বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

স্বাস্থ্য

মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় করণীয়

| প্রকাশের সময় : ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০৩ এএম

দেহ আর মন মিলেই মানুষ। যার একটি অসুস্থ হলে মানুষ স্বাভাবিক থাকতে পারে না। বর্তমানে শারীরিক চিকিৎসার ব্যাপ্তি বাড়লেও মানসিক চিকিৎসায় বিশ্বজুড়েই রয়ে গেছে সংকট। অথচ মানসিক রোগ বসে থাকেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে ৩০ কোটির বেশি মানুষ বিষন্নতায় ভুগছে। যার প্রভাব পড়ছে স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতায়। বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও মডেল সার্ভের তথ্যমতে, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের ১৯ শতাংশ এবং শিশু-কিশোরদের ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। ‘মানসিক অসুস্থতা’ কথাটি শুনলে বাংলাদেশের মানুষ বিচিত্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। কেউ ঘৃণায় মুখ বাঁকায়, কেউ অবজ্ঞায় নাক সিটকায়, আবার কেউবা বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। মানসিক অসুস্থতা সামগ্রিকভাবে আমাদের দেশে তীব্র লজ্জা আর আতঙ্কের একটি ব্যাপার। কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ হলো মানে সে যেন বিশাল কোনো অপরাধ করে ফেললো, যার কলঙ্ক তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের প্রতি এদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি রীতিমতো অমানবিক, নিষ্ঠুর এবং আঁতকে ওঠার মতো। এখানে মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের 'পাগল' মনে করা হয়।

কিন্তু কেন? কী দোষ তাদের? তাদের দোষ একটাই। তারা মানসিকভাবে অসুস্থ। অথচ অসুস্থতার উপর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময় যেকোনো রোগে আক্রান্ত হতে পারে। মানসিক রোগ জ্বর, সর্দি, যক্ষ্মা, টাইফয়েড বা ক্যান্সারের মতোই একটি রোগ। সমস্যা হলো, এদেশের অনেকেই মানুষ মানসিক রোগকে কোনো রোগ বলেই মনে করে না। তাই মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের রোগীও মনে করে না যে তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখাবে। আর গত ২৯ মাসে করোনায় দেশে আত্মহত্যাসহ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা অনেক বেড়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডের মধ্যে কেউ না কেউ আত্মহত্যার মাধ্যমে প্রাণ হারায়। ১৪ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ আত্মহত্যা। অধিকাংশ ব্যক্তিই আত্মহত্যার সময় কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বে আট লাখ লোক আত্মহত্যায় মারা যায়। মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬। মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের মাধ্যমে আত্মহত্যার এ হার কমিয়ে আনা সম্ভব বলেও মত ডব্লিউএইচওর। দেশে প্রতি বছর ঠিক কত মানুষ আত্মহত্যা করে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। সরকারের এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২০ সালে ১১ হাজারের মতো মানুষ আত্মহত্যা করেছে। করোনাকালে সংখ্যাটা আরও বেড়েছে।আর ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, করোনাকালে গেল এক বছরে পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, আর্থিক সংকটসহ বিভিন্ন কারণে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ নারী-পুরুষ। স্থানীয় গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ৬ থেকে ১০ জন, যা উন্নত দেশের কাছাকাছি। দেশের মোট স্বাস্থ্য বাজেটের দশমিক ৫০ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রয়েছে। আবার এ খাতে দক্ষ জনবলেরও স্বল্পতা আছে। তবে গত কয়েক বছরে এ খাতের উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আগের চেয়ে আগ্রাধিকার পাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, পাবনা ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালের প্রচেষ্টায় দেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অগ্রগতি হয়েছে। পাবনা মানসিক হাসপাতালকে বিশ্বমানের ইনস্টিটিউট হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিদদের ভাষ্যমতে, মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে এখন মানুষের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। বিষয়টিকে সঠিক গন্তব্যের দিকে নিতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। হতাশার দিক চিহ্নিত করে তারা বলেন, দেশের কত মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে, তার সঠিক তথ্য নেই। জনশুমারিতে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারের নজরদারি অতীতের চেয়ে বেড়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় আছে।

> দুশ্চিন্তারোগের অনুভূতিঃ
* সবসময় মাথায় চিন্তা ঘোরে বিশেষত অসুখ বা অসুখের চিকিৎসা সংক্রান্ত চিন্তা সবচেয়ে খারাপ যা পরিনতি হতে পারে, মনে হয় যে সেটাই ঘটবে। যেমন ধরুন মনে হতে পারে যে অসুখটার খুব বাড়াবাড়ি হবে, বা মারা যেতে পারি। * বুকের ধুকপুকানি শুনতে পাওয়া (বুক ধড়ফড় করা) * মাংসপেশিতে ব্যথা বা টানটান ভাব ও রিল্যাক্স করতে না পারা। *ঘামা * দ্রুত নিশ্বাস নেওয়া (ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া)। * মাথা ঘোরা, মনে হওয়া যে এই বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাব। * গ্যাস অম্বল হওয়া বা বারবার পায়খানায় যাওয়া।

> বিষণ্নতার অনুভূতিঃ * সবসময় বিষন্ন বোধ করা এবং মনে করা যে এই বিষণ্নতা কোনোদিন কাটবে না জীবনে কোনো কিছুতেই উৎসাহ না থাকা। * কোনো কিছু উপভোগ করতে না পারা ছোটোখাটো ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে না পারা। * অসম্ভব বেশি ক্লান্ত লাগা সবসময় অস্বস্তি বা অস্থিরতা বোধ করা। * ক্ষুধা না পাওয়া এবং ওজন কমা (কিছু ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা হয়, ক্ষিদে আর ওজন দুটোই বাড়ে)। * ঘুম না আসা আর সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া। * সহবাসে অনীহা। * আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং নিজেকে অপদার্থ, অক্ষম ভাবা অন্যের সঙ্গ বর্জন করা। * খিটখিটে হয়ে যাওয়া। * নিজের সম্বন্ধে, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এবং পৃথিবী সম্পর্কেই সামগ্রিক হতাশা। মনে হতে পারে যে আমি কোনোদিন ভাল হব না, বা মনে হতে পারে আমি একেবারেই খরচের খাতায়। * আত্মহত্যার কথা মনে হতে পারে। বিষন্নতায় এটা প্রায়ই হয়।

> মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার উপায়ঃ-
মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার প্রথম উপায় হলো নিজের যত্ন নিতে হবে। * অবদমিত আবেগ প্রকাশের ফলে মানসিক চাপ ও জটিলতা কমে যায়।

* নিজের জন্য কিছুটা সময় আলাদা রাখতে হয় নিজের মনের কথা শুনতে হয।* বই পড়া এবং গান শোনাও দরকার।
* দুশ্চিন্তা দূর করা ঃ-অতীত ও ভবিষ্যৎ ভুলে বর্তমান দেখার চেষ্টা করতে হয়। তাছাড়া গতানুগতিক জীবনে না থেকে একটু নিজের মত সময় কাটানোর দরকার। পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ বিভিন্ন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে সুষম ও পুষ্টিকর খাবার কেবল আমাদের শরীরকে নয় এমন কি মনকেও ভালো রাখে। অন্যদিকে অস্বাস্থ্যকর খাবার আমাদের বিষন্নতার জন্য মারাত্মক ভাবে দায়ী। ভিটামিন বি১২, ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার আমাদের মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন গুলোকে চাঙ্গা রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া তাজা ফলমূল ও শাকসবজি একটা বড় ভূমিকা রাখে। পুষ্টিকর খাবার নিয়মিত খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ফলে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক থাকে।

> পর্যাপ্ত ঘুম চাই ঃ-শরীর সুস্থ রাখতে যেমন পর্যাপ্ত ঘুমের বিকল্প নেই। তেমনি মনকে সুস্থ রাখতেও ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। কারণ পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে আমাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে ওঠে। ফলে আমরা ক্লান্তি বোধ করি। কমে যায় আমাদের কর্মস্পৃহা। ঘুম আমাদের শরীরে ক্ষতিগ্রস্ত কোষ গুলো সারিয়ে তোলে। আমাদের মনকে চাঙ্গা করে। তাই মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ রাখতে আমাদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম খুব বেশি জরুরি। এরপরে নিয়মিত ব্যায়াম। মানুষের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে শারীরিক ব্যায়াম খুবই জরুরী। স্ট্রেস ও বিষন্নতা কাটাতে ভীষণ কাজে লাগে। ব্যায়ামের ফলে শরীরের ক্লান্তি ও মানসিক চাপ হ্রাস পায়। তাই মনকে চাঙ্গা রাখতে এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।

> শখের কাজ করা : নিয়মিত অভ্যাসের একটু বাইরে গিয়ে যেসব কাজ করলে মন ভাল থাকে ওই ধরনের কাজ করা। যেমন অনেকের ছবি আঁকতে ভালো লাগে, বাগান করতে ভালো লাগে, রান্না করতে ভালো লাগে, যখন মন খারাপ থাকবে তখন এই ধরনের কাজগুলো করা উচিত এতে মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায়।

> নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখা উচিতঃ মানসিক স্বাস্থ্যকে ভালো রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো নিজের প্রতি আস্থা রাখা ও প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটানো। প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটালে মানসিক হতাশা অনেকাংশে কেটে যায়। পরিবারের সাথে মন খুলে মেলামেশা করলে, মন খুলে কথা বললে, আলিঙ্গন করলে, মানসিক হতাশা অনেকাংশে কমে মানসিক সুস্থতা লাভ করা যায়। এছাড়াও যে সকল বিষয় নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হচ্ছেন, কাছের কোন মানুষের সাথে কথা গুলো শেয়ার করা উচিত। এতে করে নিজের মন অনেক হালকা হয়ে যায়। এবং মানসিক সুস্থতা ফিরে পাওয়া যায়। অনেকের কাছে মানসিক রোগের উপসর্গগুলো বয়সের দোষ, বিয়ের জন্য টালবাহানা, ঢং বা ভং ধরা। চিকিৎসার ব্যাপারে এদের বিশ্বাস- ‘মাইরের উপর ওষুধ নাই।’ কুসংস্কার ও অজ্ঞতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে যারা মানসিক রোগ চিকিৎসার আওতায় আসেন, তাদেরও বড় একটা অংশ ওষুধ নিয়ে নানান বিভ্রান্তিতে সঠিক চিকিৎসা করান না। সময়ের গতির সঙ্গে মানসিক রোগ চিকিৎসারও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, আবিষ্কৃত হয়েছে নতুন নতুন ওষুধ, সেসব ওষুধের সফল প্রয়োগ মানসিক রোগ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।

> হোমিও সমাধানঃ- মানসিক রোগীর জন্য প্রাথমিক ভাবে যেইসব মেডিসিন লক্ষণের উপর আসতে পারে-নাক্স ভুমিকা, থুজা, সালফার অরাম মেট, পালসেটিলা, স্ট্র্যামোনিয়াম, ভিরেট্রাম, ইগ্নেসিয়া, নেট্রাম মিউর, এসিড ফস, ল্যাকেসিস, চায়না, বিউফো রানা, ককুলাস ইন্ডিকা, ব্যারাইটা মিউর সহ আরো অনেক মেডিসিন আসতে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই, যেকোনো অসুস্থতা থেকে মুক্তিলাভের জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিকসহ সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। মানসিক অসুস্থতাও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই আমাদের প্রয়োজন মানসিক অসুস্থতা নিয়ে সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণা থেকে বের হয়ে এসে এই সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানলাভ করা এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটানো। আমাদের উচিত মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সবধরনের সমর্থন দেওয়া। তাদেরকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা না করে সহানুভূতিশীল আচরণ করা এবং তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।

ভাবুন তো, জীবন খুবই অনিশ্চিত। হতে পারে একদিন আপনিও মানসিক রোগে আক্রান্ত হবেন। তখন যেন আপনার পরিবেশ-প্রতিবেশ আপনার অনুকূলে থাকে এজন্য হলেও আপনার এই কাজগুলো করা উচিত।

মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রতিষ্ঠাতা-জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি,
বড় মগবাজার মিডিয়া পাড়া, ঢাকা।
ইমেইল: drmazed96@gmail.com
মোবাইল: ০১৮২২৮৬৯৩৮৯।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন