বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

ইভিএম-এ ভোট কেন?

ড. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল | প্রকাশের সময় : ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল হুদা নির্বাচন কমিশন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫০ একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা। এ সংখ্যায় সরকার গঠনের কাছাকাছি চলে যাওয়া যায়। আর আমরা তো বরাবরই দেখে আসছি, সংখ্যাগরিষ্ঠতার কি ভীষণ দাপট এদেশে। যেখানে এমনকি ১৪৯ও পুরোপুরি মূল্যহীন। ১৫১ পুরো দেশটারই মৌরসিপাট্টা দিয়ে দেয় একটা দলকে পুরো পাঁচ বছরের জন্য। আমাদের নির্বাচন কমিশনগুলোর অতীত ঐতিহ্য খুব একটা গৌরবোজ্জ্বল না, রকিবুল হুদা কমিশনের সাথে জড়িয়ে আছে বিনা ভোটে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ গঠনের লজ্জা। নুরুল হুদা কমিশন বিখ্যাত হয়েছে নৈশ ভোটের মতন এক অভূতপূর্ব নির্বাচন পদ্ধতির প্রবর্তনের অভিযোগে, যা বিশ্বের কোনো নির্বাচনী অভিধানে নেই। এর আগে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচন কমিশন আপাত সুষ্ঠু নির্বাচন করেছে বটে, তবে সেই নির্বাচনে বিএনপি’র অস্বাভাবিক কম আসন প্রাপ্তি আর ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সত্যাশ্রয়ী আত্মকথন- এসব মিলিয়ে সেই নির্বাচনের কোনো নির্মোহ বিশ্লেষণ আজও হয়নি।

এর আগে আজিজ কমিশন ভুয়া ভোটার(!) অন্তর্ভুক্তির অভিযোগে দুষ্ট। রউফ কমিশনের গায়ে কালিমার দাগ কম থাকলেও মাগুরা তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। অবশ্য এরা দুজনের কেউই তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ তেমনটা পাননি বা নেননি। আমাদের বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার আর কমিশনের অন্য সদস্যদের বয়স যেরকম, তাতে তাদের সবারই তাদের তরুণ বয়সে দেখা নির্বাচনী ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা থাকবার কথা। সেকালে আমাদের দেশে নির্বাচন সবসময় উৎসবমুখর ছিল। নির্বাচনের প্রার্থিতা চূড়ান্ত হবার পর প্রার্থীর সমর্থকদের রাত জেগে মাইকে প্রচারণা, অমুক মার্কায় ভোট চাই! একদিকে রাত জেগে পোস্টার লাগাবেন আবার দিনশেষে নির্বাচনী অফিসে জড়ো হবেন চা-বিস্কিট, বিড়ি- সিগারেট, মুড়ি সহযোগে পরিতৃপ্ত দীনহীন আপ্যায়নের বিলাসিতায়। মুখোমুখি মিছিল হবে কিন্তু কোনো সংঘাত নয়। ভোটের দিনে গৃহিনীরা সকাল সকাল বাড়ির সবগুলো কাজ শেষ করে নতুন শাড়ি পরে মুখে পান গুঁজে যাবেন ভোট কেন্দ্রে। নিজের পরিচিতি প্রমাণ করে ব্যালট হাতে ঢুকবেন গোপন বুথে। তারপর ভালো করে প্রার্থীর নাম আর প্রতীক দেখে নিজের পছন্দের প্রার্থীর প্রতীকের পাশে সিল দেবেন। আর সবশেষে ব্যালট পেপার ভাঁজ করে মাথা উঁচু করে ব্যালট বাক্সের ভিতরে ব্যালট পেপার ঢুকিয়ে সগর্বে নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসবেন।

আবার দিন শেষে আলো-আঁধারিতে ভোট গণনা শুরু হবে, মিনিটে মিনিটে সত্য-মিথ্যা মেশানো গুজব আসবে বাইরে, অমুক প্রার্থী এগিয়ে, তমুকে পেছনে। ভোট গণনা শেষ হতেই প্রিসাইডিং অফিসার সবার সামনে ব্যালট গুনে এজেন্টের স্বাক্ষর নিয়ে কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করবেন। আর রিটার্নিং অফিসার সবকিছু হিসেব-নিকেশ করে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করবেন। বিজয়ীরা বিজয় মিছিল করবে বাধাহীন, আর পরাজিতরা মেনে নেবে। এই নির্বাচনী সংস্কৃতির সাথে তো বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের অপরিচিত থাকার কথা নয়।

এমনকি ১৯৭০-এর নির্বাচনের কথাই ধরুন, যার ফলে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, সে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য হয়েছে এই অপবাদ কেউ দিতে পারবে না। ঐ নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে আর ফলাফল এদেশের মানুষের পক্ষে না এলে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের যৌক্তিকতা আন্তর্জাতিকভাবে কি এতটা যুক্তিগ্রাহ্য করা যেত? আমেরিকার কথাই ধরুন না কেন, প্রযুক্তিতে নিশ্চয়ই দেশটি আমাদের থেকে পিছিয়ে নেই। কিন্তু তার তো কাগজের ব্যালটের রোমাঞ্চ আজও হারিয়ে যায়নি। সেজন্যই সেখানে প্রসিডেন্ট নির্বাচনে এখনও ফিলাডেলফিয়ায় দিন-রাত ধরে ভোট গণনা হয়। গত নির্বাচনে বাইডেন ও ট্রাম্পের নির্বাচনী ভাগ্য ঝুলতে থাকে ফিলাডেলফিয়ার ভোটারদের পছন্দের সুতোয়। কিন্তু প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে আমেরিকানরা তো সেই পদ্ধতিকে অস্বীকার করছে না। তাহলে আমাদের সেই প্রতিষ্ঠিত নির্বাচনী ঐতিহ্যকে পরিবর্তন করবার এত তাড়া কেন? বলা হচ্ছে, কমিশন কারো দ্বারা প্রভাবিত নয়, সম্পূর্ণ নিজের বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

নির্বাচন তো একটা খেলা আর এখনই চারদিকে ‘খেলা হবে’ ‘খেলা হবে’ রব। তাহলে সে খেলাতে অনেক দল থাকবে সেটাই প্রত্যাশিত। প্রায় সব দলই যখন বলল যে, তারা ইভিএমে খেলবে না, আর একটা দল বললো তারা ইভিএম-এ খেলবে। আর কমিশন সেই একটা দলের পছন্দের পক্ষে গেল। এটা কি বিশেষ ওই দলের পক্ষে পক্ষপাতিত্ব নয়? প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে সেদিন সাংবাদিক সম্মেলনে, সহজাত চিরচেনা সপ্রতিভ মনে হয়নি। তাঁর অভিব্যক্তি, তার চিরায়ত শ্রুতিমধুর শব্দচয়ন আর স্বতঃস্ফূর্ত বাক্য বিন্যাসের অনুপস্থিতি নজর কেড়েছে। চোখে চোখ রেখে কথা বলবার অনুপস্থিতিও ছিল মাঝে মাঝে। আমাদের কাছে কেন জানি মনে হচ্ছিল, তিনি তার স্বকীয়তার জায়গায় নেই। তাঁকে প্রবল সমর্থন করা ডা. জাফরুল্লাহ সাহেবও যখন একই দিনে বলেন, ইভিএম নিয়ে কমিশন সরকারের চাপে আছে, তখন এমন মনে হতেই পারে। ইভিএম কতটা আধুনিক কতটা প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, কথা হলো নির্বাচনী মাঠে যাঁরা খেলতে চান, তারা একটা প্রতিষ্ঠিত নিরপেক্ষ নিয়মের পক্ষে। এখন যদি কমিশন নতুন কিছু চাপিয়ে দিতে চায় তাহলে প্রকারান্তরে এটাই প্রমাণ হয় যে, খেলাটায় ওয়াক ওভার হোক এটাই কমিশনের চাওয়া।

কমিশনের সদস্যরা বলেন, ইভিএম’র ত্রুটি কেউ ধরিয়ে দিতে পারেনি। একটা অর্বাচীন প্রশ্ন করি, আমাদের চোখের সামনে ম্যাজিশিয়ানরা ম্যাজিক দেখান, চোখের পলকে ১০০ টাকার নোটকে ১০০০ টাকা বানিয়ে ফেলেন, আস্ত তলোয়ার গিলে ফেলেন, সুন্দরী তরুণীকে দ্বিখণ্ডিত করেন, আবার জোড়াও দেন। আমরা সবাই জানি এগুলো ম্যাজিক এবং একদম সত্যি নয়। কিন্তু সেটাকে আমরা সবসময় প্রমাণ কি করতে পারি? আমরা তো সবাই ম্যাজিশিয়ান নই যে, কারসাজি ধরতে পারবো। আমার যদি সন্দেহ হয় যে, ইভিএম’র ভেতরে ম্যাজিকের ছলচাতুরি আছে তাহলে আমাকে জোর করে ম্যাজিকটা দেখাতে চান কেন? কাগজের ব্যালটে সমস্যা কোথায়? ধরা যাক, একজন সংক্ষুব্ধ প্রার্থী যদি অল্প ব্যবধানে হেরে যান আর একটা একটা করে ব্যালট পুনর্গণনার যৌক্তিক দাবি উত্থাপন করেন,তাহলে কমিশন সেটির সমাধান করবে কী করে?

আমরা তো দেখি, ব্যাংকে টাকা গোনার মেশিনে বার বার টাকা গোনার পরেও ক্যাশিয়ার শেষতক নিজের হাতে টাকা গুনে নিশ্চিত হন। সেটা কি শুধু মেশিনে আস্থা নেই বলে? তা নয়, এটি আমাদের চিরায়ত একটা সংস্কার। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং কমিশনের অন্য সদস্যরা তারা তো এই সমাজেরই মানুষ, তাই না? মেয়াদের পাঁচ বছর পূর্ণ হবার পরে তারা তো আবার মিশে যাবেন সাধারণ্যে- জনারণ্যে। সে সময়ের কথা না হয় বাদই দিলাম, আজও খাবার টেবিলে তাদের সন্তান সন্ততি, প্রিয়জনের সাথে যখন বসেন তখন ঠিক আগের মতন সেই স্বস্তি নিয়ে কথা বলতে পারেন কি? উত্তরে কোনো জায়গায় যদি কখনো অস্বস্তি থাকে তাহলে সে দায় নেবার দরকার কি তাদের। পৃথিবীতে মানুষ তো বাঁচে মাত্র সামান্য ক’দিন, আর তারপর বেঁচে থাকে অনন্তকাল তার কর্মের জন্য, অবদানের জন্য। এই সমাজে মীরজাফরের উত্তরসূরীরা যেমন আছে, তেমনি আছেন সিরাজদৌলার পরবর্তী প্রজন্ম। মীরজাফরদের বংশধরেরা আজও লজ্জায় মাথা নত করে চলাফেরা করে এ সমাজে। অন্যদিকে সিরাজের উত্তরসূরীরা গর্বের সাথে মাথা উঁচিয়ে বিচরণ করে।

লেখক: সাবেক অধ্যাপক, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন