একটা সময় ছিল যখন সিনেমা হলে সিনেমা দেখা ছিল উৎসবের মত। নতুন কোন সিনেমা মুক্তি পেলে স্বপরিবারে সিনেমা হলে যেত। পছন্দের নায়ক-নায়িকার সিনেমা দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। দর্শকের কাছে নায়ক-নায়িকারা ছিল স্বপ্নের মানুষ। তাদের অনুসরণ-অনুকরণ করত। তাদের কথা-বার্তা, পোশাক, চালচলন, হেয়ার স্টাইল ফলো করত। এমনকি সিনেমায় তাদের সংলাপও মুখে মুখে ফিরত। সিনেমার সাদাকালো যুগ থেকে রঙ্গিন যুগ পর্যন্ত দর্শকের মধ্যে প্রিয় নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে এমন উচ্ছ¡াস চলত। একেক নায়ক-নায়িকার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে চলত তর্ক-বিতর্ক। এসবই হতো পর্দায় তাদের অভিনয় এবং উপস্থিতি দেখে। নায়ক-নায়িকারা ছিলেন দর্শকের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সিনেমা ছাড়া বাস্তবে তাদের দেখা পাওয়া ছিল স্বপ্নের মতো। অনেকে নায়ক-নায়িকাকে নিয়ে কল্পনার সাগরে ভেসে নিজের মনের মানুষকে নিয়ে স্বপ্ন দেখত। দর্শকের মধ্যে নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে এখন সেই উন্মাদনা ও স্বপ্নের জাল বোনার সুযোগ নেই। এখন তারা পর্দার নায়ক-নায়িকাদের সহজেই বাস্তবে দেখতে পান। সিনেমা হলে ঢোকা কিংবা পদার্য় দেখার আগেই তাদের দেখে ফেলেন। তারা সিনেমা হলে গিয়ে সহজেই দর্শকের সাথে মিশছেন, ছবি তুলছেন এবং নিজেদের সহজলভ্য করে তুলেছেন। প্রশ্ন এসে যায়, তাহলে পয়সা দিয়ে টিকেট কেটে কেন তাদেরকে পর্দায় দেখতে হবে? পর্দায় দেখার আগেই তো বাস্তবে তাদের সাথে কথা-বার্তা ও ছবি তোলা হয়ে যাচ্ছে। তাদের সম্পর্কে ধারণা হয়ে যাচ্ছে। তারা যে বিশেষ কেউ, এ ধারণা কিছুটা হলেও কমে যাচ্ছে। এতে দর্শক বাস্তবে এবং পর্দার নায়ক-নায়িকাদের সাথে পার্থক্য খোঁজার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। অথচ তাদের শুধু পর্দায়ই দেখার কথা। রহস্য মানব-মানবী হয়েই থাকার কথা। তা হচ্ছে না। এতে শিল্পী ও শিল্পের মান বিবেচনার দিক থেকে কতটা উন্নতি হচ্ছে সেটাই ভাবার বিষয়। আমাদের চলচ্চিত্রে যেসব নায়ক-নায়িকা কালজয়ী হয়ে আছেন, তাদের কিন্তু পর্দায় ছাড়া বাস্তবে এত সহজে দেখা যেত না। ফলে এখনও তারা দর্শকের স্বপ্নের মানুষই হয়ে আছেন। এমনকি মৃত্যুর পরও অনেকে দর্শকের মনে বাস্তবে একনজর দেখার আফসোস হয়ে রয়েছেন। রাজ্জাক, ওয়াসিম, শাবানা, কবরী, সোহেল রানা, জাফর ইকবাল, উজ্জ্বল, ফারুক, আলমগীর, ববিতা, সুচন্দা, শবনম, রোজিনা, সুচরিতা, টেলিসামাদ, মান্না, চম্পা, রুবেল, ডিপজল, শাবনূর, রিয়াজ, ফেরদৌস, দিলদার এমন আরও অসংখ্য শিল্পীদের বাস্তবে দেখা পাওয়া অনেকটা স্বপ্নের মতো। আর সালমান শাহকে বাস্তবে দেখার সুযোগই ছিল না। মৃত্যুর পর এ প্রজন্ম তাকে পর্দায় দেখেই ফ্যান হয়ে রয়েছে। বাস্তবে দেখার আফসোস নিশ্চিতভাবেই রয়ে গেছে। তাদের পরবর্তী এ প্রজন্মের নায়ক-নায়িকারা কি দর্শকের মনে তাদেরকে বাস্তবে দেখার সেই আফসোস সৃষ্টি করতে পেরেছেন? পারেননি। চলচ্চিত্রের প্রতি দর্শকের আকর্ষণ কমে যাওয়ার এটিও একটি অন্যতম কারণ। যাকে বাস্তবে সহজে দেখা যায়, তাকে পর্দায় দেখার আগ্রহে কিছুটা হলেও ভাটা পড়ে। হ্যাঁ, চলচ্চিত্রের সেই স্বর্ণালি সময়ে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া জানতে সিনেমা হলে রাজ্জাক, শাবানা, কবরী, আলমগীর, ববিতা, সুচন্দা, চম্পা, রোজিনা, সুচরিতারা যে যেতেন না, তা নয়। যেতেন। তবে তারা এমনভাবে যেতেন যেন দর্শক কোনভাবেই বুঝতে না পারেন তাদের সাথে বসে সিনেমা দেখছেন তাদেরই স্বপ্নের নায়ক-নায়িকারা। নায়িকারা বোরকা পরে, আর নায়করা ছদ্মবেশ সিনেমা হলে যেতেন। নীরবে বসে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া জানতেন। এ সময়ে নতুন সিনেমা মুক্তি পেলেই হলে হলে ছুটে যান নায়ক-নায়িকারা। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে সময়সূচী। আর তাতে সিনেমা দেখার আগ্রহের চেয়ে বাস্তবে নায়ক-নায়িকা দেখার আগ্রহই বেশি দেখা যায়। সিনেমা হয়ে পড়ে গৌন। যতক্ষণ তারা সিনেমা হলে থাকেন, ততক্ষণ পর্যন্ত দর্শকের ভিড় থাকে। তারপর ফাঁকা হয়ে যায়। আসলে এ সময়ের নায়ক-নায়িকারা দর্শকের কাছে নিজেদের এক্সক্লুসিভ বা ধরাছোঁয়া ও স্বপ্ন হয়ে উঠতে পারছে না। তারা নিজেদের সিনেমা দেখার ট্রেডমার্ক বা আইকনে পরিণত করতে পারছেন না। দর্শকের কাছে সিনেমা দেখার আগ্রহ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে প্রচারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই প্রচার করতে গিয়ে নায়ক-নায়িকাদের বাস্তবে দর্শকের সাথে মিশে যাওয়াতে কি তাদের মান বাড়ছে। চলচ্চিত্রের মানও কি বাড়ছে? স্বপ্নের নায়ক-নায়িকা স্বপ্নেই থাকবে, পর্দায় তাদের দেখা যাবে, এটাই তো হওয়া বাঞ্ছনীয়। সিনেমার গল্প, নির্মাণ ও তাদের অভিনয় গুণেই তো সিনেমা চলার কথা। একটা সিনেমার গল্প যদি ভালো না হয়, তার প্রচারের জন্য নায়ক-নায়িকাদের সিনেমা হলে গিয়ে দর্শকদের সঙ্গে ছবি তুলে বা মিলেমিশে একাকার হওয়ার পর যখন সিনেমাটি দেখে তারা হতাশ হবে, তখন কি আর তাদের প্রতি আগ্রহ থাকবে? বরং তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলে সিনেমা ভালো না হলেও তাদের পরের সিনেমা দেখার আগ্রহ থেকে যাবে। নায়ক-নায়িকাদের উচিৎ ভালো গল্প আর অভিনয় দিয়ে দর্শক আকর্ষণ করা। নিজেদের এক্সক্লুসিভ করে রাখা। এভাবে প্রকাশ্যে এসে নিজেদের রহস্যের মোড়ক খুলে দিয়ে খেলো করে ফেলা উচিৎ নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন