এম এম খালেদ সাইফুল্লা : বিভিন্ন খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও জালিয়াতি নিয়ে দেশে-বিদেশে তুমুল হৈচৈ পড়ে যাওয়ায় ধারণা করা হয়েছিল, সরকার এবং দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিশ্চয়ই সতর্ক হবেন। অন্যদিকে বাস্তব অবস্থা ‘যাহা ৫২ তাহা ৫৩’ তো রয়েছেই একযোগে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে দুর্নীতি। বিশেষ করে ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।
অর্থমন্ত্রীর সংসদে উপস্থাপিত তথ্য-পরিসংখ্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, সরকারি ও বেসরকারি ৫৬টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৬৫৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংক সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ রয়েছে এমনকি বিদেশি ব্যাংকগুলোরও- যদিও এর পরিমাণ এক হাজার ৮৩৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আশংকার কারণ হলো, অর্থের পরিমাণের সঙ্গে খেলাপি ব্যক্তিদের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এক লাখের বেশি ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছেন। যুক্তির অবশ্য শেষ নেই তাদের। সময়মতো ঋণ এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ না পাওয়া, রাজনৈতিক সংকট ও সহিংসতার কারণে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী যথাসময়ে পণ্য পৌঁছাতে না পারা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মঘটসহ শ্রমিক অসন্তোষের মতো অনেক যুক্তি ও অজুহাতের কথাই জানিয়ে থাকেন খেলাপিরা। অন্যদিকে তথ্যাভিজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের অভিমত, এসবের অধিকাংশই আসলে খোঁড়া যুক্তি। গলদ রয়েছে তাদের উদ্দেশ্যের মধ্যে। বড় কথা, খেলাপি ঋণের প্রতিটি ক্ষেত্রে সরাসরি জড়িত রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। এই নেতারা প্রভাব খাটিয়ে ঋণের ব্যবস্থা যেমন করছেন তেমনি আবার বাঁচিয়ে দিচ্ছেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কবল থেকেও। ফলে ঋণের অর্থ না দিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছেন খেলাপিরা। মূলত সে কারণেই বেড়ে চলেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এভাবে বেড়ে যাওয়াকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এক ‘বিরল’ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আশংকার কারণ হলো, বর্তমান সরকারের আমলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এ ব্যাপারেও যথারীতি রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংকই এগিয়ে রয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে ‘হলমার্ক’ ধরনের নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার পাশাপাশি সুপারিশের আড়ালে ক্ষমতাসীনদের চাপের কারণেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে চলেছে বলে মনে করছেন তথ্যাভিজ্ঞরা। ব্যাংক কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি না থাকার সুযোগে ব্যাংকিং খাতের চরম অব্যবস্থাপনার কথাও বলেছেন তারা। এভাবে চলতে থাকলে দেশের ব্যাংকিং খাত তথা সমগ্র অর্থনীতিই মুখ থুবড়ে পড়বে বলেও তথ্যাভিজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।
ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার খবর অত্যন্ত আশংকাজনক হলেও এতে অবশ্য বিস্মিত হওয়া উচিত নয়। কারণ, ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ রয়েছে অথচ বিভিন্ন অর্থখাতে দুর্নীতি-অনিয়ম ঘটবে না এমন অবস্থার কথা কল্পনা করা যায় না। এ যে শুধু কথার কথা কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অভিযোগ নয় তার প্রমাণ তো নিয়মিতভাবেই পাওয়া যাচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে শেয়ারবাজারের লক্ষ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা থেকে পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক ঘুষ-দুর্নীতির মহোৎসবের মতো অনেক ঘটনারই উল্লেখ করা যায়। কারণ, প্রতিষ্ঠিত সত্য হলো, ‘হলমার্ক’ ও ‘বিসমিল্লাহ’সহ প্রতিটি কেলেংকারিতে ক্ষমতাসীনদের রথি-মহারথিরাই জড়িত রয়েছেন। বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদগুলোর দিকেও লক্ষ করা যেতে পারে। গা থেকে এখনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ধ যায়নি এমন কিছু যুবক-যুবতীকেই পরিচালনা পরিষদগুলোতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল, যারা ব্যাংকিং-এর অ, আ, ক, খ সম্পর্কে কিছু জানেন কিনা তা নিয়ে পর্যন্ত প্রশ্ন রয়েছে। তাদের প্রধান ‘যোগ্যতা’- সবাই অমুক লীগ বা তমুক লীগের নেতা বা নেত্রী ছিলেন। এসব পরিচালকও জবর দেখিয়ে ছেড়েছেন, যার প্রমাণ দেয়ার জন্য ‘হলমার্ক’ কেলেংকারিই যথেষ্ট। এই একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক একাই চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ওদিকে রথি-মহারথিদের হুকুম তামিল করতে হয়েছে বলে ব্যাংকের কর্মকর্তারাও উপোস করতে রাজি হননি। তারাও খেয়েছেন যেমন, গিলেছেনও তেমনই। এভাবে সবার অংশগ্রহণেই সর্বনাশের পর্যায়ে এসে গেছে দেশের ব্যাংকিং খাত। বলা দরকার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের যদি সততা ও সদিচ্ছা থাকতো এবং তারা যদি দূরপ্রসারী গঠনমূলক পরিকল্পনা নিয়ে পা বাড়াতেন তাহলে অবস্থা অবশ্যই এতটা ভয়াবহ হতো না।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা শুধু ঘুষ-দুর্নীতির মহোৎসবেই মেতে থাকছেন না, এমন আরো কিছু পদক্ষেপও নিয়ে চলেছেন যেগুলোর কারণেও একদিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে অন্যদিকে স্থবির হয়ে পড়ছে জাতীয় অর্থনীতি। যেমন প্রায় পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ঢালাওভাবে গ্যাসের সংযোগ দেয়া বন্ধ রাখার কারণে বহু শিল্প প্রতিষ্ঠানই উৎপাদনে যেতে পারেনি বলে এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এখনো হচ্ছে না। ফলে খেলাপি ঋণও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। আমরা মনে করি, ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের কবল থেকে রক্ষা করতে হলে সরকারকেই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। এজন্য ঘুষ-দুর্নীতির পথ থেকে সরে তো আসতেই হবে, একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনার দিকেও নজরদারি বাড়াতে হবে। গ্যাসের সংযোগ দেয়া এবং বিদ্যুৎ সংকট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারেও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। সব মিলিয়ে এমন আয়োজন নিশ্চিত করা দরকার, যাতে শিল্প স্থাপন বা ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে টাউট লোকজন ব্যাংক ঋণ না পেতে পারে এবং যাতে প্রকৃত শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা ঋণের অভাবে বাধাগ্রস্ত না হন। তাহলেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে আসতে পারে বলে আমরা মনে করি।
ষ লেখক : সভাপতি, ঢাকা মহানগর, এলডিপি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন