রাজু আহমেদ : কোন রাষ্ট্র তার কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশকে কর্মহীন রেখে কাক্সিক্ষত গন্তব্যের চূড়ান্তসীমা স্পর্শ করতে পারে না। চরম অভিজ্ঞতাবাদী ব্রিটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম বলেছেন, ‘বেকার সমস্যার সমাধান করতে না পারলে একটা রাষ্ট্র কখনো উন্নত হতে পারে না।’ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গজুড়ে উন্নতির অগ্রযাত্রায় শামিল হওয়ার স্বপ্ন অনিঃশেষ অথচ এ স্বপ্নের গতি রোধ হয়ে আছে কেবল এদেশের লাখো তরুণ-যুবার বেকারত্বের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের অবর্তমানে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেকারের সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি থমকে যাচ্ছে জাতীয় জীবনের অগ্রগতির চাকা। কেননা কর্মক্ষম হওয়া পরেও কর্মহীন থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীর ভরণ পোষণে ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তিদের হাঁসফাঁস অবস্থা।
বেকারত্বের অভিশাপ শুধু যে নির্দিষ্ট পরিবারকে ভোগাচ্ছে তা নয় বরং সামাজিক শৃঙ্খলাও প্রকটভাবে ব্যাহত করছে। শিক্ষাজীবন সমপান্তে শিক্ষিত বেকারদের জীবন যখন হতাশায় পূর্ণ তখন তারা আইনবিরোধী, সমাজবিরুদ্ধ কাজে শঙ্কাজনকভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। কেননা কোন মস্তিষ্কজুড়ে যখন হতাশা খেলা করে তখন বিপথে পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবলভাবে প্রেষণা জোগায়। মাদকের হাতছানিতে আচ্ছন্ন হওয়া কিংবা অন্যকোন সমাজবিরোধী কাজে শিক্ষিত বেকারদের জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তখন প্রবল। যে কারণে যে জনগোষ্ঠীকে ঘিরে আশার বীজ বপিত ছিল তা এখন ধ্বংসের জ্বালানি হচ্ছে এবং স্বপ্ন ভঙ্গের ঢেউ খেলছে সীমার প্রান্তরজুড়ে। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মে প্রবেশ না করতে পারার এ ব্যর্থতা বেকারদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার একক সুযোগ নেই কেননা শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি এবং সমস্যা নিরসনের যৌক্তিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের বিন্যাসতত্ত্ব মোটেও সন্তোষজনক নয়। আমাদের দেশের শিক্ষার হার এশিয়া-ইউরোপের অনেক দেশের চেয়ে গর্ব করা কিংবা প্রলুব্ধ হওয়ার মতই বেশি অথচ শিক্ষিতদের একাংশকে রাষ্ট্র শুধু সনদস্বর্বস্ব শিক্ষিত করে গড়ে তোলার কাজ সুনিপুনভাবে সমাধা করছে!
জ্ঞানতাত্ত্বিক বিচারে শিক্ষার লক্ষ্য যাই থাকুক না কেন আমাদের দেশের অভিভাবক, শিক্ষার্থী এবং পরিবেশের কাছে শিক্ষা সমপান্তের আবেদন যে চাকরি প্রাপ্তির প্রত্যাশা, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। মন খারাপ করে দেয়ার মতো তথ্য পকাশ করেছে লন্ডনের ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) গবেষকরা। তাদের জরিপে প্রকাশ পেয়েছে, বাংলাদেশের স্নাতক ও স্নাতোকত্তোরদের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৪৭ জন বেকার। অথচ আমাদের সীমান্তবর্তী দেশ ভারতে প্রতি ১০০ জনে ৩৩ জন বেকার। পাকিস্তান ও নেপালে যথাক্রমে প্রতি ১০০ জনে ২৮ ও ২০ জন বেকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্যমতে, চিকিৎসক-প্রকৌশলীদের মধ্যে বেকারের হার শতকরা ১৪.২৭। ডিগ্রি সমমানের সনদধারীদের বেকারের হার শতকরা ১৩.৭৪। চরম বেকারত্বে আক্রান্ত বিশ্বের শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২ এ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চরম বেকারত্বের জন্য যতগুলো কারণকে চিহ্নিত করা চলে তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে মানসম্মত যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম তথা কর্মমুখী শিক্ষা পদ্ধতির অনুপস্থিতি। বিশ্বের উন্নত দেশসমূহে প্রতি ১০-১৫ বছর পরপর তাদের শিক্ষাক্রমে আমূল পরিবর্তন আসলেও আমাদের দেশে বিগত চার দশক যাবৎ প্রায় একই শিক্ষাপদ্ধতি বিদ্যমান। ক্ষমতার পালাবদলে শিক্ষাক্রম থেকে শুধু রাষ্ট্রের জন্ম ইতিহাস এবং নেতানেত্রীদের ছবি পরিবর্তন ছাড়া সময়ের সাথে মানানসই শিক্ষাক্রমের সংযুক্তি ঘটেনি বললেই চলে। অন্যদিকে শিক্ষার হার বাড়ানোর জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা, শিক্ষাক্ষেত্রে অনৈতিক সুযোগলাভের জন্ম, কোটা ব্যবস্থার অসংলগ্ন প্রয়োগ, সর্বোপরি ‘ওপেন সিক্রেট’ হিসেবে চাকরির ক্ষেত্রে বিনিময় বাণিজ্য বেকারত্বের গল্পগুলোকে আরও দীর্ঘায়িত ও ট্রাজেডিপূর্ণ করছে। তদুপোরি, চাকরির বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে চাকরি প্রত্যাশীদের দরখাস্ত তলব করার সাথে ৩০০-৫০০ টাকা ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে রাষ্ট্র বোধহয় আয়ের উৎস আবিষ্কার করেছে! ৩০০-৫০০ টাকা ব্যাংক ড্রাফটের জন্য আনুষঙ্গিক ৩৫০-৫৫০ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। অসহায় বেকারদের রক্ত বিক্রি করে ব্যাংক ড্রাফটের টাকা পরিশোধের বাস্তব গল্প এ জাতির অজানা নয়। ব্যয় মেটানোর জন্য ব্যাংক ড্রাফটের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই অস্বীকার্য নয় তবে এটা সহনীয় রাখা আবশ্যক। প্রতি পদের জন্য যেখানে হাজার হাজার প্রার্থীর দরখাস্ত একীভূত হয় সেখানে এ অধিক পরিমাণ অর্থের ব্যাংক ড্রাফটের প্রয়োজনীয়তা আদৌ নেই বরং এটা বেকারদের হতাশায় শেষ পেরেকে ঠোকার শামিল।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর মতে বাংলাদেশে ৩ কোটি মানুষ বেকার। অবশ্য তাদের প্রদত্ত বেকারত্বের সংজ্ঞা স্বাভাবিক ধারণার চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের বেকারের সংখ্যা কোটির ওপরে নয় তবে বেকার বৃদ্ধির যে হার তাতে কোটি স্পর্শ করতে কিংবা ছাড়িয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’র প্রদত্ত তথ্য মতে, প্রতিবছর সাড়ে ৩ লাখ স্নাতক (সমমান বা তদোর্ধ) ডিগ্রিধারী হচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারপ্রেস নেটওয়ার্কের মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৭ লাখ মানুষ কর্মক্ষম হচ্ছে অথচ কাজ পাচ্ছে মাত্র ২ লাখ। যা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৭ শতাংশ। বিশ্ব কর্মসংস্থান ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি-২০১৫ এর সেমিনারে উপস্থাপিত তথ্যমতে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে বেকার বৃদ্ধির হার ৪.৩৩ শতাংশ। বিবিএস প্রকাশিত তথ্যমতে, বাংলাদেশে কর্মক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা ৬ কোটি ১৩ লাখ। কর্মে নিযুক্ত আছে ৫ কোটি ৮৭ লাখ এবং বেকার ২৬ লাখ ৩০ হাজার। বেকার বৃদ্ধির হার ৪.৫ শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংক মনে করে, বাংলাদেশে বেকার বৃদ্ধির হার ১৪.২ শতাংশ। কর্মক্ষেত্র সৃষ্টিতে সরকারি ব্যবস্থাপনার চেয়ে বেসরকারি উদ্যোগ ব্যাপক প্রশংসা প্রাপ্তির দাবিদার। সরকারিভাবে দেশে মাত্র ১৩ লাখ ৫৮ হাজার ৩৩৭ জন ব্যক্তির জন্য কাজের স্থায়ী পদ থাকলেও বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মপদের সংখ্যা কয়েক কোটি। কাজেই সরকার যদি কেবল অযাচিতভাবে শিক্ষার হার না বাড়িয়ে শিক্ষার মান বাড়াতে বদ্ধপরিকর হয় তবে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব নয় বরং সম্ভাবনার দ্বার আরও বহুক্ষেত্রে উন্মোচিত হবে বলেই বিশ্বাস।
বাংলাদেশে বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করার জন্য একদিকে যেমন সরকারি নীতিনির্ধারকদের বাস্তবতা বিবর্জিত চিন্তা-সিদ্ধান্ত দায়ী তেমনি দায়ী সমাজ তথা ব্যক্তি মনঃস্তত্ব। বাংলাদেশের মতো ছোট্ট দেশে ১০ লাখের বেশি বিদেশি কর্মরত আছে অথচ আমাদের দেশে থেকে বিদেশে গমনকারীদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। কেননা বিদেশি সংস্থা যে দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিক চাচ্ছে তা বাংলাদেশ তৈরি করছে না। অন্যদিকে কূটনৈতিক সম্পর্কের দ্বারা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য শ্রমবাজার উন্মুক্ত করতে যে প্রচেষ্টা দরকার তারও অনুপস্থিতি বিদ্যমান। বিদেশগমনে বর্তমানে যে ব্যবস্থা বিদ্যমান তাতে ৮-১০ লাখ টাকা ছাড়া বিদেশ পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন দেখাই যেন বারণ! অথচ সুষ্ঠু সরকারি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যদি এদেশের দক্ষ, আধাদক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকদের বিদেশ যাত্রার ব্যয় কমানো যেতো তবে এদেশের বেকারের সংখ্যাই শুধু কমতো না বরং বৈদেশিক রেমিটেন্সে দেশের অর্থ খাত ফুলে ফেঁপে উঠত। বিগত কয়েক মাস যাবৎ দেশের অভ্যন্তরে বিদেশি বিনিয়োগ কিছুটা থমকে থাকলেও বর্তমানে তা আবার চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। কাজেই সরকার যথেষ্ট আন্তরিক হলে, দেশের অভ্যন্তরে লাখো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব।
মনঃস্তাত্বিক দিক থেকে শিক্ষাকার্য অর্জন শেষে তরুণদের মধ্যে কাজ করে চাকরি পাওয়ার প্রবল বাসন। যখন এ বাসনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় তখন তারুণ্যের জয়জয়কার পেছনে ফেলে ভর করে হতাশার দীর্ঘশ্বাস। অথচ শুধু চাকরি প্রাপ্তির সিদ্ধান্ত থেকে মনকে অন্যদিকেও নিবদ্ধ করলে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রত্যেকে যে উদ্যোক্ত হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত থাকার পরেও শিক্ষিত তরুণ-যুবারা সে পথে হাঁটতে অনিচ্ছুক। এরা স্বেচ্ছায় কর্মচারী হতে রাজি কিন্তু নিজ রাজ্যের অধিকর্তা হবে না মোটে! ফ্রিল্যাসিং থেকে আয়ের ক্ষেত্রে সমগ্র বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় নম্বরে। প্রতি মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় করার জন্য মধ্যমানের ইংরেজি, কিছু কম্পিউটার প্রোগ্রাম এবং ইন্টারনেট সম্পর্কে ধারণা থাকাই যথেষ্ট। এ কাজে যথেষ্ট স্বাধীনতা থাকার পরেও তরুণরা এদিকে না ঝুঁকে বেকারত্বের গ্লানি মেখে থাকছে এবং অথর্বতায় পরিপুষ্ট জীবনযাপন করছে। অবশ্য এজন্য সামাজিক রীতিও বহুলাংশে দায়ী। এ সমাজে চাকরি দ্বারাই কেবল মানুষের ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং সামাজিক মর্যাদার মূল্যায়ন হয়। সময় দ্বারে কড়া নাড়ছে, বদ্ধমূল এ ধারণার সাথে বেকারত্বের খোলসও ভেদ করতে হবে। রাষ্ট্র তার পদ্ধতির অসরতার কারণে একজন দক্ষ মানুষের সেবা বঞ্চিত হতে পারে কিন্তু এ জাতিকে দেয়ার জন্য চাকরির বাইরে থেকেও অনেক কিছু করার সক্ষমতা যে প্রত্যেক তরুণ লালন করছে তার অগ্নিশিক্ষা প্রদর্শনের এটাই সর্বোৎকৃষ্ট মৌসুম। স্বপ্নের অপমৃত্যু আর ঘটতে দেয়া যাবে না, উচিতও নয়। এজন্য রাষ্ট্রকেও কিছুটা সমসাময়িক শিক্ষার পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে এবং তরুণদেরকেও সম্ভাবনাময় সীমার প্রাচীর উন্মুক্ত করতে হবে। ফ্রিল্যাসিংসহ যে সকল ক্ষেত্রে প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে তার জন্য উপযোগী শিক্ষা সংযুক্তকরণের মাধ্যমে জাতিকে যোগ্য করে তুলতে হবে। সর্বোপরি, রাষ্ট্রকে শিক্ষার হার নয় বরং মান বাড়াতে বদ্ধপরিকর হতে হবে। মানসম্মত শিক্ষিত হলে তারা বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে বসে থাকবে না বরং নিজেেেদর পথ নিজেরাই উন্মুক্ত করে সম্ভাবনার পথে সাফল্যের সঙ্গে যাত্রা করবে।
লেখক : কলামিস্ট
ৎধলঁ৬৯ধষরাব@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন