প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকার আগামী বছর থেকে একটি নতুন জাতীয় পাঠ্যক্রম চালু করতে যাচ্ছে, যার লক্ষ্য বাংলাদেশি শিশুদের বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের (৪ আরআই) উপযোগী করে তোলা।
তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের শিশুদের সত্যিকারের বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে উন্মুখ। আমরা আগামী বছর থেকে একটি নতুন জাতীয় পাঠ্যক্রম চালু করছি’।
স্থানীয় সময় গত সোমবার জাতিসংঘ মহাসচিবের ট্রান্সফর্মিং এডুকেশন সামিটে সম্প্রচারিত একটি ভিডিও রেকর্ডিং জাতীয় বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নতুন পাঠ্যক্রম আমাদের শিক্ষার্থীদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করবে’। তিনি আরো যোগ করেছেন, এটি তাদের আবহাওয়া সহনশীল হওয়ার বিষয়ে সচেতন করবে এবং একটি উন্নত, জ্ঞান-ভিত্তিক অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার জন্য তাদের দেশের ‘ভিশন-২০৪১’-এর প্রকৃত এজেন্টে পরিণত করবে।
উচ্চশিক্ষায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা গবেষণা ও উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। কারিগরি শিক্ষার জন্য, আমাদের লক্ষ্য হল আরও ভালো শিল্প সংযোগ স্থাপন করা’। তিনি বলেন, তাদের বাচ্চাদের এমন দক্ষতা থাকতে হবে যা তারা বিশ্বের যে কোনো জায়গায় ব্যবহার করতে পারে।
তিনি বলেন, ‘যোগ্যতার পারস্পরিক স্বীকৃতির জন্য আমাদের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা মৌলিক এবং আজীবন শিক্ষার অ্যাক্সেস উন্নত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বহুভাষিক শিক্ষার প্রসারের জন্য তারা তাদের কিছু জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় পাঠ্য বই তৈরি করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত এবং আমাদের ভূমিতে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ শিশুকে মিয়ানমারের পাঠ্যসূচিতে শিক্ষা দিচ্ছি’।
মানসম্পন্ন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা বিষয়ে তিনি বলেন, তার সরকারকে তাদের শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং প্রণোদনার জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের জিডিপি অনুপাতে শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের এসডিজি-৪-এর জন্য তাদের আর্থিক প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। বিশ্বব্যাপী অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয় করা সম্পদ শিক্ষার জন্য একটি ভালো অংশীদারিত্বের জন্য চ্যানেল করা উচিত, তিনি যোগ করেছেন।
‘---আমরা স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে এসডিজি-৪ সূচকগুলো পর্যবেক্ষণ করতে থাকব। শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড। আমাদের অবশ্যই আমাদের জিডিপির অনুপাতের সমতা এবং অধিকার-ভিত্তিক পদ্ধতির অনুপাত নিতে হবে’- তিনি বলেন।
প্রধানমন্ত্রী ট্রান্সফর্মিং এডুকেশন সামিট আয়োজনের জন্য মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এ সামিট কাজের জগতে ভবিষ্যত পরিবর্তনের সাথে শিক্ষা নিয়ে চিন্তা করার নতুন পথ চিহ্নিত করে। তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারির কারণে শিক্ষার ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশে ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে আমরা ছয় লাখ স্কুল বহির্ভূত শিক্ষার্থীকে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় নথিভুক্ত করেছি’।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা ৫ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের টিকাদান শুরু করেছেন। তিনি যোগ করেন, ‘প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত প্রায় ২৩ মিলিয়ন শিক্ষার্থী উপবৃত্তি এবং বৃত্তি পায়’।
তিনি বলেন, তারা মোবাইল গেটওয়ের মাধ্যমে কঠিন চাপেপড়া পরিবারগুলোকে নগদ প্রণোদনা প্রদান অব্যাহত রাখবেন। তিনি বলেন, ‘উপবৃত্তি, মধ্যাহ্নভোজ এবং বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের সাথে জড়িত আমাদের সফল প্রোগ্রামগুলো চালানো হবে’।
মহামারি দূরশিক্ষণে উদ্ভাবনের সুযোগও খুলে দিয়েছে, তিনি বলেন, বাংলাদেশে তারা একটি মিশ্র শিক্ষার মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেছেন। তিনি যোগ করেন, ‘আমরা আগামী বছরের মধ্যে প্রায় ৫৯,৭৮০টি মাল্টি-মিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করব। আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন কমানোর দিকে মনোযোগ দেব’।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লিঙ্গ সমতা অর্জনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। ‘আমরা উচ্চ এবং কারিগরি শিক্ষায় লিঙ্গ ব্যবধান কমাতে কাজ চালিয়ে যাব। আমাদের মেয়েদের শিক্ষিত করা সবসময়ই আমার প্রধান অগ্রাধিকারের একটি ছিল’ -তিনি যোগ করেন।
নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রী : এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৭তম অধিবেশনে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পৌঁছেন। প্রধানমন্ত্রী ও তার সফর সঙ্গীদের বহন করা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ভিভিআইপি ভাড়া বিমান গত সোমবার রাত ১০টা ২৫ মিনিটে (স্থানীয় সময়) নিউইয়র্ক জেএফকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মাদ ইমরান এবং জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মুহাম্মাদ আব্দুল মুহিত বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান। এরআগে, বিমানটি ১৯ সেপ্টেম্বর রাত ৮ টায় (স্থানীয় সময়) লন্ডনের স্ট্যানস্টেড ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ত্যাগ করে।
যুক্তরাজ্য ছাড়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সোমবার লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের নেতাদের সঙ্গে সদ্য প্রয়াত রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন। রানীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবের ওই ভবনে অনুষ্ঠিত হয় যেখানে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং রানী হিসেবে মুকুট পরিধান করেন। ১৫ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যুক্তরাজ্যে (ইউকে) এক রাষ্ট্রীয় সফরে লন্ডনে পৌঁছান।
তার যুক্তরাজ্য সফরের চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী বাকিংহাম প্যালেসে রাজা তৃতীয় চার্লসের দেয়া অভ্যর্থনায় অংশগ্রহণ করেন। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, রাজা-বাদশাহদের সম্মানে তিনি এ অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।
নিউইয়র্কে গতকাল শেখ হাসিনার জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস আয়োজিত সংবর্ধনা এবং ইউএনজিএ’র ৭৭তম অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কথা। তিনি ইউএনএইচসিআর’র ফিলিপো গ্রান্ডির এবং সেøাভেনিয়ার প্রেসিডেন্ট বরুত পহরের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন। তিনি ইউএনজিএ’র নারী নেতাদের প্লাটফর্মে অংশগ্রহণ করবেন। দিন শেষে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আয়োজিত সংবর্ধনায় অংশ নেবেন।
এছাড়া তিনি আজ বাংলাদেশ, বোতসোয়ানা, সেøাভাক রিপাবলিক ও ইউএন হাবিট্যাট যৌথভাবে আয়োজিত টেকসই হাউজিং বিষয় উচ্চ পর্যায়ের এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন। একই দিন তিনি ডব্লিউইএফ’র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক শোয়াব ক্লাউসের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন এবং গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপঞ্জ গ্রুপ (জিসিআরজি) চ্যাম্পিয়ন মিটিংয়ে যোগ দেবেন।
বিকেলে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সদর দপ্তরে পদ্মা সেতুর প্রদর্শনী পরিদর্শনের পর কসাভো প্রেসিডেন্ট ড. ভিয়োসা ওসমানি-সাদ্রিউ, ইকুয়েডর প্রেসিডেন্ট গুইলারমো লাসো মেনদোজার সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন।
২২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী সকালের নাস্তার মধ্যে এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যন্স (এএমআর) বিষয়ে বৈঠকের পর আইওএম’র মহাপরিচালক অ্যান্টোনিও ভিটোরিনো তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। তিনি ইউএস বাংলাদেশ ব্যবসায়ী পরিষদের সাথে উচ্চ পর্যায়ের গোলটেবিল বেঠকে অংশগ্রহণ করবেন। পরে তিনি কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী সমডেক আক্কা মোহা সেনা পাদেই টেকো হুন সেন ও আইসিসি প্রসিকিউটর নিক ক্লেগ ও করিম খানের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন। ২৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনের জেনারেল ডিবেটে তার ভাষণ দেবেন। এছাড়া তিনি ২৪ সেপ্টেম্বর প্রবাসী বাংলাদেশীদের এক নাগরিক সংবর্ধনায় যোগ দেবেন।
প্রধানমন্ত্রীকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ শাহবাজ শরিফের : পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বেশ কয়েকবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম গত সোমবার এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান।
সাইদা মুনা তাসনিম বলেন, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী এ আমন্ত্রণ জানান।
ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়েছে। রানির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গেও দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন শেখ হাসিনা। হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম জানান, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সফরের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ডেভিড ক্যামেরন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন