দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, দেশের রাজনীতির অঙ্গনে উত্তাপ ততই বাড়ছে। নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হবে, নাকি দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হবে, রাজনৈতিক দলগুলোর মূল বিতর্ক এই প্রশ্নটা ঘিরেই। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের চিন্তাভাবনা আবর্তিত হচ্ছে আগামী নির্বাচনে অন্তত অর্ধেক তথা ১৫০টি আসনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-এ করা নিয়ে। এসব বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার পাশাপাশি নির্বাচনী প্রস্তুতি সংক্রান্ত অন্যান্য রুটিন ওয়ার্কও চলছে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ একজন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) গণমাধ্যমকে বলেছেন, জাতীয় সংসদের আসন সীমানা পুননির্ধারণ করা হবে। এ ব্যাপারে ঘরোয়া কাজ শুরু হয়ে গেছে। কোথায় কয়টা আসন, কত ভোটার সংখ্যা ইত্যাদি ডাটা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ জন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর কাছে জনসংখ্যার প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যান দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। জনসংখ্যার প্রতিবেদন পেলে সীমানা পুননির্ধারণ হবে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেছেন, বর্তমানে ঢাকায় যেখানে ২০টি সংসদীয় আসন রয়েছে, জনসংখ্যা বাড়লে সেখানে আসন সংখ্যা আরো বাড়তে পারে, আবার জনসংখ্যা কমলে আসন সংখ্যা কমতেও পারে।
সংবাদটি পড়ার পর বিষয়টি নিয়ে একটু বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলাম। জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসন সারাদেশে আসলে কীভাবে বণ্টিত হয়, কিসের ভিত্তিতে বণ্টিত হয়, জনসংখ্যা এবং এলাকার আয়তন কতটা গুরুত্ব পায়, সেসব বিষয় নিয়েও অনুসন্ধান করার চেষ্টা করলাম। ইতিপূর্বে যেভাবে জাতীয় সংসদের আসন সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে মনে হলো, জনসংখ্যা তথা ভোটার সংখ্যাকেই প্রাধান্য দিয়ে বিবেচনা করা হয়েছে। আরো একটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়েছে, সেটি হলো সিটি বা পৌর এলাকার ওয়ার্ড এবং অন্যান্য এলাকার ক্ষেত্রে উপজেলার অখণ্ডতা যেন ঠিক থাকে, যদিও সকল ক্ষেত্রে এগুলো ঠিক রাখা সম্ভব হয়নি। এ কারণে কোনো কোনো সংসদীয় আসন এলাকার সীমানা নির্ধারণ নিয়ে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে ক্ষোভ, তিক্ততা, অভিযোগও আছে।
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ বা পুননির্ধারণ নির্বাচন কমিশনের একটি রুটিন কাজ। ইতিপূর্বে একটি অর্ডিন্যান্সের ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশন এই কাজটি করত। গত বছর সরকার এ ব্যাপারে ইসির ক্ষমতা আরো বাড়িয়ে জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইন-২০২১ করে দিয়েছে। এর ফলে নির্বিঘ্নভাবে প্রতিটি সংসদ নির্বাচনের পূর্বে সংসদীয় আসনের এলাকা পুননির্ধারণ করতে পারবে কমিশন, আবার চাইলে বিদ্যমান সীমানা ঠিক রেখেও নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে। এর জন্য কমিশনকে কোনো আদালত বা অন্য কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রসঙ্গটি বিবেচনায় নিয়ে কিছু আসনের সীমানা পুননির্ধারণ করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তগুলো বিশ্লেষণ করা হবে। আর সেটা করা হলে প্রতি সংসদীয় আসনে গড়ে ৫ লাখ ৫০ হাজার বা তার কিছু কমবেশি লোকসংখ্যা হওয়ার কথা।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় কোন আসনের লোকসংখ্যা কত ছিল, সেটা জানার চেষ্টা করেও সফল হতে পারিনি। তবে কোন আসনে কত ভোটার ছিলো সেটার তালিকা পেয়েছি। যেহেতু সংসদ সদস্যদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটাররা, সেহেতু এই ভোটাদের সংখ্যাটি জনসংখ্যার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা। তাই সেটিই ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করেছি। এটি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে বেশ অবাক হয়েছি। কারণ, ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন মতে, আমার নিজ জেলা রাঙ্গামাটির জনসংখ্যার ঘনত্ব সবচেয়ে কম, প্রতি বর্গ কিলোমিটারে এ জেলায় বসবাস করে মাত্র ১০৬ জন মানুষ, পাশের জেলা বান্দরবানে ১০৭ জন এবং খাগড়াছড়িতে ২৬০ জন। সারাদেশের তুলনায় এই তিন জেলার জনসংখ্যার ঘনত্ব খুবই কম। সেই হিসাবে ধারণা ছিল, এই তিন জেলার সংসদীয় আসনগুলোতে ভোটার সংখ্যাও নিশ্চয়ই সারাদেশের তুলনায় সবচেয়ে কম হবে। কিন্তু ব্যাপারটি আসলে তা নয়।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে পার্বত্য খাগড়াছড়ি আসনে ভোটার ছিল ৪৪১৭৪৩, রাঙ্গামাটিতে ৪১৮২১৫ এবং বান্দরবানে ২৪৬৬৫৩ জন। পার্বত্য তিন জেলায় তিনটি সংসদীয় আসনের মধ্যে বান্দরবানের ভোটার ছিল কম। সে সময় দেশে সবচেয়ে কম ভোটার ছিল ঝালকাঠী-১ (রাজাপুর-কাঠালিয়া) আসনে ১৭৮৭৮৫ জন, যা বান্দরবানের চেয়ে প্রায় ৭০ হাজার কম। শুধু কি তাই? যে ঢাকায় দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ বসবাস করে এবং ঢাকা-১৯ আসনে যখন সবচেয়ে বেশি (৭৪৭৩০১ জন) ভোটার ছিল, সেই ঢাকাতেই একই সময়ে একটি আসনে (ঢাকা-৪ আসনে ২৪৫৯০৮ জন) বান্দরবানের চেয়ে ভোটার সংখ্যা কম ছিল। একইভাবে খুলনা-৩ আসনে ভোটার ছিল ২২৬৩০২, ময়মনসিংহ-৩ আসনে ২৩৪৫৮৮ এবং চট্টগ্রাম-৩ আসনে ২০২৬২৫ জন, যা বান্দরবান আসনের ভোটার থেকে কম। পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, সারাদেশে ২৪টি সংসদীয় আসনে বান্দরবানের চেয়ে ভোটার কম ছিল। আরো অবাক করার কথা হলো, খাগড়াছড়ি আসনের চেয়ে দেশের ২৭৪টি আসনের ভোটার সংখ্যা কম ছিল।
পার্বত্য তিন জেলার মোট আয়তন দেশের একদশমাংশের চেয়ে বেশি। আয়তন অনুযায়ী যদি সংসদীয় আসন বণ্টিত হতো তাহলে এই তিন জেলায় আসন হওয়ার কথা অন্তত ৩০টি। এক্ষেত্রে যেহেতু আয়তন নয় বরং জনসংখ্যা বা ভোটার সংখ্যাই প্রধান বিবেচ্য, তাই সেটা প্রত্যাশা করাও ঠিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সারাদেশে কি শুধু জনসংখ্যা বা ভোটার সংখ্যাকে সমানভাবে গুরুত্ব দেয়া সম্ভব হচ্ছে? সেটি হলে কি ঝালকাঠী-১ এবং ঢাকা-১৯ আসনের ভোটার সংখ্যার মধ্যে এত বিরাট ব্যবধান হতে পারতো? ঢাকা-১৯ আসন এবং ঢাকা-৪ আসনের ভোটার সংখ্যার ব্যবধানটাই-বা এত বেশি কী করে হতে পারতো? আসলেই সেটি পারতো না। তাহলে এটা বুঝাই যাচ্ছে যে, শুধু জনসংখ্যা বা ভোটার সংখ্যা নয়, এখানে আরো কিছু বিবেচ্য বিষয় আছে। যে বিষয়গুলো দেশের অন্যান্য স্থানে যেভাবে গুরুত্ব পেয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে হয়তো সেভাবে পায়নি। যে কারণে সেখানে তিন জেলার জন্য মাত্র তিনটি সংসদীয় আসন নির্ধারণ করা আছে, যেটা আসলে কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত বলে মনে হচ্ছে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সংসদীয় আসন সংখ্যা ন্যায়সঙ্গতভাবে নির্ধারিত হয়নি এটি বলার কারণ হচ্ছে, রাঙ্গামাটি জেলায় ৫০টি ইউনিয়ন আছে, সেখানে সাজেক ইউনিয়নের আয়তন রাজধানী ঢাকার চেয়ে বেশি! আবার রাঙ্গামাটির একটি ইউনিয়নের আয়তনের চেয়েও কম আয়তনের ঢাকায় ২০টি আসন, আর সেখানে পুরো রাঙ্গামাটির ৫০টি ইউনিয়ন নিয়ে মাত্র একটি আসন! এবার দুর্গমতার কথা যদি চিন্তা করা যায়, তাহলে বলতে হয় রাঙ্গামাটির সর্ব উত্তরে রয়েছে সাজেক ইউনিয়ন, যেখানে রাঙ্গামাটি সদর থেকে সরাসরি যাওয়া বেশ কঠিন, সেকারণে সাজেকে যেতে হয় খাগড়াছড়ি হয়ে। অন্যদিকে এ জেলার সর্ব দক্ষিণের ফারুয়া ইউনিয়নেও রাঙ্গামাটি সদর থেকে সরাসরি যাওয়ার কোনো সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই, সে কারণেই সেখানে যেতে হয় বান্দরবান হয়ে। একইভাবে খাগড়াছড়ির ক্ষেত্রে যদি রামগড় থেকে দীঘিনালার শেষ প্রান্তের দূরত্বের কথা চিন্তা করা যায় কিংবা বান্দরবানের রাঙ্গামাটি সীমান্ত থেকে আলীকদম কিংবা নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত পর্যন্ত দূরত্বের কথা চিন্তা করা যায়, যেখানে বান্দরবান সদর থেকে লামা, আলীকদম এবং নাইক্ষ্যংছড়িতে যেতে হয় কক্সবাজার হয়ে, তাহলে কিছুটা হলেও উপলব্ধি হওয়ার কথা। যারা এই অঞ্চলের ভূগোল সম্পর্কে জানেন, তারা এটা সহজেই বুঝার কথা।
আরেকটু এগিয়ে যদি চিন্তা করা যায় যে, ঢাকার কোনো আসনের একজন সংসদ সদস্য প্রার্থী তার নির্বাচনী এলাকা চাইলেই কয়েক ঘণ্টায় একবার ঘুরে আসতে পারেন, কোন এলাকার জনগণের কী কী সমস্যা আছে সেসবের খোঁজ-খবরও নিতে পারেন। কিন্তু রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি বা বান্দরবানের সংসদ সদস্যের কী অবস্থা। ঢাকার আসনগুলোর গড় আয়তন প্রায় ৭৩.১৭৫ বর্গ কিলোমিটার, সেখানে রাঙ্গামাটি সংসদীয় আসনের আয়তন ৬১১৬.১৩ বর্গ কিলোমিটার, যা ঢাকার সংসদীয় আসনের গড় আয়তনের প্রায় ৮৪ গুণ বড়! তাছাড়া পাহাড়ের অনেক জায়গায়তো যোগাযোগের সহজ কোনো ব্যবস্থাই নেই, সেকারণে হেলিকপ্টারে ভোটের সরঞ্জাম নিয়ে যেতে হয়। তাহলে সেসব এলাকার মানুষের সাথে সংসদ সদস্য প্রার্থীদের যোগাযোগটা কতটা সম্ভব এবং কীভাবে সম্ভব? আসলে নির্বাচন কমিশনকে এই বিষয়টি ভাবনায় নিতে হবে এবং পার্বত্য তিন জেলায় সংসদীয় আসন সংখ্যা ন্যায়সঙ্গতভাবে বাড়াতে হবে। বিপুল আয়তনের পাশাপাশি দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়াও যদি ঝালকাঠী-১ আসনের ভোটার সংখ্যাটিও বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলেও বলা যায়, খাগড়াছড়িতে অন্তত ৩টি, রাঙ্গামাটিতে ৩টি এবং বান্দরবানে ২টি সংসদীয় আসন অনায়াসেই করা যায়। এক্ষেত্রে খাগড়াছড়িতে রামগড়, লক্ষ্মীছড়ি, মানিকছড়ি, গুইমারা নিয়ে একটি আসন; মাটিরাঙ্গা, মহালছড়ি, পানছড়ি নিয়ে একটি আসন এবং খাগড়াছড়ি সদর ও দীঘিনালা নিয়ে একটি আসন হতে পারে। রাঙ্গামাটিতে বাঘাইছড়ি, লংগদু, বরকল নিয়ে একটি আসন; জুড়াছড়ি, বিলাইছড়ি, রাজস্থলী, কাপ্তাই নিয়ে একটি আসন এবং রাঙ্গামাটি সদর, নানিয়ারচর, কাউখালী নিয়ে একটি আসন হতে পারে। বান্দরবানে সদর উপজেলা, রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি নিয়ে একটি আসন এবং লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি নিয়ে একটি আসন হতে পারে।
আরো একটি বিষয় এখানে বিবেচনায় নেয়া যায়, সেটি হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিসহ ১৪/১৫টি জনগোষ্ঠির মানুষ বসবাস করে। বাঙালিরা এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তিন জেলাতে মাত্র একটি করে আসন থাকায় সেখানে জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক দলগুলো বাঙালিদের নমিনেশন দেয়ার ব্যাপারে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিগুলোর মধ্যে বৃহৎ জনগোষ্ঠি হিসেবে চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরাদের মধ্য থেকেই প্রার্থী দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। আর আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে এককভাবে প্রাধান্য রয়েছে চাকমাদের। এসব জনগোষ্ঠির প্রার্থীরা যতটা নিরপেক্ষই হোন না কেন, নিজ নিজ গোত্রে মানুষের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই তাদের একটা আলাদা দৃষ্টি থাকে। তাছাড়া বড় জনগোষ্ঠিগুলো সাধারণত ছোট জনগোষ্ঠিগুলোকে নিজেদের অধীনে রাখতে চেষ্টা করে। ফলে সংসদ সদস্য চাইলেও অনেক সময় এই গণ্ডি পার হয়ে সমানভাবে সকলের প্রতি দৃষ্টি দেয়া সম্ভব হয় না। দীর্ঘদিন ধরে একই অবস্থা চলমান থাকায় বাঙালি এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এর বহিঃপ্রকাশ মাঝে মধ্যে নানা আঙ্গিকে ঘটতেও দেখা যায়। যার সর্বশেষ উদাহরণ হতে পারে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে সাম্প্রতিক সময়ে জন্ম নেয়া একটি সংগঠন। যেটি ইতোমধ্যে বান্দরবান এবং রাঙ্গামাটির সীমান্ত এলাকায় নতুন করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছয়টি জনগোষ্ঠির মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করেছে। যদি পাহাড়ের তিন জেলায় অন্তত ৮টি সংসদীয় আসন থাকতো, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে বাঙালিসহ ছোট ছোট জনগোষ্ঠিগুলো থেকেও প্রার্থী দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতো। এতে ওইসব জনগোষ্ঠির মানুষের মধ্যে নেতৃত্ব দেয়ার যেমন সুযোগ বাড়তো, তেমনি অন্যদের সাথে একই টেবিলে বসে নিজেদের অভাব-অভিযোগের কথা বলে ক্ষোভ প্রশমনেরও সুযোগ সৃষ্টি হতো। কিন্তু সেটি হচ্ছে না বলেই পাহাড়ের মানুষের মধ্যে অবিশ^াস, ক্ষোভ বাড়ছে। বাড়ছে অশান্তিও। সেকারণে আগে থেকেই বিদ্যমান পাঁচটি সশস্ত্র গোষ্ঠি থাকার পরও কেএনএফ’র মতো নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠির সৃষ্টি হচ্ছে এবং আগামীতে এমন আরো যে হবে না, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না।
কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যের কাজ তো শুধু আইন প্রণয়ন করা, পাহাড়ের জনগোষ্ঠিগুলোর মধ্যে বিরাজমান ক্ষোভ নিরসনে তাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ কতটুকু? সংবিধান সংসদ সদস্যদের আইন প্রণয়ন, বিভিন্ন কমিটি এবং স্থানীয় সরকার পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব দিলেও বাস্ততা আরো ব্যাপক। টিআর, কাবিখা, থোক বরাদ্দসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং দপ্তরের ফান্ড তাদের ডিও লেটার বা সুপারিশে বণ্টিত হয়। এমনকি গ্রামীণ এলাকার রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্টের মতো ছোটখাট প্রকল্পের জন্যও সংসদ সদস্যের ডিও লেটার ছাড়া এগুতে চায় না। রাজধানী বা বড় সিটিগুলোতে হয়তো এসব দরকার হয় না, কারণ সেখানে নানা রকম কর্তৃপক্ষ আছে এগুলো দেখভাল করার জন্য। কিন্তু পাহাড়ের দুর্গম এলাকাগুলোতে অনেক সময় প্রশাসনের লোকজনের পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই সেখানে সংসদ সদস্যদের ডিও লেটার দেয়াসহ তদারকিটাও করতে হয়। কিন্তু পুরো জেলায় একজন সংসদ সদস্যের পক্ষে চাইলেও সেটা যথাযথভাবে করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই, সেখানে সংসদ সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তাদের পক্ষে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো যেমন সহজ হবে, তেমনি সরকারের বার্তা তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়াও সম্ভব হবে, সরকারের সাথে স্থানীয় মানুষদের যোগাযোগ বা সম্পর্কও গভীর হবে। তাদের ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ কমে আসবে, দেশপ্রেম বৃদ্ধি পাবে।
জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইন এবং নির্বাচন কমিশনের রাডারে হয়তো উপরে বর্ণিত সবগুলো কারণ সমভাবে বিবেচনায় আসবে না। কিন্তু তাই বলে বাস্তবতা তো অস্বীকার করা যাবে না। সেকারণেই বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সরকারের যেসব সংস্থা বা উইং পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূগোল, জনগোষ্ঠিগুলোর মধ্যকার দুঃখ-ক্ষোভ, বিদ্যমান অস্থিতিশীলতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখে, এ ব্যাপারে তাদেরও দায়িত্ব রয়েছে, বিষয়টিকে নির্বাচন কমিশনের বোধে বা বিবেচনায় নিয়ে আসার ব্যাপারে যথাযথ পরামর্শ ও সহযোগিতা দেয়ার। আশা করি, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মধ্যে এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি হবে এবং ন্যায়সঙ্গত সংখ্যায় বাড়ানো হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংসদীয় আসন সংখ্যা।
লেখক: সাংবাদিক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক
sayedibnrahmat@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন