শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

মহানবীর মহাজীবন

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর
দ্বীন প্রচার : নবুওয়ত লাভের পর রাসুল (সা.) আল্লাহর নির্দেশে প্রথমে নিকটাত্মীয়দের কাছে গোপনে ঈমানের দাওয়াত দিতে থাকেন। তার দাওয়াতে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন তার সুখ-দুঃখের অংশীদার স্ত্রী খাদিজা (রা.)। এরপর তাদের পরিবারভুক্ত আলী (রা.), যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। পরিবারের বাইরে এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন আবু বকর (রা.)। তিনি ছিলেন রাসুল (সা.)-এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এরপর আল্লাহতায়ালার নির্দেশ পেয়ে তিনি প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। এতে মূর্তিপূজারীরা তার ঘোর বিরোধিতা শুরু করে। মহানবী (সা.) ও তার সাহাবিদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাতে থাকে। তারা মহানবী (সা.)-কে নানারকম প্রলোভন দেখাতে থাকে। নেতৃত্ব ও ধন-সম্পদ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। রাসুল (সা.) স্পষ্টভাবে তাদেরকে জানিয়ে দেন, ‘আমার এক হাতে সূর্য, আরেক হাতে চাঁদ এনে দিলেও আমি সত্য প্রচার থেকে বিরত হব না।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। ইবাদত করতে হবে একমাত্র তাঁরই। তিনি এক, অদ্বিতীয়। তাঁর কোনো শরিক নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘তোমাদের হাতে বানানো দেব-দেবীর ও প্রতিমার কোনো ক্ষমতা নেই। এদের ভালো-মন্দ করার কোনো শক্তি নেই। আসমান, জমিন, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র সবকিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহতায়ালা। তিনি সবকিছুর স্রষ্টা, পালনকারী ও রিজিকদাতা। তিনি আমাদের জীবন-মৃত্যুর মালিক। সুতরাং দাসত্ব, আনুগত্য ও ইবাদত করতে হবে একমাত্র তাঁরই।’ তিনি আরও বললেন, ‘তোমরা সত্য-ন্যায় ও সুন্দরের পথে ফিরে এসো। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, জুয়া, ব্যভিচার, মিথ্যা, প্রতারণা- এসব পাপের কাজ। সুতরাং এগুলো পরিহার করো। কারও প্রতি অন্যায় অবিচার করবে না। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করবে না। অন্যায়ভাবে কারও সম্পদ হরণ করবে না। কারও প্রতি জুলুম করবে না।’ মহানবী (সা.) আরও বোঝালেন, ‘তোমাদের দুনিয়ার জীবন শেষ নয়। মৃত্যুর পর আরও এক জীবন আছে। যে জীবন অনন্তকালের। পরকালে আল্লাহর দরবারে দুনিয়ার ভালো-মন্দ সব কাজের জন্য হিসাব দিতে হবে। দুনিয়ার জীবনে যারা আল্লাহ ও রাসুলের কথা মানবে, ভালো কাজ করবে, পরকালে তারা মুক্তি পাবে। চির সুখের স্থান জান্নাত লাভ করবেন। আর যারা আল্লাহ ও রাসুলের কথা মানবে না, মন্দ কাজ করবে, তারা চরম শাস্তির স্থান জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।

তায়েফ গমন : নবুওয়তের দশম বছরে মহানবী (সা.)-এর প্রিয়তমা সহধর্মিনী খাদিজা (রা.) ও তার চাচা আবু তালেব ইন্তেকাল করেন। এতে তিনি শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। সীমাহীন শোক ও কাফেরদের অত্যাচারের মুখেও তিনি দ্বীন প্রচার করতে থাকেন। তিনি মক্কাবাসীদের থেকে এক রকম নিরাশ হয়ে দ্বীন প্রচারের জন্য তায়েফ গমন করেন। সেখানকার লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করল না। বরং তারা প্রস্তুরাঘাতে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র শরীর ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত করল। মহানবী (সা.) এমন সময় তায়েফবাসীদের জন্য বদদোয়া করলেন না। বরং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেন। অবশেষে তিনি আবার মক্কায় ফিরে এলেন।

মেরাজে গমন : মক্কার কাফেরদের সীমাহীন অত্যাচার ও তায়েফবাসীদের দুর্ব্যবহারে মহানবী (সা.) অত্যন্ত মর্মাহত ও ব্যথিত হলেন। তখন আল্লাহতায়ালা তাকে নিজের সান্নিধ্যে নিলেন। রাসুল (সা.)-এর বয়স যখন ৫১ বছর ৯ মাস, তখন তাকে সশরীরে মর্যাদাপূর্ণ ইসরা ও মেরাজ ভ্রমণের মাধ্যমে সম্মানিত করা হয়। নবুওয়তের একাদশ বছর রজব মাসের ২৭ তারিখে মেরাজের রাতে রাসুুল (সা.) প্রথমে কাবা থেকে বাইতুল মোকাদ্দাসে যান। সেখানে তিনি পূর্ববর্তী নবীদের সান্নিধ্য লাভ করেন। তাদের ইমাম হয়ে সালাত আদায় করেন। অতঃপর সেখান থেকে এক-এক করে সাত আসমান অতিক্রম করে মহান আল্লাহর আরশে তাশরিফ গ্রহণ করেন। এ সফরে রাসুল (সা.) পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান লাভ করেন। জান্নাত-জাহান্নাম স্বচক্ষে দর্শন করেন। সরাসরি আল্লাহর দিদারে ধন্য হন। মেরাজ মহানবী (সা.)-এর জীবনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এতে তিনি নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে পূর্ণোদ্যমে দ্বীন প্রচার করতে থাকেন।

মদিনায় হিজরত : ৬২১ খ্রিষ্টাব্দে হজের মৌসুমে মদিনা থেকে ১২ জন লোকের একটি দল মক্কায় আসেন। গোপনে মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাত করে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে মদিনা থেকে দুজন নারীসহ ৭৫ জনের একটি দল এবং আকাবায় মহানবী (সা.)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারা মহানবী (সা.) ও সাহাবিদের মদিনায় হিজরতের আহ্বান জানান। সব রকম সহযোগিতা দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। মক্কার কাফেরদের বিরোধিতা ও নির্যাতনের মাত্রা যখন বেড়ে গেল এবং ইসলাম প্রচার বাধাগ্রস্ত হলো, তখন মহানবী (সা.) সাহাবিদের মদিনায় হিজরতের নির্দেশ দিলেন। নিজে আল্লাহর আদেশের অপেক্ষায় রইলেন। কোরাইশরা রাসুল (সা.)-কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করল। কিন্তু তারা ব্যর্থ হলো। আল্লাহতায়ালা তাকে হেফাজত করলেন। রাসুল (সা.) নিজ ঘর থেকে বেরুলেন। আল্লাহতায়ালা কাফেরদের চোখ অন্ধ করে দিলেন। যাতে তারা রাসুল (সা.)-কে দেখতে না পারে। তিনি চলতে চলতে মক্কার বাইরে আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর সঙ্গে মিলিত হলেন। অতঃপর তারা একসঙ্গে পথচলা আরম্ভ করেন। সওর নামক পাহাড়ে পৌঁছে একটি গুহায় তিনদিন পর্যন্ত আত্মগোপন করেন। এ সময়টিতে আবদুল্লাহ বিন আবু বকর (রা.) তাদের কাছে কোরাইশদের সংবাদ পৌঁছাতেন। তার বোন আসমা (রা.) খাদ্য ও পানীয় পৌঁছে দিতেন। তারপর রাসুল (সা.) ও তার সঙ্গী আবু বকর (রা.) গুহা থেকে বের হন। তারা মদিনার পথে যাত্রা শুরু করেন। রাসুল (সা.) মদিনায় পৌঁছে তাকওয়ার ভিত্তিতে ইসলামের সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন। বর্তমানে মদিনা শরিফে এ মসজিদটি ‘মসজিদে কোবা’ নামে পরিচিত। মদিনায় রাসুল (সা.) সর্বপ্রথম যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তা হলোÑ মসজিদে নববি নির্মাণ এবং আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন।

মদিনা সনদ : মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরত করে একটি আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলেন। এখানে মুহাজির-আনসারসহ সব মুসলমান, ইহুদি-খ্রিষ্টান ও অন্যান্য মতাদর্শের লোক একত্রে মিলেমিশে সুখে-শান্তিতে নিরাপদে বসবাস করবে। তাদের মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি বজায় থাকবে। স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম পালন করতে পারবে। সঙ্গে সঙ্গে মদিনার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এ উদ্দেশে তিনি সব সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি লিখিত চুক্তি সম্পাদন করেন। এটি ‘মদিনা সনদ’ নামে খ্যাত। এটি পৃথিবীর সর্বপ্রথম লিখিত সনদ। এ সনদে ৪৭টি ধারা ছিল। মদিনার সনদ রাসুল (সা.)-এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কূটনৈতিক দূরদর্শিতা, ধর্মীয় সহিংসতা এবং সুন্দর সমাজ গঠনের এক জ্বলন্ত স্বাক্ষর। এতে বিভিন্ন জাতের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও আর্থসামাজিক অধিকার নিশ্চিত হয়।
বদর ও অন্যান্য যুদ্ধ : মক্কার কাফের-মুশরিকরা ইসলাম ও মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু মদিনায় ইসলামের উত্তরোত্তর উন্নতি দেখে তারা হিংসায় জ্বলে ওঠে। মদিনার ইহুদিরা তাদের প্ররোচিত করে। এদিকে আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলা মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার গুজব ওঠে। কাফেররা মদিনা আক্রমণের জন্য রওনা হলো। সংবাদ পেয়ে রাসুল (সা.) ৩১৩ জন সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে মদিনা থেকে প্রায় ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর নামক স্থানে উপস্থিত হন। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে বদর প্রান্তরে দুইপক্ষ পরস্পর মুখোমুখি হলো। কোরাইশ বাহিনীর সংখ্যা এক হাজার। অস্ত্রশস্ত্র বেশুমার। মুসলিমদের সংখ্যা নগণ্য। অস্ত্রশস্ত্র তেমন কিছু নেই। কিন্তু তারা ঈমানের বলে বলিয়ান ও তাদের আল্লাহর ওপর অকৃত্রিম বিশ্বাস ও ভরসা। তুমুল যুদ্ধ হলো। মুসলিম বাহিনী বিজয়ী হলো। বদর যুদ্ধে নেতা আবু জাহেল, ওলিদ, উতবা ও শায়বাসহ ৭০ জন মারা গেল। ৭০ জন বন্দি হলো। মুসলিমপক্ষে ১৪ জন শহিদ হন। রাসুল (সা.) ও মুসলমানরা যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে উদার ও মানবিক আচরণ করেন। নিজেরা না খেয়ে বন্দীদের খাওয়ান। নিজেরা পায়ে হেঁটে বন্দীদের বাহনের ব্যবস্থা করেন। বন্দী মুক্তির চমৎকার ব্যবস্থা করেছিলেন। শিক্ষিত বন্দীদের মুক্তিপণ নির্ধারিত করা হলো ১০ জন করে নিরক্ষর মুসলিম বালক-বালিকাদের শিক্ষিত করা। বদর যুদ্ধের শোচনীয় পরাজয়ের পরও কাফেররা দমে গেল না। তারা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে বারবার আক্রমণ চালাতে লাগল। এর মধ্যে উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধ ছিল ভয়াবহ। এসব যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় হলেও উহুদ যুদ্ধে সামান্য ভুলের জন্য মুসলমানদের অনেক ক্ষতি হয়েছিল। ৭০ জন সাহাবি শাহাদত বরণ করেন। মহানবী (সা.)-এর দাঁত মোবারক ভেঙে যায়।

হোদায়বিয়ার সন্ধি : ষষ্ঠ হিজরি সনে ৬২৮ খ্রিষ্টব্দে রাসুল (সা.) ওমরা পালনের উদ্দেশে ১৪০০ জন সাহাবিসহ মক্কা যাত্রা করেন। মক্কার নয় মাইল দূরে হোদায়বিয়া নামক স্থানে উপনীত হন। কোরাইশরা ওমরা পালনে বাঁধা দেয়। রাসুল (সা.) জানালেন, ‘আমরা যুদ্ধের জন্য আসিনি। শুধু ওমরা করে চলে যাব।’ কিন্তু কোরাইশরা তাতেও রাজি হলো না। রাসুল (সা.) মক্কাবাসীদের কাছে ওসমান (রা.)-কে দূত হিসেবে পাঠান। তার ফিরে আসতে বিলম্ব হওয়ায় তিনি শহিদ হয়েছেন বলে রব ওঠে। রাসুল (সা.) মুসলমানদের থেকে এ হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ নেন। কাফেররা ভয়ে ওসমান (রা.)-কে ফেরত দেয়। সুহাইল আমরকে সন্ধির প্রস্তাব পাঠায়। ১০ বছরের জন্য সন্ধি হয়। এটি হোদায়বিয়ার সন্ধি নামে খ্যাত। সন্ধির শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম শর্ত ছিলÑ ১. মুসলমানরা এ বছর ওমরা না করে ফিরে যাবেন। আগামী বছর নিরস্ত্রভাবে তিনদিনের জন্য আসবেন। ২. কোনো মক্কাবাসী মদিনায় আশ্রয় নিলে তাকে মক্কায় ফেরত দিতে বাধ্য থাকবেন। কিন্তু কেউ মদিনা থেকে মক্কায় এলে তাকে ফেরত দেওয়া হবে না। ৩. আরবের যে কোনো গোত্র দুই পক্ষের যে কারও সঙ্গে মিত্রতা করতে পারবে। আপাত দৃষ্টিতে এ সন্ধির শর্তগুলো মুসলমানদের জন্য অপমানজনক হলেও প্রকৃতপক্ষে সুফল বয়ে এনেছিল। এতে কাফেররা মুসলমানদের একটি শক্তিধর স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে মেনে নিয়েছিল। দেশ-বিদেশে ইসলাম প্রচারের সুযোগ হলো। দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করতে লাগল। কোরআনে কারিমে একে প্রকাশ্য বিজয় বলা হয়েছে। (চলবে)

লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন