শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মেধার ভিত্তিতে নয় সীট দেয়া হয় ছাত্রলীগ বিবেচনায়

বৈষম্যের শিকার ঢাবি শিক্ষার্থীরা

রাহাদ উদ্দিন | প্রকাশের সময় : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

সাল ১৯৬১। মরহুম অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লা মুসলিম হলে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি তার ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ বইয়ের ১৪০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন তৎকালীন সময়ে যারা অনার্সে প্রথম শ্রেণি পেত, তাদের এমএ পড়ার বছরটিতে এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষ দেয়া হতো।

অর্থাৎ তখন সীট দেয়ার ক্ষেত্রে মেধাবীদের প্রাধান্য দেয়া হতো। কিন্তু ক্রমেই পাল্টে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে সীট বন্টনের এই চিত্র। ’৯০ এর পর থেকে হলগুলোর দখলদারিত্ব চলে যায় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের হাতে। তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কে কতটা সক্রিয় সেই বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের ভালো সীট দেয়ার সংস্কৃতি শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় প্রায় দেড় দশক ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে চলছে ছাত্রলীগের দখলদারিত্ব। সীট দেয়া হচ্ছে ছাত্রলীগ বিবেচনায়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামানের মতে হলে যারা থাকে তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তীব্র সীট সঙ্কটের চরম বাস্তবতার কারণে শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়েই ঠাসাঠাসি করে হলগুলোতে অবস্থান করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আবাসিক হলগুলোর সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য হল প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকদের দায়িত্ব দেয়া হলেও কার্যত শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিষয়ে দেখভাল করার অঘোষিত প্রশাসন হচ্ছে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। যে কারণে কেবল হল ছাত্রলীগ নেতাদের প্রিয়ভাজন অর্থাৎ ভালো ছাত্রলীগ কর্মী হতে পারলেই মিলে ভালো একটা সীট। অন্যদিকে ভালো শিক্ষার্থী হয়েও ছাত্রলীগ না করলে বস্তির মতো পরিবেশে দিনাতিপাত করতে হয় শিক্ষার্থীদের। লাদেন গুহা (গণরুম) আর কেন্দ্রীয় কারাগারে (গণরুম) মিলে তাদের স্থান। অবশ্য নারী শিক্ষার্থীদের পাঁচটি হলের চিত্র একটু ভিন্ন।

অভিযোগ রয়েছে, হল কর্তৃপক্ষ থেকে কাগজে কলমে নামেমাত্র একটি সিট বরাদ্দ দেয়া হলেও ছাত্রলীগই ঠিক করে দেয় কে কোন রুমে উঠবে, কোন সীটে থাকবে। অবশ্য বিষয়টি স্বীকার করতে নারাজ প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর আব্দুল বাছির। তার মতে কোনো শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগের কেউ সীটে উঠানোর সুযোগ নেই। এদিকে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ছাত্রলীগের দখলদারিত্বের ফলে ভালো ছাত্রলীগ কর্মী না হলে ভালো সীটে উঠার সুযোগ মিলে না তাদের। ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে চরম সিট বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে জানান শিক্ষার্থীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের প্রত্যেকটিতে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে ২টি গ্রুপে থাকে শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে ছেলেদের ১৩টি হলে গ্রুপের তারতম্য অনুযায়ীও বৈষম্যের শিকার হয় তারা। আবার নিজ গ্রুপে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে নিজের অবস্থানের মানদণ্ড অনুযায়ীও চরম সীট বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ফলে দেখা যায়, ভালো একটা সীটের জন্য ভালো শিক্ষার্থী না হয়ে ভালো ছাত্রলীগ কর্মী হওয়ার যুদ্ধে এগিয়ে থাকতে হয় শিক্ষার্থীদের। এদিকে আবাসন সঙ্কটের কারণে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সীট বরাদ্দ দিতে পারে না অনেকগুলো হল। অথচ ১৮টি হলেই প্রথম বর্ষের এসব অনাবাসিক শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রিত গণরুমগুলোতে মানবেতর জীবনযাপন করতে দেখা যায়। এসব রুমে ২০ থেকে ৪০ এমনকি ৫০ জনও থাকতে দেখা যায়।

ঢাবির পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর কামরুল হাসান মামুন ইনকিলাবকে বলেন, সারা পৃথিবীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সীট দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয় এবং নিশ্চিত করা হয় এরাই যেন সীট পায়। আর থার্ড ইয়ার, ফোর্থ ইয়ার, মাস্টার্স এভাবে যত সিনিয়র হবে তাদেরকে উৎসাহিত করা হয় তারা যেন গ্রুপ গ্রুপ করে ক্যাম্পাসের বাইরে ভাড়া বাসায় থাকতে শুরু করে। যাতে করে নবীন শিক্ষার্থীদের হলে থাকার জায়গা তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম চিত্র। এখানে প্রশাসন সীট বরাদ্দ দেয় কিন্তু ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন তাদের সীটে উঠায়।

প্রফেসর কামরুল হাসান মামুন বলেন, এ কাজটা এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে তাই ছাত্রলীগ করে, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন ছাত্রদল করতো আবার ভবিষ্যতে যে দল ক্ষমতায় আসবে তাদের ছাত্র সংগঠন করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, এটি ছাত্ররাজনীতির দায় নয়। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা। হলে আবাসন সমস্যা রয়েছে। তা সমাধান করার জন্য আমরা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাই। সীট দেয়ার দায়িত্ব হল প্রশাসনের। কে হলে থাকবে, কে থাকবে না এটা ছাত্রলীগের দেখার বিষয় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি হলের শিক্ষার্থীরা ছদ্মনামে হলের সার্বিক চিত্র তুলে ধরেন ইনকিলাবের কাছে। সূর্যসেন হলের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাসেল আহমেদ বলেন, হলে ভালো সীটের মানদণ্ড হচ্ছে পলিটিক্যালি এক্টিভ থাকা; নিয়মিত প্রোগ্রাম, গেস্টরুম করা। সীট দেয়া হয় লবিং এর মাধ্যমে। ছাত্রলীগ নেতাদের তোষামোদ করার বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার ভিত্তিতে রুম পাওয়ায় অগ্রাধিকার পাওয়া যায়।

স্যার এ এফ রহমান হলের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাইদুল ইসলাম বলেন, সহপাঠীদের যারা পলিটিক্স করে তাদের সিট একটু দেখেশুনে দেয়া হয়। আর কে ভালো ছাত্র, তার কোন রুমে গেলে ভালো পড়াশোনার পরিবেশ পাবে, এটা বিবেচনা করা হয় না। দেখা যাচ্ছে গাঁজাখোরদের রুমেও একটা পড়ুয়া ছাত্রকে দিচ্ছে। এছাড়া ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করলে সিনিয়রদেরও গণরুমে নামিয়ে দেয়া হয়।

মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের শামিম নামের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, হল ছাত্রলীগের সভাপতির গ্রুপের ছেলেরা তুলনামূলক সুবিধায় থাকে। আর সাধারণ সম্পাদকের গ্রুপে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদেরও থাকতে হয় গণরুমে। একরুমে ২০ থেকে ২৮ জন করে। তৃতীয় বর্ষে উঠেও যারা রাজনীতিতে সক্রিয় তাদের পাশাপাশি এই হলে ডিপার্টমেন্টে যাদের রেজাল্ট ভালো তাদেরকেও মোটামুটি মূল্যায়ন করা হয় বলে জানান শামিম। তবে যারা রাজনীতিতে সক্রিয় না তাদের ভাগ্যে জোটে স্যাঁতসেতে আর নোংরা রুমগুলো।

ফজলুল হক হলের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ বলেন, হলে প্রশাসনের বিন্দুমাত্র ক্ষমতা নেই শিক্ষার্থীদের সিট দেয়ার। সবগুলো রুম ছাত্রলীগের দখলে। এখানে যারা ডিপার্টমেন্টে ফাস্ট হয় তাদেরকেও ছাত্রলীগ না করলে ভালো সিট দেয়া হয় না।

প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে থাকা বিজয় একাত্তর হলও সম্প্রতি ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের দখলে চলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ২৮ জানুয়ারি ২০২২ প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে বিজয় একাত্তর হল শিরোনামে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে। তবে বিষয়টি মানতে নারাজ হল প্রভোস্ট প্রফেসর আব্দুল বাছির। তিনি বলেন, আমার হলে প্রশাসনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তবে ভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে এই হলের এক শিক্ষার্থীর মন্তব্যে।

কৌশিক ইসলাম ছদ্মনামে ওই শিক্ষার্থী ইনকিলাবকে বলেন, আগে হলে প্রশাসনিকভাবে যে সিট অ্যালোকেশন দেয়া হতো সেটা অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা উঠতো। ২০১৯-২০ সেশন থেকে হল ছাত্রলীগ সিট নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছে। প্রশাসন কর্তৃক দেয়া সিটে উঠানোর পরিবর্তে রুমে বিদ্যমান শিক্ষার্থীদের সাথে সমন্বয় করে রুম খালি করে ৮ জনের জায়গায় ১০-১২, এমনকি ১৪ জনও উঠানো হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারি দুই গ্রুপের পলিটিক্যালি এক্টিভরা প্রায় সমান সুবিধা ভোগ করে। সিট যেহেতু পলিটিক্যালি নির্ধারিত হয়, যারা প্রোগ্রাম-গেস্টরুমে বেশি সক্রিয় থাকে তারা এক্ষেত্রে প্রায়োরিটি পায়।

সার্বিক বিষয়ে ইনকিলাবের সাথে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামানের সাথে। তিনি বলেন, এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীরা নানা সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে নানা মাধ্যমে হলগুলোতে ঠাসাঠাসি করে অবস্থান করছে যা সত্যিই দুঃখজনক। যেকারণে প্রায়ই বিভিন্ন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে। আমাদের বেদনার বিষয় হচ্ছে আমরা তাদেরকে পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধা দিতে পারছি না। শুরুর দিকের ইতিহাস ভিন্ন হলেও এটা আসলে প্রায় পঞ্চাশ বছরের বাস্তবতা। আমাদের এই বাস্তবতা নিয়েই চলতে হবে।#

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন