একটি সিনেমা শুধু বিনোদন নয়, পরিবার ও সমাজ সংস্কার, শিক্ষনীয় বিষয়সহ দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ করতে ভূমিকা রাখে। শুধু তাই নয়, চলচ্চিত্র কালের সাক্ষীও বটে। চলচ্চিত্র বিভিন্ন সময় সামাজিক, রাজনৈতিক অসঙ্গতি, শোষণ-নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সহায়তা করে। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে সে সময়ের স্বৈরশাসনের চিত্র। ২০০২ সালে তারেক মাসুদ ‘মাটির ময়না’র মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুন্ন রাখার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। এছাড়া চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সমসাময়িক বিষয়সহ লোকগাঁথা ও গ্রামীণ বাংলার সহজ সরল জীবনচিত্রও তুলে ধরা হয়। তবে দীর্ঘদিন ধরেই দর্শক যেন বিমুখ হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে অসংখ্য সিনেমা হল। দেড় হাজার সিনেমা হলের মধ্যে সর্বসাকুল্যে দেড়-দুইশ’ সিনেমা হল কোনো রকমে টিকে আছে। সিনেমা হল মালিকদের অনেকেই হল ভেঙ্গে শপিং মল করেছে। তবে এই হতাশার চিত্রের মধ্যেও কিছুটা আলোর রেখা দেখা দিয়েছে। গত ঈদ-উল-ফিতরে মুক্তি পায় ৪টি সিনেমা। তার মধ্যে ছিল ‘গলুই’, ‘বিদ্রোহী’, ‘শান’ ও ‘বড্ড ভালোবাসি। গলুই এবং শান ছিলো দর্শক চাহিদার কেন্দ্রবিন্দুতে। দর্শক হলমুখী হয়। গত ঈদ-উল-আযহায়ও মুক্তি পায় ৩টি সিনেমা। এর মধ্যে রয়েছে ‘পরাণ’, ‘দিন দ্য ডে ও ‘সাইকো’। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’। সিনেমাটি বেশ আলোচিত হয়। অনেকে বলছেন, সিনেমাটি দর্শক চাহিদা মেটাতে ও হলমুখী করতে পেরেছে। সিনেমার কিছুটা আশা জাগানিয়া পরিবেশে এখন এফডিসি’র চিত্রটি কেমন? এ ব্যাপারে এফডিসিতে দুই দিন আগে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এখনও সিনেমার এই কারখানাটি স্থবির হয়ে রয়েছে। নেই সেই আমেজ। পুরো এফডিসি প্রাঙ্গণ ঘুরে বেড়ালেও দেখা যায়নি কোনো শিল্পী-কলাকুশলীর পদচারণা। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির অফিসেও নেই কেউ। শুধু কয়েকজন এক্সট্রা আর্টিস্টকে বাইরে বেকার বসে গল্প করতে দেখা যায়। তারা কি আলোচনা করছে বুঝতে চেষ্টা করলে যে বিষয়টি বোঝা যায় তা হচ্ছে, তারা ভালো নেই। কাজ কম থাকায় সংসার নিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছে। শিল্পী সমিতির পাশে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দুয়েকজন পরিচালক বশে খোশগল্প করছেন। তবে কোন সুপরিচিত পরিচালকের দেখা মিলেনি। জনশূন্য এফডিসিতে সিনেমার কোন আমেজ নেই, নেই কোন কাজ। যেখানে দিন-রাত লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশান ও শিল্পীদের পদচারনায় মুখরিত থাকতো, সেটি এখন খা খা করছে। দুই ঈদ মিলিয়ে এবং পরবর্তীতে যে সিনেমাগুলো মুক্তি পেয়ে দর্শক সাড়া কিছুটা হলেও জাগিয়েছে, এফডিসিতে তার কোনো প্রভাব নেই। এফডিসির ক্যান্টিন যেখানে শিল্পী, কলাকুশলী ও টেকনিশিয়ানদের আড্ডায় মুখলিত থাকে এবং সবে এক কাপ চা পান করার মতো জায়গা পাওয়া যেত না, সেই ক্যান্টিন ফাঁকা। উঠিয়ে রাখা হয়েছে চেয়ার টেবিল। একটি টেবিলে জনাতিনেক লোককে বসে থাকতে দেখা যায়। সেখান থেকে ৮ ও ৯ নম্বর ফ্লোরে গিয়ে দেখা যায়, এটিএন বাংলার জন্য নির্মিত হচ্ছে ছোট বাচ্চাদের নিয়ে একটি গানের অনুষ্ঠান। প্রায় এক ঘন্টা এফডিসিতে চক্কর দিয়ে সেখানে গিয়ে শুনলাম চিরপরিচিত ক্যামেরার রোলিং ও অ্যাকশন শব্দদ্বয়। পুরো এফডিসিতে এছাড়া আর কোন শুটিং চোখে পড়েনি। নেই মানুষের কোলাহল। কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। চলচ্চিত্রের সোনালী অতীতের সাক্ষী, বহু কালজয়ী গানের শুটিং যে ঝর্ণা স্পট যেখানে দিন-রাত শুটিং করেছেন অনেক কিংবদন্তী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সেখানে গিয়ে দেখা গেল, স্পটটি খুবই বেহাল অবস্থার মধ্যে রয়েছে। যেন একটি ডাস্টবিনে পরিনত হয়েছে। শুটিং করার মতো অবস্থায় নেই। আশপাশ জুড়ে ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি। ময়লা পানি জমে আছে এবং সেখান থেকে যে মশার উৎপাদন হচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবে নজর কেড়েছে পাশের নান্দনিক শিল্পকর্মের মসজিদটি। মাগরিব নামাজের সময় মুসল্লিদের দল বেঁধে মসজিদে আসার দৃশ্যটি সত্যিই মন ছুঁয়ে যায়। অনেকের মনেই ভ্রান্ত ধারনা আছে, যারা চলচ্চিত্রে নাচ-গান করে তারা হয়তো নামাজ-কালাম পড়ে না। তবে এটা মনে রাখা দরকার, চলচ্চিত্রে যারা কাজ করেন এটা তাদের পেশা। চলচ্চিত্রে কাজ করলেই নামাজ-কালাম পড়া যাবে না, তা নয়। কারণ হচ্ছে, ভাল-মন্দ দুটোই পাশাপাশি চলে। ভালো কাজ করলে তার যেমন ভালো ফল পাওয়া যায়, তেমনি খারাপ কাজ করলে খারাপ ফল পাওয়া যায়। চলচ্চিত্র শিল্পীদের জন্যই এফডিসিতে মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। কাজের পাশাপাশি তারা ধর্মচর্চাও করেন।
দর্শক হলে ফিরতে শুরু করেছে। এই ধারাটা যদি ধরে রাখা যায়, তাহলে চলচ্চিত্র পাড়ায় ব্যস্ততা বাড়বে। আবারও সিনেমাঙ্গণে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরবে। এজন্য চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব না রেখে একসাথে কাজ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন