বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সঙ্কট দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে

গ্যাস সমস্যার সমাধান নেই তিতাসের কাছে? ভোক্তা পর্যায়ে দু’তিন মাস আগে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও হাজার হাজার চুলা জ্বলছে না : বাসায় রান্না না হওয়ায় অভুক্ত থাকতে হচ্ছে নিম্নবিত্ত-মধ্যব

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

দু’মাস আগে ভোগাক্তি পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ এলাকায় গ্যাসের চুলা জ্বলছে না। কোথাও কোথাও রাতে চুলা জ্বললেও সারাদিন গ্যাসের চাপ থাকে না। আবার কোনো কোনো এলাকায় রাতেও চুলা জ্বলছে না। ফলে লাখ লাখ মানুষ চরম দুর্দশায় পড়ে গেছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এর মধ্যেই গ্যাস সঙ্কটের কারণে ঘরে রান্নাবান্না করতে পারছেন না। এতে করে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বিপুলসংখ্যক মানুষকে দিনের বেশিরভাগ সময় অভুক্ত থাকতে হচ্ছে। শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ী, ধোলাইপাড়, পুরান ঢাকার বাসাবাড়ীর অধিকাংশের চুলা জ্বলছে না। বিভিন্ন এলাকা থেকে তিতাস কর্তৃপক্ষকে গ্যাসের সঙ্কটের ব্যাপারে অভিযোগ করলেও কোনো সুরাহা হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে তিতাসের কিছু কর্মকর্তা বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে অবৈধভাবে গ্যাস লাইন দেয়ায় ওইসব লাইন দিয়ে গ্যাস টেনে নেয়া হচ্ছে। এতে বাসাবাড়িতে গ্যাসের চাপ কমে গেছে। অনেক বাসায় প্রায় ২০ থেকে ২৫ দিন থেকে গ্যাসের চুলা জ্বলছে না।

জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান ইনকিলাবকে বলেন, বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে স্পট মার্কেট থেকে কেনা হয়, যে গ্যাস তা জুলাই থেকে বন্ধ করা হয়েছে। যার কারণে গ্যাসের সরবরাহ ৭ থেকে ৮ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কিনে ঘাটতি মেটানোর প্রক্রিয়া স্থগিত করায় সরবরাহে টান পড়েছে। যেসব সেবা বা পণ্য উৎপাদনে গ্যাস লাগে অর্থাৎ বিদ্যুৎ, সার কিংবা শিল্পকারখানাকে অগ্রাধিকার দিয়ে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।

অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলার কারণে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির চাপে দেশের সাধারণ মানুষের যখন নাভিশ্বাস উঠছে। প্রতিবছর শীতকাল এলে এমনি গ্যাস থাকে না। অনেক এলাকায় সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। এসব এলাকায় এখন সিলিন্ডারই ভরসা। যাদের সিলিন্ডার নেই, তারা ভোরে রান্না করেন। রাজধানীর বস্তির গরিব মানুষগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। এবার শীতকাল এখনো শুরু হয়নি আর আগেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে দেখা দিয়েছে গ্যাসের তীব্র সঙ্কট।

গ্যাস সঙ্কটের কারণে কয়েকটি ইউরিয়া সার কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে চলা এ সঙ্কট দিন দিন আরও তীব্র হচ্ছে। কবে নাগাদ ওই কারখানাটি পুনরায় চালু করা যাবে তা নিয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো কথা বলতে পারেনি। শুধু এই কারখানাটি নয়, গতকাল রোববার ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বাসাবাড়িতেও সারাদিন গ্যাসের চাপ কম ছিল। এ সঙ্কট সহসাই কাটবে, এমন আশ্বাস দিতে পারেনি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। এদিকে আগামী শীতকালে কি পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করতে পারবে, তার কোনো পরিকল্পনা নেই তিতাসের।

এ বিষয়ে তিতাসের জরুরি অভিযোগ কেন্দ্রের কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করে বলেন, লাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রেশনিং করে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। মূল লাইন থেকে গ্যাসের চাপ অর্ধেকে নেমে আসায় আগের মতো সরবরাহ করা যাচ্ছে না। শীতকালে আবহাওয়া অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা থাকায় গ্যাস জমে যায় এবং যেখান থেকে এ খনিজ উত্তোলন করা হয়, সেখানেও চাপ কম থাকে।
প্রতিদিন সকাল ৮টার আগেই গ্যাস চলে যায়, আসে সন্ধ্যার পর। কোনো কোনো এলাকায় দিনভর গ্যাসের সরবরাহ মিলছে না। এ অবস্থায় অনেকেই সিলিন্ডারজাত এলপিজি কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে এ বাড়তি খরচ তাদের জন্য গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা গিয়েছে। রাজধানীতে গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বলছে, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় রাজধানীর বাসাবাড়িতে গ্যাসের এই সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সরবরাহ না বাড়লে এই সঙ্কট সহসা দূর হচ্ছে না। রাজধানীর মোহাম্মাদপুরের কাদিরাবাদ হাউজিংয়ের ৭ নম্বর রোডের বাসিন্দা মারিয়া মীম গ্যাস সঙ্কটে নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘প্রায় এক মাস ধরে সকাল ৮টার আগেই গ্যাস চলে যায়, সন্ধ্যার পর চুলায় গ্যাসের সরবরাহ পাওয়া যায়। কখনও কখনও রাত ১০টার পর গ্যাস আসে। তা-ও আবার চাপ কম থাকায় চুলা জ্বলে টিম টিম করে। শীত মৌসুমে সাধারণত গ্যাসের চাহিদা হ্রাস পায়, আবার অক্টোবর নাগাদ পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও তার আগেই গ্যাসের এ অবস্থা।

জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ পুরো বিষয়টি অস্বীকার করে ইনকিলাবকে বলেন, সরবরাহ কম থাকার পাশাপাশি আরেকটি কারণেও বাসাবাড়িতে গ্যাস সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অনেক জায়গায় আমরা একতলা বাড়িতে গ্যাস সংযোগ দিয়েছিলাম। যেখানে কানেকশন হওয়ার কথা ১০টি, সেখানে হয়ে গেছে ৪০টি। এ কারণে ওই এলাকায় গ্যাসের প্রেসার কম থাকে। সব মিলিয়ে এটুকু বলতে পারি, পেট্রোবাংলা যেদিন আমাদের চাহিদামতো গ্যাস দিতে পারবে, সেদিনই এই সঙ্কট কেটে যাবে।

জানা গেছে, গ্যাসের চাহিদা দৈনিক প্রায় সাড়ে তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে সরকার এখন পর্যন্ত দৈনিক সরবরাহ করে ৩০৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এই গ্যাসের মধ্যে দেশীয় উৎপাদন প্রতিদিন ২৩০০ থেকে ২৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বাইরে চাহিদা মেটাতে লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস বা এলএনজি আমদানি করা হয় মধ্যপ্রাচ্যের কাতার এবং ওমান থেকে। তা থেকে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হয় লোকাল গ্রিডে। এছাড়া, দিনে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো স্পট মার্কেট থেকে আমদানি করা গ্যাস থেকে। চলতি বছর থেকে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে আগামী ৪ বছরে ৪৬টি কূপ খনন করে গ্যাস অনুসন্ধান চালানো শুরু হয়েছে। ৪৬টি কূপের মধ্যে অনুসন্ধান কূপ, উন্নয়ন কূপ এবং ওয়ার্কওভার অর্থাৎ আগে খনন করা কূপে নতুন অনুসন্ধান চলছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন করে দিনে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তার পরও রাজধানীর মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, আসাদগেট, লালমাটিয়া, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, মিরপুর, বাড্ডা, রামপুরা, বনশ্রী, মালিবাগ, শান্তিবাগ, যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকা, উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা গ্যাস সঙ্কটে ভোগান্তিতে পড়েছেন। ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় গ্যাস সরবরাহ করে দেশের শীর্ষ গ্যাস বিতরণকারী সরকারি কোম্পানি তিতাস। গ্যাসের এ সঙ্কট দুই-এক দিনে সমাধান হবে না। রাজধানীতে এখন দিনে ১৮০ থেকে ১৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ মিলছে ১৬০ কোটি ঘনফুটের মতো। গ্যাস সরবরাহ না বাড়লে এ সঙ্কট থেকেই যাবে।

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা তাসলিমা আক্তার বলেন, আমাদের নুরজাহান রোড থেকে আদার এবং তাজমহল রোড এলাকায় দিনের বেশিরভাগ সময় গ্যাস থাকে না। রান্নার কাজটা সারতে হয় ভোরে, নয়তো রাতে। স্বামী-স্ত্রী দুজনই কর্মজীবী হওয়ায় দিনে রান্নার আয়োজন তেমন একটা থাকে না। তবে সমস্যা হয় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে। সে জন্য গ্যাসের সিলিন্ডার কিনে নিয়েছি। বনশ্রীর বাসিন্দা রফিক মোহাম্মদ বলেন, মাঝে মাঝে মনে হয়, শুধু শুধুই বাসায় গ্যাসের সংযোগ নিয়েছি। কারণ গ্যাস সঙ্কটে সারা মাসই সিলিন্ডার গ্যাসে রান্নার কাজ করতে হচ্ছে। এমনিতেই বাজারে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেড়ে গেছে। রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা খাতিজা আক্তর বলেন, বেশ কিছুদিন ধরেই এলাকায় গ্যাস সঙ্কট চলছে। সকালে কিছুটা গ্যাস পাওয়া গেলেও দুপুরে চুলা জ্বলে না। কোনো কোনো দিন সন্ধ্যার পরও থাকে একই অবস্থা। আবার গ্যাস থাকলেও চাপ খুবই কম থাকে, যা দিয়ে রান্না করা কঠিন হয়ে পড়ে।

যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা তাপসি রায় বলেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে আমাদের এলাকায় গ্যাস সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। আগে সকাল ৯টা পর্যন্ত গ্যাস থাকত। এখন তা-ও মিলছে না। কয়েক দিন ধরে তো গ্যাসই পাচ্ছি না। বাধ্য হয়ে এলপিজি সিলিন্ডার কিনেছি। ওদিকে গ্যাসের বিল তো ঠিকই দিতে হচ্ছে। এতে বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, একদিকে গ্যাস থাকছে না, অন্যদিকে বিদ্যুৎ বিল আরো কেটে নিচ্ছে বেশি টাকা। রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা শাহানাজ বেগম বলেন, সব প্রস্তুতি সেরে দুপুরের রান্নার জন্য গ্যাসের চুলা জ্বালাতে গিয়ে দেখলেন টিমটিম করে জ্বলছে। হাড়ি চড়ানোর দু-তিন মিনিটের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় চুলা। এখনো তেমন শীতকাল পড়া শুরু হয়নি। তার আগে এ অবস্থা হয় তবে শীত এলে তো গ্যাসের সঙ্কটে না খেয়ে দিন কাটাতে হবে।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (টিজিটিডিসিএল) পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী মোহাম্মাদ সেলিম মিয়া ইনকিলাবকে বলেন, পেট্রোবাংলা আমাদের যতটুকু গ্যাস দেয়, আমরা ততটুকুই সাপ্লাই করি। তারা সাপ্লাই কম দেয়ায় আমরাও গ্রাহকদের কম সাপ্লাই দিচ্ছি। গ্যাস সাপ্লাই বাড়াতে আমরা ইতোমধ্যে পেট্রোবাংলাকে কয়েকবার চিঠি দিয়েছি। তারা যখন এই সাপ্লাই বাড়াবে আমরাও গ্রাহকদের সাপ্লাই ঠিক রাখতে পারব। কিছু কিছু জায়গায় সঙ্কট আছে। বেশিরভাগ জায়গায়ই গ্যাসের সরবরাহ ঠিক আছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন