নবী (সা.) যখন নফল নামাজে দাঁড়াতেন তখন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ কিরাত পড়তেন। কখনও কখনও প্রথম রাকাতে সূরা বাকারা, দ্বিতীয় রাকাতে সূরা আল ইমরান, তৃতীয় রাকাতে সূরা নিসা এবং চতুর্থ রাকাতে সূরা মায়িদা পড়তেন। তিলাওয়াত করতেন তারতীলের সাথে। রহমতের আয়াত এলে থেমে রহমতের জন্য দোয়া করতেন, আযাব ও শাস্তির আয়াতে পৌঁছলে আযাব থেকে পানাহ চাইতেন। এভাবে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ফুলে যেত; কিন্তু তিনি নামাজের মধ্যে এমনভাবে মগ্ন হয়ে থাকতেন যে, সেদিকে তার কোনো খেয়ালই হত না। তদ্রূপ নামাজ পড়ায় ব্যঘাত সৃষ্টি হলে তিনি অস্থির হয়ে যেতেন।
মক্কার লোকদের সাড়া না পেয়ে অনেক আশা নিয়ে যখন নবী (সা.) তায়েফ গেলেন তখন তারা মক্কাবাসীদের চেয়েও অধিক নির্দয়তার পরিচয় দিলো এবং কুরায়েশদের চেয়েও বেশি নিষ্ঠুরতা দেখাল। নবীজি যখন ভগ্নহৃদয়ে ফিরে আসছিলেন, তখন তারা দুষ্কৃতকারী ও বদমাশদের লেলিয়ে দিলো। তারা পাথর ছুড়ে ছুড়ে নবীজির দেহ মুবারক রক্তাক্ত করে ফেলল।
সেই সঙ্গীন মুহূর্তেও দয়ার নবী তাদের জন্য কোনো বদদোয়া করেননি; বরং ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন এবং বলেছিলেন, এরা আমাকে চিনতে পারেনি, আমার দাওয়াত বুঝতে পারেনি। এদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমার ডাকে সাড়া দিবে, আমার দাওয়াত কবুল করবে। কিন্তু খন্দকের যুদ্ধে যখন তার আসরের নামাজ কাযা হয়ে গেল, কাফেররা তাকে সময়মতো নামাজ পড়তে দিলো না তখন তাঁর জবান মুবারক থেকে কঠিন বদদোয়া বের হয়ে এল। তিনি বললেন, ‘আল্লাহ এদের ঘরগুলো ও কবরগুলোকে আগুন দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিন।’ সূর্য ডুবে গেল অথচ এরা আমাদের সালাতুল উসতা (আসরের নামাজ) পড়তে দিলো না। (সহিহ বুখারী ১/৪১০)।
সাহাবীদেরও নামাজের সাথে ভালোবাসা ছিল অফুরন্ত। হজরত আবু বকর (রা.)-এর নামাজে দাঁড়ানো প্রসঙ্গে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) বর্ণনা করেন যে, তিনি যখন নামাজে দাঁড়াতেন, তখন এমন নিশ্চুপ ও নিশ্চল হয়ে থাকতেন, মনে হত, একটি কাঠ মাটিতে গেড়ে দেওয়া হয়েছে।
হজরত ওমর (রা.) কে যখন কুখ্যাত আবু লূলূ খঞ্জর দিয়ে আহত করে, তখন তিনি বারবার বেহুশ হয়ে পড়ছিলেন। এ অবস্থায় কেউ তাকে নামাজের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে তৎক্ষণাৎ নামাজ পড়ে নিলেন এবং বললেন, ‘আমি যদি নামাজ পড়তেই অক্ষম হয়ে যাই, তবে বেঁচে থেকে আর লাভ কী?
একবার এক বুযুর্গ উপস্থিত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসা করলেন, জান্নাতে কি নামাজ থাকবে? তাকে বলা হলো, জান্নাত তো প্রতিদানের স্থান। সেখানে তো নামাজ পড়তে হবে না। ওই বুযুর্গ একথা শুনে কাঁদতে আরম্ভ করলেন আর বলতে লাগলেন, তাহলে কীভাবে সেখানে থাকব? নবীজি তো বলেছেন, নামাজে আমার চোখে শীতলতা।
নবীজির সাহাবীরা তো নামাজবিহীন জীবনকে অনর্থক মনে করতেন। নামাজের মধ্যে সামান্য অমনোযোগিতার কারণে তারা লক্ষ টাকার বাগান সদকা করে দিতেন। কিন্তু হায়! আমরা তো এতই হতভাগা যে, চক্ষুর শীতলতা লাভ করা তো দূরের কথা, তারা যেমন প্রশান্তি লাভ করতেন, তার মর্ম উপলব্ধি করতেও আমরা অক্ষম। অন্তত তাদের বরকতময় ঘটনাগুলো পড়া ও স্মরণ করার দ্বারা দিলের মধ্যে যদি সামান্য উত্তাপ তৈরি হয় তাতেই বা কম কী?
শেষ কথা, উপরের আলোচনা থেকে কেউ যেন এ ভুল ধারণায় পতিত না হয় যে, আমরা যদি ওইভাবে নামাজ না পড়তে পারি, তাহলে আমাদের নামাজ হবে না। কিংবা পূর্ণাঙ্গভাবে আদায় হবে না। এ ধারণা ঠিক নয়; বরং নামাজের নিয়ত, তাকবির, কেরাত, রুকু, সেজদাসহ নামাজের সকল ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাতগুলো মাসায়িল মোতাবেক আদায় করলে নামাজ সহীহ হয়ে যাবে। এর পাশাপাশি নামাজের মধ্যে কখন কোন রোকন আদায় করা হচ্ছে এবং কী কী পড়া হচ্ছে, সেগুলোর দিকে খেয়াল রাখলে খুশু-খুযূ আদায় হবে।
সেই সাথে কারো যদি সারা জীবনও নামাজ পড়তে কষ্ট হতে থাকে আর সে নফসের সাথে জিহাদ করে নামাজ পড়তে থাকে, তাহলে সে এই কষ্টের জন্য অতিরিক্ত বিনিময় ও পুরস্কার লাভ করবে। অতএব, চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। হ্যাঁ, এই চেষ্টা অবশ্যই চালু রাখতে হবে, যেন আমার নামাজ উত্তরোত্তর সুন্দর হয়। আল্লাহতায়ালা যেভাবে নামাজে আদায় করলে সবচেয়ে খুশি ও সন্তুষ্ট হন, সেভাবে আমাদের নামাজ আদায় করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন