ্য আমদানি ও রেমিট্যান্স সংগ্রহের ক্ষেত্রে অসুস্থ প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক রোববার ১০৪ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। জনতা ব্যাংক থেকে কিনতে লেগেছে ১০৪ টাকা ২৫ পয়সা। বেসরকারি সিটি ব্যাংক প্রতি ডলারের জন্য নিয়েছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। ইস্টার্ন ব্যাংক বিক্রি করেছে ১০৭ টাকায়। এসআইবিএল নিয়েছে ১০৫ টাকা। এদিকে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলা ডলারের দৌড় থামাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১ মাস ১১ দিনে (১ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট) ১৭২ কোটি ৫৪ লাখ (১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করা হয়েছে। তবে এর প্রায় পুরোটাই জ্বালানি তেল, সারসহ সরকারের অতিপ্রয়োজনীয় আমদানি খরচ মেটাতে। ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের পণ্য আমদানির এলসি খুলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কম দামে ডলার পাচ্ছে না। সে কারণেই তারা চাহিদা মেটাতে বেশি দামে প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। আর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও এলসি খুলতে বেশি দর নিচ্ছে।
ডলারের সঙ্কট কমাতে ও দাম সামলাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া নানামুখী পদক্ষেপের মধ্যে বিলাসী পণ্যসহ সার্বিক আমদানিতে নানা শর্ত আরোপের সুফল আসতে শুরু করেছে বাজারে। কমেছে আমদানির এলসি (লেটার অব ক্রেডিট-ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ, এতে চাপ কমেছে ডলারের বাজারে, ফিরতে শুরু করেছে টাকার মান।
গতকাল মতিঝিলের কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে তারা ১১০-১১১ টাকা দরে ডলার কিনছে এবং বিক্রি করছে ১১২-১১৪ টাকা দরে। তবে ডলার ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম কমায় বলা যাবে না বাজার স্থিতিশীল হয়েছে। যতদিন-না টাকার মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাড়ছে, বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত ডলারের বাজার দোদুল্যমান থাকার শঙ্কা করেছেন ব্যবসায়ীরা।
রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্কট কেন্দ্র করে সারা বিশ্বে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ডলারের বাজারে। একদিকে দেশের রিজার্ভ কমে যাওয়া, অন্যদিকে রফতানির বিপরীতে আমদানি বেড়ে যাওয়ায় টাকার মানের অবমূল্যায়ন হতে শুরু করে, দেদার বাড়তে থাকে ডলারের দাম।
এদিকে রফতানির বিপরীতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে মারাত্মক ডলার সঙ্কট। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানিতে কড়া শর্তারোপের ফলে কমে এসেছে আমদানি ব্যয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, আগস্ট মাসের ১১ দিনে দেশে মোট ১৬১ কোটি ডলারের সমপরিমাণ মূল্যের আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে, যা জুলাই মাসের তুলনায় ৯৪ কোটি ডলার বা ৩৬ শতাংশ কম। জুলাই মাসে আমদানি হয়েছিল ২৫৫ কোটি ডলার।
এদিকে গত মাস থেকেই বাড়তে শুরু করেছে আগত রেমিট্যান্সের পরিমাণ। ধারণা করা হচ্ছে, এভাবে রেমিট্যান্সের ধারা অব্যাহত থাকলে ধীরে ধীরে সঙ্কটকালীন অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসবে। সবশেষ হিসাব অনুযায়ী (১২ আগস্ট পর্যন্ত), বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ৩৯ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজার দর ৯৫ টাকায় রাষ্টায়ত্ত জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণন সংস্থা বাংলাাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জ্বালানি তেল ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি এবং বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প করপোরেশনের (বিসিআইসি) সার আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খুলতে রিজার্ভ থেকে সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে ১২ কোটি ২০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়। এর আগে ৮ আগস্ট বিপিসির তেল আমদানি এবং বিসিআইসির সার আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খুলতে ব্যাংকগুলোর কাছে ১৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়। সব মিলিয়ে নতুন অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ১৭২ কোটি ৫৪ লাখ (১ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরমধ্যে অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১১৩ কোটি ৬৪ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। আর চলতি আগস্ট মাসের ১১ দিনে (১ থেকে ১১ আগস্ট) বিক্রি করা হয়েছে ৫৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, আগস্ট মাসে প্রতিদিন ৫ কোটি ৩৫ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাজারে ডলারের তীব্র সঙ্কট চলছে। ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিদিন যে ডলার বিক্রি করছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম; সরকারের আমদানি খরচই মিটছে না তাতে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো কোনো ডলার পাচ্ছে না। সে কারণেই তারা প্রবাসীদের কাছ থেকে বেশি দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। বাধ্য হয়ে এলসি খুলতে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশি দর রাখছে। একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েই চলেছে। দুর্বল হচ্ছে টাকা। এখন যে করেই হোক টাকাকে শক্তিশালী করতে হবে।
সূত্র মতে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ে ৭ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং রফতানি উল্লম্ফন ও আমদানি ব্যয় কমায় বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজার থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
মোঃ জিয়াউল হক সরকার ১৭ আগস্ট, ২০২২, ৪:৩৩ পিএম says : 0
রেমিটেন্সের জন্য ৫% হারে প্রনোদোনা দেওয়া উচিত। নচেত হুন্ডি ঠেকনো যাবে না ----
Total Reply(0)
Taif Biswas ১৫ আগস্ট, ২০২২, ৬:৩৯ এএম says : 0
ডলার যেন বাংলাদেশে এক প্রকার সোনার হরিণ হয়ে গেছে।
Total Reply(0)
Rabbul Islam Khan ১৫ আগস্ট, ২০২২, ৬:৩৯ এএম says : 0
৮০-৮৫ টাকার ডলার ১২০ টাকা হওয়ার পরে ১০৫ টাকা হইছে। অনেক খুশির সংবাদ
Total Reply(0)
গোলাম রসুল বিপ্লব ১৫ আগস্ট, ২০২২, ৬:৪০ এএম says : 0
রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য আলাদা একটি পেনশন স্কিম চালু করলে সবাই সরকারি ভাবে রেমিট্যান্স পাঠাতে উদ্ভুদ্ধ হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় -পাঁচ বছর, দশবছর, অথবা পাঁচ লক্ষ, দশ লক্ষ ডলার যারা দেশে সরকারি ভাবে রেমিট্যান্স হিসাবে পাঠাবে তাদের জন্য স্থায়ী ভাবে পেনশন স্কিম চালু থাকবে। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষ সরকারি চাকরির পিছনে দৌড়াই, চাকরি শেষে পেনশন পাওয়ার আশায়।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন