শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

নকল মবিল আসল মোড়কে

বিকল হচ্ছে গাড়ির যন্ত্রাংশ : বাজারের প্রায় ৫০ শতাংশ মবিলই ভেজাল

হাসান-উজ-জামান | প্রকাশের সময় : ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

বিভিন্ন গাড়ির পুরাতন টায়ার, প্লাস্টিকের দানা, পোড়া মবিল, কেরোসিন তেল ও এক ধরনের রিফাইনিং মেডিসিন একত্রে জ্বাল দিয়ে উৎপাদন হচ্ছে ভেজাল মবিল। আবার কখনো কখনো নিম্নমানের মবিল কিনে দামি ব্রান্ডের বোতলে ভরে সেগুলো বাজারে সরবরাহ করছে একটি প্রতারক চক্র। এতে যানবাহনের মালিকই শুধু আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তা কিন্তু নয়। সেই সাথে বিকল হচ্ছে দামি যানবাহনের যন্ত্রাংশ। ভেজাল মবিলের কারনে যে কোনো গাড়ি যে কোনো সময় বিস্ফোরণেরও শঙ্কা রয়েছে। নকল-ভেজাল মবিলে সারা দেশ ছেয়ে গেছে।

অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ ও পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়মিত ‘মাসোহারা’ দিয়ে বছরের পর বছর এ ধরনের অনৈতিক ব্যবসা করে চলছে একটি চক্র। যদিও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন আসলের লেবাসে নকল মবিল তৈরির কারখানায় অভিযান চালায়। জরিমানা আদায় করে। আবার অসাধু ব্যবসায়ীদের জেলেও পাঠায়। কিন্তু ভেজাল মবিল সরবরাহ কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সূত্র জানিয়েছে, ঢাকার বিশেষ করে যাত্রাবাড়ি, ডেমরা, শ্যামপুর, কেরাণীগঞ্জ, বসিলা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায় নকল মবিল কারখানার সন্ধান মিলেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, পুরান ঢাকার চাঁনখারপুল, খাজে দেওয়ান লেন, নিমতলী, চকবাজার, লালবাগ, ইসলামপুর, তাঁতীবাজার, ধোলাইখালসহ রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় এই অবৈধ কাজে জড়িত একাধিক সিন্ডিকেট রয়েছে।

ঢাকায় ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর যাত্রাবাড়ির ৪৬/১৫ আড়াবাড়ি কোনাপাড়া পশ্চিম মমিনবাগের মামুন মিয়ার বাড়িতে অভিযান চালিয়েছিল সিআইডির একটি টিম। ওই সময় বিপুল পরিমাণ ভেজাল মবিল, ভেজাল মবিল তৈরির বিভিন্ন উপকরণসহ মামুনের কয়েকজন কারিগরকে গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় ওই সময় সিআইডির ইন্সপেক্টর সুব্রত কুমার সাহা বাদি হয়ে যানবাহন, যন্ত্রপাতি ও কলকব্জা শিল্পকারখানা ধ্বংস করার অপরাধে ১৯৭৪ সনের বিশেষ ক্ষমতা আইনে (১) ধারায় যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই অভিযানে নেতৃত্বদানকারি সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (ঢাকা মেট্রো-পূর্ব) কানিজ ফাতেমার বক্তব্য ছিল, সেখানে বিভিন্ন ধরনের রাবার, পুরাতন টায়ার ও প্লাস্টিকের দানার সঙ্গে ব্যবহার করা পোড়া মবিল জ্বাল দিয়ে তারা এই নকল মবিল তৈরি করতো। পরে নানা নামি কোম্পানির লেভেল বোতলে লাগিয়ে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন গ্যারেজে মবিল বিক্রি করে। এছাড়া মহাসড়কের পাশে মবিল বিক্রির দোকানে স্বাভাবিক দামের তুলনায় কম দামেও এই মবিল বিক্রি হত।

সিআইডির ইন্সপেক্টর সুব্রত কুমার সাহা গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, প্রতারকচক্র বিভিন্ন কৌশলে মবিল নকল করে। বিশেষ করে ইতোপূর্বে গাড়িতে ব্যবহৃত পোড়া মবিল তারা সংগ্রহ করে। ওইসব মবিল বিশেষ ক্যামিকেলের মাধ্যমে রিফাইন করে। পরে সেগুলো বিভিন্ন ড্রামজাত করে পাইকারি হিসেবে বিক্রি করে। আবার একই মবিল বিভিন্ন নামি দাবি ব্রান্ডের কৌটা কিংবা জারে আসলের মতো লেভেল লাগিয়ে তা খুচরা বাজারে ছেড়ে দেয়।

সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, ওইসব নকল মবিল ব্যবহারে দামি গাড়িগুলোর যন্ত্রপাতি খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। এ ধরনের ভেজাল মবিলে যানবাহনে ক্রটি ছাড়াও যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটার আশঙ্কা থকে। মাঝেমধ্যে চলন্ত পথে অনেক যানবাহন বিকল কিংবা কোনো কারণ ছাড়াই আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। ভেজাল মবিলের কারনেই এসব হয়ে থাকে। সিআইডির ওই অভিযানকালে কারখানটি সিলগালা হয়। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে সেখানে একই ধরনের ব্যবসা চলছে।

র‌্যাবের অভিযানে বিভিন্ন সময়ে ভেজাল মবিল কারখানা থেকে জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, যাত্রাবাড়ীর ভাঙ্গা প্রেস সামাদ নগর এলাকায় জনৈক আজিজের রয়েছে বাংলাদেশ রাবার প্রসেস অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে, নিজেদের প্রতিষ্ঠানের নামে এরা চোরাইপথে ডিজেল কেনে। ওই ডিজেল গরম করে এক ধরনের রাবার ও ক্যামিকেল ব্যবহার করে মবিল বানায়। ওই মবিলই ড্রামে করে সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। সেগুলো ড্রামে করে পাইকারি হিসেবে চলে যায় দেশের সর্বত্র।

ড্রামভর্তি ওই মবিলই স্থান পায় বিভিন্ন নামি দামি কোম্পানির মবিলের বোতলে। সূত্র জানায়, গড়ে ৮০ থেকে ১০০ ড্রাম মবিল ওই কারখানা থেকে উৎপাদন হয় রাবার অয়েল প্রসেসিংএর নামে। গত বছরের মাঝামাঝি র‌্যাব নবাবপুরে অভিযান চালিয়ে কাওসার আহম্মেদ নামে একজন বিক্রেতাকে ভেজাল মবিল বিক্রির অপরাধে গ্রেফতার করে। ওই সময় কাওসার তার মালামাল ক্রয়করা স্থান হিসেবে মেসার্স বাংলাদেশ রাবার প্রসেস অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ এর চালান দেখান। তবে অভিযুক্ত আজিজ এ ব্যাপারে ইনকিলাবকে বলেন, কোথাও তার কারখানা থেকে মবিল যায় না।

বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের ভেজাল ও নকল মবিল কারখানায় অভিযানকারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি সংস্থা সিআইডি, র‌্যাবসহ অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তারা বলেন, বাজারের প্রায় ৫০ শতাংশ মবিলেই ভেজাল রয়েছে। দক্ষিণ কেরণীগঞ্জে নকল মবিল, লুব্রিকেন্ট ও ইঞ্জিন অয়েল উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়েছেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

তারা জানান, এসব নকল মবিলই বোতলে কিংবা জারে ভরার পর হয়ে যায়, বিদেশি ব্রান্ডের জেঅন-৬৮, সুপারভিসিনো, এইস ডি, ভিপি সুপার, ন্যাশনাল সুপার, মোলেক্্র, মবিল সুপার, ইঞ্জিন ওয়েল ও জেনারেটর ওয়েল। সাইকেল গ্যারেজ, গাড়ির ওয়ার্কশপ, মোটরসাইকেল পার্টসের দোকান, পেট্রোলিয়ামের দোকান, মুদির দোকান, হার্ডওয়্যারের দোকানে বিক্রি হচ্ছে ওই তেল, মবিল বা লুব্রিকেন্ট।

অভিযোগ রয়েছে, সারাদেশেই এ ধরনের নকল মবিল কারখানা থাকলেও নিয়মিত অভিযান না হওয়ায় এ ধরণের প্রতারণা বন্ধ হচ্ছে না। প্রতারিত ক্রেতা সাধারণ এই অসাধু চক্র ধ্বংস করতে দ্রুত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (7)
MD A Rabbani ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:১৫ এএম says : 0
ভেজাল হয়েছে তাকে কি আসে যায় মানুষ এখন মবিল খাবে।
Total Reply(0)
Mintu Nasir Khan ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:১৫ এএম says : 0
ভেজাল দেশে ভেজাল থাকবেই শুধু মবিলে নয় এই দেশের সব কিছুতেই ভেজাল।
Total Reply(0)
Hasan Ullah ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:১৬ এএম says : 0
যে দেশে মানুষ অর্থাৎ দেশ পরিচালনায় ভেজাল সেই দেশে এবং মোবিল কেন সবকিছুতে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
Total Reply(0)
EngShagor Gazi ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:১৬ এএম says : 0
নব্বই শতাংশ ই ভ্যাজাল। কিন্তু প্রশাসন নির্বিকার
Total Reply(0)
মোঃ সুমন আহমেদ ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:১৬ এএম says : 0
Absolutely Right
Total Reply(0)
Sajal Hasan ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:১৬ এএম says : 0
দেশটাই ত ভেজাল মবিল তো হবেই
Total Reply(0)
Miron Khan ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:১৭ এএম says : 0
যে দেশের সরকারই ভেজাল, সেই দেশের মবিল খাটি পাবো কোথায়...???
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন