মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

নতুন বিশ্বব্যবস্থার চাবিকাঠি তুরস্ক

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

এটা প্রায়ই বলা হত যে, যুদ্ধে শেষপর্যন্ত কেউ জয়ী হয় না। কিন্তু এই প্রবাদটি তাদের জন্য সত্যি নয়, যারা বিরোধের সুবিধা নিয়ে তাদের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। উদাহরণস্বরূপ, চীন ইউক্রেন যুদ্ধের সুযোগে মস্কোর কাছ থেকে তেল এবং গ্যাস চুক্তিগুলি সুরক্ষিত করেছে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিজয়ী হিসেবে প্রমানিত হতে পারে তুরস্ক, যে একটি বড় বৈশ্বিক খাদ্য সঙ্কট এড়াতে ইতিমধ্যেই লাখ লাখ টন ইউক্রেনীয় শস্য রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার জন্য ক্রেমলিনের সাথে মধ্যস্থতা চুক্তি করে একটি নিরপেক্ষ আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে তার ক্ষমতা প্রমাণ করেছে। এখানেই শেষ নয়, তুরস্কের হাতে আরও কিছু আছে, যা একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটাতে পারে।

তুরস্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে বসে আছে। এর একটি অংশ ইউরোপে এবং অন্যটি এশিয়ায়। দেশটি কৃষ্ণ সাগরের প্রবেশদ্বার বসফরাসকে নিয়ন্ত্রণ করে। তুরস্ক মধ্য এশিয়া থেকে আসা তেল ও গ্যাস পাইপলাইনগুলির উপরে বসে আছে, যার মাধ্যমে এটি রাশিয়ার গ্যাস ছাড়াই আসন্ন শীতে ইউরোপের ত্রাণকর্তা হয়ে উঠতে পারে। তুরস্ক বিশে^র অন্যতম প্রধান খাদ্য রপ্তানিকারক, ন্যাটোর সদস্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে থেকেও ইইউ কাস্টমস ইউনিয়নের অংশ। দেশটি তার শিল্প খাতের বিকাশকে ত্বরান্বিত করার জন্য কৃতিত্ব লাভ করেছে কারণ ইউরোপীয় নির্মাতারা শুল্ক এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে বেঁচে উৎপাদন খরচ কমাতে চায়।

ইউরোপের সাথে তুরস্কে হাতে দরকষাকষির জন্য শরণার্থী কৌশলও আছে। আফ্রিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের লাখ লাখ অভিবাসীর জন্য তুরস্ক ইউরোপের প্রবেশদ্বার। শেষবার, আঙ্কারা ২০১৫ সালে শরণার্থীদের জন্য তার সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়ায় সমগ্র ইউরোপ জুড়ে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। আশঙ্কা ছড়িয়েছিল যে, একটি শরণার্থী সঙ্কট ইইউকে ধ্বংস করে দিতে পারে। ফলস্বরূপ, ইইউ তুরস্ককে তার সীমান্ত বন্ধ করতে এবং ইউরোপে অভিবাসীদের ঢল বন্ধ করতে বিলিয়ন ইউরো দেয়।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেপ এরদোগান দেখিয়েছেন যে, তিনি একজন কঠোর চুক্তি-নির্মাতা, যিনি তার দেশের ঐতিহ্যগত স্বার্থ রক্ষায় করতে আগ্রহী। এবং তিনি একই সাথে মস্কো এবং পশ্চিমা বিশ্ব উভয়কেই খুশি না করতে না পারলেও, তাদেরকে হতাশভাবে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এভাবে এরদোগান ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীকে বায়রাক্তার ড্রোন সরবরাহ করছেন এবং রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজকে বসফরাস দিয়ে যাত্রা করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেও সোচিতে ভøাদিমির পুতিনের সাথে সাক্ষাতে সফল হয়েছেন।

সোচির ক্ষুদ্র বৈঠকের সবচেয়ে দৃশ্যমান ফলাফল হ’ল, ইউক্রেনীয় শস্য পাঠানোর চুক্তি। এটি একটি জনসংযোগ অভ্যুত্থান, যা রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সর্বোত্তম স্বার্থে কাজ করে বলে উপস্থাপন করে। তবে তাদের বাকি আলোচনার আসল বিষয় নি:সন্দেহে তেল এবং গ্যাস, যা আগামী শীতের মাসগুলিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে এরদোগানের সর্বোচ্চ সুবিধাজনক সময় এনে দেবে।

মস্কো এবং ইউরোপের বৃহৎ শিল্প অর্থনীতি যেগুলি সস্তা রাশিয়ান তেলের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে, উভয়ই এক জিনিসের জন্য আগ্রহী: জ¦ালানী পাইপলাইনের নেটওয়ার্কের সুবিধা, যা মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া এবং প্রকৃতপক্ষে, ভূমধ্যসাগরের সাথে রাশিয়ার তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রগুলিকে সংযুক্ত করে। আজারবাইজান, ইরান এবং অন্য জায়গা থেকে তুরস্কের মধ্য দিয়ে আসা মূল্যবান জ্বালানীর পাশাপাশি রাশিয়ান তেল ও গ্যাস অবাধে প্রবাহিত হওয়ার জন্য পুতিন আকর্ষণীয় সুযোগ প্রদান করবেন। তিনি তুরস্কের তেল সুবিধাগুলিকে ইউরোপের ক্ষতিকারক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার একটি উপায় হিসাবে দেখবেন এবং কার্যকরভাবে তার দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় উৎসকে আয়ত্ত করতে পারবেন।

এদিকে, উত্তর ইউরোপের মধ্য দিয়ে রাশিয়ান গ্যাস পাইপলাইনের উপর এর অত্যধিক নির্ভরতা এবং এই গ্রীষ্মে ইউরোপ ব্যাপী খরা জলবিদ্যুৎ শক্তির মতো উৎপাদনের বিকল্প উপায়গুলিকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে এবং জ¦ালানীশক্তি সঞ্চয়ের গুরুতর ঘাটতি সহ অনেক দেশকে চরম বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সেকারণে, মহাদেশটি আসন্ন শীতে তার আলো নিভে যাওয়া বন্ধ করতে একটি দক্ষিণের তেল পথের জন্য মরিয়া। যদিও ইইউ পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সাইপ্রাস এবং এজিয়ান সাগরে গ্রিসের সাথে সামুদ্রিক বিরোধ নিয়ে তুরস্ককে নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু এটি নিজের স্বার্থেই তুরস্কের হাতে অঞ্চলটির সমুদ্র সম্পদ উত্তোলনের অধিকার তুলে দিয়েছে।

তেল ও গ্যাস পাইপলাইন নিয়ে ইউরোপের সঙ্গে যে কোনো আলোচনা তুরস্ককে একটি নতুন বিশ^ব্যবস্থার অন্যতম গূরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত করতে পারে। এবং এরদোগান বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক শক্তিচিত্রটি পুনরুদ্ধার করার জন্য অবশ্যই এই শীতকালকে মোক্ষম সুযোগ হিসাবে দেখবেন। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, অংশ তুরস্ক পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সেতু হিসেবে, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের ইউরোপীয় অংশীদার হিসেবে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতি এবং ন্যাটোর একটি চাবিকাঠি হিসেবে ওয়াশিংটন, মস্কো এবং বেইজিংয়ের টেবিলে একটি আসন লাভ করবে।

এরদোগান সদ্য আবিষ্কৃত পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় গ্যাসক্ষেত্রের বিশাল আর্থিক প্রণোদনাকে তুর্কি পরিচালিত উত্তর সাইপ্রাসের আন্তর্জাতিক মর্যাদা মীমাংসার উপায় হিসেবেও দেখবেন, যেটিকে বর্তমানে শুধুমাত্র তুরস্কই একটি বৈধ দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং আঙ্কারার পক্ষে সমুদ্রসীমা সমর্থন করে। এই সাফল্যগুলি অবশেষে তুরস্ককে অটোমান সাম্রাজ্যের পর প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক গুরুত্বের স্তরে ফিরিয়ে আনবে। এটি পশ্চিমের রাজনৈতিক ও শিল্প শক্তিগুলির কাছে এই শক্তিশালী সংকেত পাঠাবে যে, চাপসৃষ্টি বা ভয় দেখানোর পরিবর্তে আঙ্কারার সাথে আলোচনাই সবপক্ষের জন্য একমাত্র লাভজনক উপায়। সূত্র : ডেইলি মেইল।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন