নগরীর একটি স্বনামধন্য বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রীর সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় হয় এক কলেজ ছাত্রের। পরিচয়ের দু’সপ্তাহ পর তারা একটি কফিশপে দেখা করে। তৃতীয় সপ্তাহে তাদের মধ্যে প্রেমজ সম্পর্ক তৈরি হয়। সম্পর্কের ঠিক ২৭তম দিনে কলেজছাত্রটি জন্মদিনের পার্টির কথা বলে তার প্রেমিকা স্কুলছাত্রীকে একটি বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে আরো দুই বন্ধু মিলে ধর্ষণ করে এবং সবকিছুর ভিডিও ধারণ করে। এরপর নিয়মিত ছাত্রীটিকে প্রেমিক ও তার দুই বন্ধু ইচ্ছের বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং কারণে অকারণে টাকা আদায় করে। একপর্যায়ে ছাত্রীটির পরিবার পুলিশের স্মরণাপন্ন হলে অভিযুক্তরা গ্রেফতার হয়। বর্তমানে খুলনার সদর থানা এলাকার এই ঘটনাটির আদালতে বিচার চলছে।
গত ২২ সেপ্টেম্বর রাতে খুলনা মহানগরীর আড়ংঘাটা এলাকায় প্রেমজ সম্পর্কের সূত্রে প্রেমিকাকে ধর্ষণ করে প্রেমিক ফজলুর রহমান শাওন। ধর্ষণের শিকার তরুণী নগরীর সোনাডাঙ্গা থানার গোবরচাকা এলাকার বাসিন্দা। ঘটনার রাতে প্রেমিক ও এক বন্ধুর সাথে নগরীর আড়ংঘাটা তেলিগাতী এলাকায় ঘুরতে যায় সে। রাত দেড়টার দিকে তেলিগাতী এলাকার একটি পুকুর পাড়ে তাকে ধর্ষণ করে প্রেমিক শাওন। ধর্ষিতা তরুণী বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেছেন।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর সকালে নগরীর একটি বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রীকে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে তার প্রেমিক ও বন্ধুরা মিলে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় পুলিশ ৩ জনকে গ্রেফতার করে। ১৭ জুন কেএমপির আড়ংঘাটা থানার কনস্টেবল স্বদেশবালাকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তিনি একজন গৃহবধূকে একাধিকবার ধর্ষণ করেছেন। এ বছর ১৫ মে স্বল্প সময়ে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করে এক কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে পিবিআইর একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। ২৫ জানুয়ারি খুলনার ফুলতলা উপজেলায় প্রেমিকা মুসলিমাকে ধর্ষণের পর মাছকাটা বটি দিয়ে জবাই করে হত্যা করে প্রেমিক রিয়াজ। ঘটনাটি ওই সময় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এ ঘটনায় রিয়াজ ও তার বন্ধু সোহেলকে গ্রেফতার করে র্যাব। তাদের স্বীকারোক্তি মুসলিমার মাথা ও শরীর দুই জায়গা থেকে উদ্ধার হয়। খুলনায় এভাবে দিনের পরদিন বেড়ে চলেছে ‘প্রেমজ ধর্ষণ’র ঘটনা। এর নেপথ্যে কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর অপব্যবহার, ভারতীয় আকাশ সংস্কৃতি, পারিবারিক বন্ধনে শিথিলতা, ধর্মীয় শিক্ষার অভাব এবং সঙ্গ দোষ, অল্প বয়সে মুঠোফোন ব্যবহারসহ অনেকগুলো সামাজিক কারণ দায়ী।
বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমান সময়ে প্রেমের সম্পর্ক হতে ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এর পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। এখনকার উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীরা এক ভিন্ন সময় অতিক্রম করছে। হাতের মুঠোয় তাদের মুঠোফোন, ইন্টারনেট। এগুলো ব্যবহারের সরকারি কোনো নীতিমালা নেই। পারিবারিক বন্ধনগুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কী করছে তা সম্পর্কে অনেক অভিভাবকই অসচেতন। এ ধরণের ঘটনায় অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও খুব কম হচ্ছে। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আগে পাড়া মহল্লায় মুরুব্বী প্রথা ছিল। এখন তা উঠে গেছে। মুরুব্বীদের সবাই শ্রদ্ধা করতেন, মেনে চলতেন। তারাই সব দেখভাল করতেন। এলাকাভিত্তিক ক্লাব ও খেলার মাঠ ছিল, পাঠাগার ছিল। সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল। সময়ের বিবর্তনে এখন সব পাল্টে যাচ্ছে। পরিবারগুলোকে সচেতন হতে হবে। স্কুলগুলোতে কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রশাসনকে কঠোর অবস্থায় থাকতে হবে। পার্কে বা বিনোদন কেন্দ্রে অল্প বয়সী জুটি দেখলে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে, শুধু মুচলেকা রেখে ছেড়ে দিলে হবে না, সেফ কাষ্টডিতে কয়েকদিন রাখতে হবে। তা না হলে এসব সামাজিক অপরাধ আরো বাড়তে থাকবে।
পুলিশের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আ ন ম জাহিদুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, সামাজিক অপরাধ সামাজিকভাবেই প্রতিরোধ করা উত্তম। এক্ষেত্রে পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানদের বেশি বেশি সময় দিতে হবে। সন্তান কাদের সাথে মিশছে, মোবাইল, ইন্টারনেটে কত সময় ব্যয় করছে, কোনো কোনো সাইটে প্রবেশ করছে এসব নজর রাখতে হবে। উঠতি প্রজন্মের বিশেষ করে মেয়েদের পোষাক আষাকে সচেতন থাকতে হবে। এমন পোষাক পরানো যাবে না যা অন্যের মধ্যে অপরাধবোধ জাগিয়ে তুলতে পারে। অকারণে তাদের বাড়ির বাইরে ঘোরাফেরা বন্ধ করাতে হবে। প্রচলিত যে আইন আছে তা পর্যাপ্ত কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ থাকতে হবে। অনেকে ক্ষেত্রেই ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে গেলে লোকলজ্জার ভয়ে অনেক পরিবার তা প্রকাশ করেন না। ফলে অপরাধীরা অপরাধ করতে আরো বেশি উৎসাহী হয়। এজন্য সচেতনতা তৈরির কোনো বিকল্প নেই।
খুলনার বিভিন্ন আদালত, মেট্রো ও জেলার ১৭ থানা, স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল, ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় ও সালিশ কেন্দ্রগুলো হতে প্রাপ্ত তথ্য সমন্বয় করে দেখা গেছে, গত এক বছরে খুলনায় প্রেমজ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে কমপক্ষে ২০টি। যার মধ্যে মামলা হয়েছে ৯টি। স্থানীয়ভাবে মিমাংসা হয়েছে ২টি। বাকী ৯টি ঘটনা ধামাচাপা পড়ে গেছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের কারণে অথবা অভিযোগ উঠিয়ে নিয়েছেন ভুক্তভোগিরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগরীর শিরোমনি এলাকায় এ ধরণের ঘটনার শিকার এক স্কুলছাত্রীর পরিবার দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর তারা মামলা করতে চেয়েছিলেন। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পরে আর আইনের আশ্রয় নেননি। তাছাড়া মামলা চালানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি এবং বারবার আদালতে যাওয়ার মতো পুরুষ সদস্য তাদের পরিবারে নেই। দু’বছরের আগে ঘটে যাওয়া এ ঘটনার জন্য এখনো অনেকেই মেয়েটি নানা বিদ্রুপ উপহাস করে।
খুলনার মানবাধিকার কর্মী ও সরকারি কৌশুলি অ্যাডভোকেট আফরোজা রোজি দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, নারীরা নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হলে তাদের সরকারি খরচে সব ধরণের আইনি সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু অনেকেই এটি জানেন না। এ ছাড়া খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) চিকিৎসার সব ব্যবস্থা রয়েছে। কেউ নিগৃহীত হলে বা ধর্ষিতা হলে অবশ্যই তাকে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে অপরাধীরা আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন