শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম

কুরআন বোঝার চেষ্টা কিছু নিয়মকানুন

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক | প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

কুরআন মজীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ হক হিফযে কুরআন। প্রত্যেকের যতটুকু সম্ভব হিফয করা, সন্তান-সন্ততি ও অধীনস্থদের হিফয করানো এবং সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে হিফযে কুরআনের প্রচলন ও ব্যবস্থা করা কুরআন মজীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হক। হাদিস শরীফে কুরআন শেখা ও শেখানোর যে তাকীদ আছে তার ওপর সাহাবায়ে কেরাম এভাবে আমল করেছেন যে, প্রথমে বারবার শুনে আয়াতটি মুখস্থ করেছেন এরপর তার মর্ম ও বিধান শিক্ষা করেছেন।

এখন আমাদের মধ্যে হাফেযের সংখ্যা কম নয়; তবুও তুলনা করলে দেখা যাবে, অধিকাংশ মানুষ হিফযে কুরআনের নেয়ামত থেকে বঞ্চিত। এর মৌলিক কারণ তিনটি : প্রথম কারণ তো ঈমানের কমজোরি ও কুরআনের প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসার অভাব। দ্বিতীয় কারণ এই ভুল ধারণা যে, হাফিয হওয়া শিশুদের কাজ। সুতরাং শৈশবে যদি অভিভাবকরা হিফযখানায় ভর্তি করেন তাহলেই শুধু হাফেয হওয়া যায়; অন্যথায় যায় না। তৃতীয় কারণ এই ভুল ধারণা যে, হয় পূর্ণ কুরআনের হাফেয হও, নতুবা কেবল এতটুকু মুখস্থ করো যে, কোনোমতে নামাযগুলো আদায় করা যায়। মাঝামাঝি কোনো ছুরত নেই।

আসলে হিফযের কোনো বয়স নেই। যে কোনো বয়সের মানুষ হিফযে কুরআনের নিয়ত করতে পারে এবং ধীরে ধীরে পূর্ণ কুরআনের হাফেযও হয়ে যেতে পারে। আর পুরা কুরআন হিফয করা সম্ভব না হলেও শুধু নামায আদায়ের পরিমাণে সন্তুষ্ট থাকা উচিত নয়; বরং যত বেশি সম্ভব হিফয করতে থাকাই হলো মুমিনের শান ও সৌভাগ্য। বরং ঈমানের দাবি তো এই যে, প্রত্যেক মুমিন নিজ নিজ পরিবারে এই নীতি নির্ধারণ করবে যে, আমরা জীবিকার প্রয়োজনে পরবর্তী জীবনে যে পেশাই গ্রহণ করি না কেন আমাদের সূচনা ও ভিত্তি হবে আল-কুরআন। ঈমান ও কুরআন শেখার পরই কেবল আমরা আমাদের সন্তানদের অন্য কোনো শিক্ষা প্রদান করব বা অন্য কোনো পেশায় নিয়োজিত করব।

হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. সূরা নিসার (৪) ৮২ নম্বর আয়াতের আলোচনায় লেখেন, ‘প্রতিটি মানুষ কুরআনের অর্থ ও মর্ম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করুক এটিই কুরআনের দাবি। সুতরাং একথা মনে করা ঠিক নয় যে, কুরআন মজীদের আয়াতসমূহে চিন্তা-ভাবনা করা শুধু ইমাম ও মুজতাহিদ (বা বড় বড় আলিমের) কাজ। অবশ্য জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পর্যায়ের মতোই চিন্তা-ভাবনারও বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। .....

সাধারণ মানুষ যখন নিজের ভাষায় কুরআন মজীদের তরজমা ও তাফসির পড়বে এবং চিন্তা-ভাবনা করবে তখন তাদের অন্তরে আল্লাহ তাআলার মহত্ত্ব ও ভালোবাসা এবং আখিরাতের ফিকির ও চিন্তা সৃষ্টি হবে। আর এটিই হচ্ছে সকল সফলতার চাবিকাঠি। তবে ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার জন্য সাধারণ মানুষের উচিত কোনো আলেমের কাছে অল্প অল্প করে পাঠ করা। এর সুযোগ না থাকলে কোনো নির্ভরযোগ্য তাফসিরের কিতাব পাঠ করবে এবং যেখানেই কোনো প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দেয় নিজের বিদ্যা-বুদ্ধি দ্বারা উত্তর না খুঁজে বিজ্ঞ আলেমের সাহায্য নিবে। (মাআরিফুল কুরআন ২/৪৮৮)।

কোনো কোনো বুযুর্গ মনে করেন যে, আরবী ভাষা ও দ্বীনের প্রাথমিক বিষয়াদির জ্ঞান অর্জন ছাড়া কুরআন মজীদের তরজমা পাঠ করা ক্ষতিকর এবং এ জন্য তা পরিহার করা উচিত। তাঁদের কথা একেবারে কারণহীন নয়। বর্তমানে তরজমা পাঠের বেশ প্রচলন আছে, কিন্তু যাকে বলে কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহণ সে সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ দেখা যায় না। অনেকটা কুরআনের অর্থ বোঝার গৌরব অর্জনের প্রচেষ্টাই দেখা যায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তো শরীয়তের বিধিবিধান নিয়ে গবেষণায় লিপ্ত হওয়ারও প্রবণতা দেখা যায়। বলাবাহুল্য, এতে কুরআন বোঝার স্থলে ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তির দ্বার উন্মুক্ত হয়।

এই বিপথগামিতার কারণেই ঐসব বুযুর্গ নিরুৎসাহিত করেছেন। তাই তাঁদের সম্পর্কে ভুল ধারণা করা উচিত নয়; বরং হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. (১২৮০ হি.-১৩৬২ হি.)-এর মতে, তাদের সম্পর্কেও সুধারণা রাখা জরুরি। হাকীমুল উম্মত রাহ. বলেন, ‘যে কাজে লাভের চেয়ে ক্ষতির দিক প্রবল সেক্ষেত্রে মূলনীতি হলো কাজটি যদি শরীয়তে ‘কাম্য ও করণীয়’ পর্যায়ের না হয় তাহলে মূল কাজটি নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। পক্ষান্তরে যদি ‘কাম্য ও করণীয়’ হয় তাহলে মূল কাজটি নিষিদ্ধ করা হয় না, ক্ষতির দিকগুলো বন্ধ করা হয়। এ জন্য যারা নিষেধ করেন তাদের খেদমতে এই মূলনীতি উপস্থাপন করে পরামর্শ দেয়া যায় যে, তারা যেন পাঠন-পঠনের অনুমতি দেন তবে সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা করেন।’ (ইমদাদুল ফাতাওয়া ৪/৮৪)।

মোটকথা, কুরআন-তরজমা পাঠ করতে গিয়ে কিছু মানুষ নিয়ম রক্ষা করে না ও বিপথগামিতার শিকার হয় বলে কুরআন বোঝার প্রচেষ্টাকেই নিষেধ করে দেয়া সমীচীন নয়। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত আলেমগণ যে বিভিন্ন ভাষায় তরজমা ও তাফসির লিখেছেন তা তো পঠন-পাঠনের জন্যই লিখেছেন। তাই সম্পূর্ণ নিষেধ না করে এমন বলা ভালো যে, তরজমা পাঠ করুন এবং কুরআন বোঝার চেষ্টা করুন। তবে তা যেন হয় সঠিক পন্থায়। অন্যথায় লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Ahmed Rubel ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:১৩ এএম says : 0
আলহামদুলিল্লাহ অসাধারণ এই লেখা। অনেক নতুন চিন্তার বিষয় পেলাম। কুরআন নিয়ে কেন ভাবব আর কিভাবে ভাবব সেই বিষয়ে সত্যি বলতে কোন জ্ঞানই ছিলো নাহ। আমাদের মত জেনারেল লাইনে পড়াশোনা করা মানুষদের জন্য কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করার নতুন পথনির্দেশিকা।
Total Reply(0)
MD. SHAHIDULLAH ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১০:৪১ এএম says : 0
কোরআন। একটি শব্দ যার মধ্যে লুকিয়ে আছে মুক্তির পরশ পাথর। যে পরশ পাথর আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা এর উপর দয়াময় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার এক অপরিসীম দয়ার দান। আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা এই পরশ পাথরের ছোঁয়ায় মাটির পৃথিবীতে জান্নাতি সমাজ গড়েছেন। যে কোরআন দিয়ে নবীজি সা মাটির পৃথিবী নূরের আলোয় আলোকিত করেছেন সে কোরআন নিয়ে তাদ্দাবুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন