জোবায়ের রাজু : দেয়ালে ঝুলন্ত পুত্রের ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছেন গোলাম মাওলা। পুত্র সবুজ কি দারুণ হাসিতে তাকিয়ে আছে ছবির ভেতর থেকে। সবুজ বেঁচে থাকলে আজ কতই না বড় হতো। এতদিনে তার একটি সংসারও থাকত নিশ্চয়। কিন্তু সে সুযোগ আর হলো কোথায়! ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সবুজ পাকিস্তানিদের বুলেটে জীবন দিয়েছে। এটা ভাবতে গেলে প্রতিবার গোলাম মাওলার চোখ ভিজে আসে। তিনি ভেজা চোখ মোছেন মন খারাপ করে।
স্বাধীনতার অনেক বছর পরে জন্ম হয় রিয়াজের। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে রিয়াজ সবার মুখে মুখে শুনে আসছে ভাইয়ার আত্মত্যাগের কথা। ভাইয়া নাকি খুব শৌখিন স্বভাবের ছিল! মাঠে ঘুড়ি উড়াত। বাড়ির আঙিনায় ফুলের গাছ লাগাত। ক্লাসের সেরা ছাত্রও ছিল। ছড়া লেখার অভ্যাস ছিল ভাইয়ার। আঞ্চলিক পত্রিকায় প্রায়ই নাকি ভাইয়ার ছড়া ছাপা হতো। স্বাধীনতার কয়েক মাস পর ভাইয়ার খাটে যে তোষক, সেটার তলা থেকে ভাইয়ার লেখা কয়েকটা ছড়া পাওয়া গেছে। একটা খাতার মধ্যে বেশ কয়েকটা ছড়া লিখে রেখেছে ভাইয়া। হয়তো কোন আঞ্চলিক পত্রিকায় পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু সে সুযোগ আর পেল না। তার আগেই দেশের জন্য পাকিস্তানিদের বিপক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নয় মাসের সেই যুদ্ধ শেষে অনেকে বাড়ি ফিরে আসে। আসে না কেবল ভাইয়া।
গোলাম মাওলা ছেলের প্রতীক্ষায় থাকেন। কখন সবুজ আসবে! সবুজের সাথে যারা যুদ্ধে গেছে, পারভেজ, আকরাম, নাসিরÑ একে একে সবাই স্বাধীনতার আনন্দ নিয়ে ফিরে আসে। শুধু ফিরে আসে না সবুজ। নাসির গোলাম মাওলাকে ডেকে কাঁদো কাঁদো গলায় বললÑ ‘আমাদের চোখের সামনে সবুজের বুকে বুলেট লেগেছিল। চেষ্টা করেও আমরা সবুজকে বাঁচাতে পারিনি।’
পুত্রের কথা শুনে গলা ফাটিয়ে কাঁদলেন। পাড়া-পড়শির সান্ত¦নায়ও সে কান্না থামল না গোলাম মাওলার। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অল্প দিনে সবুজের পরিচিতি বাড়ে।
অনেক বছর পর জন্ম হয় রিয়াজের। বড় হওয়ার পাশাপাশি সে জেনেছে তার না দেখা ভাই সবুজের গল্প। এ দেশে ১৯৭১ সালে নাকি যুদ্ধ হয়েছে। পাকিস্তানিরা হামলা দিয়েছে এদেশের নিরীহ মানুষের ওপর। তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাঙালি। সেই রুখে দাঁড়ানোর তালিকায় ছিল তার ভাই সবুজ।
দেয়ালে যে ছবিটা ঝুলছে সবুজ ভাইয়ার, সে ছবিটার দিকে তাকিয়ে সবুজ ভাইয়াকে কল্পনা করে রিয়াজ। প্রতিবার ডিসেম্বর এলে রিয়াজদের বাড়িতে মিডিয়া কর্মীরা ভিড় জমায়। টিভি চ্যানেলের লোক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার লোকও আসে সবুজের ওপর প্রতিবেদন করতে। বাবা কখনো ক্যামেরার সামনে বসে, আবার কখনো পত্রিকার লোকদেরকে সবুজ ভাইয়ার গল্প শোনান। কীভাবে সবুজ ভাইয়া যুদ্ধে গিয়েছিল, প্রতিবার এ গল্প বলতে বলতে বাবা একসময় কেঁদে ফেলেন। ছোট্ট রিয়াজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব দেখে।
এসব দেখতে দেখতে রিয়াজ মনে মনে ভাবেÑ ইস, ১৯৭১ সালে যদি সেও যুদ্ধে যেতে পারত। তবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তারও একটা গর্ব করার ব্যাপার থাকত। কিন্তু সে সময়ে যে তার জন্মই হয়নি!
এখন ডিসেম্বর মাস। গোলাম মাওলা সবুজের ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন। এমন সময় রিয়াজ এসে বাবাকে বললÑ ‘বাবা, টিভি চ্যানেল থেকে লোকেরা এসেছে। ঘরে ডাকব?’ গোলাম মাওলা চোখে হাইপাওয়ারের চমশা পরতে পরতে বললেনÑ ‘অবশ্যই ডাকবে। আজ আমি সবুজের শৈশব থেকে শুরু করে সব গল্প বলব।’
সবুজ ভাইয়ার শৈশবের সেসব গল্প কেমন ছিল, সেটা জানতে রিয়াজ এক দৌড়ে ছুটে গেল টিভি চ্যানেলের লোকদের কাছে। যারা লাইট ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত। বাবা আজ সে ক্যামেরার সামনে বসে সবুজ ভাইয়ার শৈশবের গল্প বলবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন