শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সাংবাদিক-পুলিশ-বিত্তবানরাও মাদক সাপ্লাইয়ে জড়িত : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

সংক্রামক রোগের মতো মাদকসেবীর বিস্তার ঘটছে

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০৭ এএম

সংক্রামক রোগের মতো মাদকসেবীর বিস্তার ঘটছে। দেশে ৭০ লাখের বেশি মাদকসেবী রয়েছে। জেলখানাগুলোতে থাকা গড়ে দৈনিক ৮০ হাজার থেকে ১ লাখের মতো হাজতির ৬০ শতাংশই মাদক কারবারি। যুব সমাজকে ভেঙে দেয়ার জন্য একমাত্র মাদকই যথেষ্ট। মাদকের ভয়াবহতা থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে না পারলে আমরা আগামীর যে স্বপ্ন দেখছি তা স্বপ্নই থেকে যাবে। মাদকাসক্তকে রোগ মনে করে এর চিকিৎসা করাতে হবে। সমাজের সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। গতকাল সোমবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে মাদকাসক্তি নিরাময়ে বেসরকারি খাতের ভ‚মিকা শীর্ষক গোলটেবিল সেমিনারে বক্তারা এ অভিমত ব্যক্ত করেন।

সেন্টার ফর গভার্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এ সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, মাদকের সাপ্লাই সাংবাদিক, পুলিশ ও আমাদের মতো বিত্তবানরা করেন। যারা করেন, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসি, কেউ বাদ যায় না। আপনি জেলখানায় গিয়ে দেখুন- মাদকের মামলায় পুলিশের সদস্য যেমন আছে, র‌্যাবের সদস্যও আছে; তেমন অন্য ব্যবসায়ীরাও রয়েছে।

পুলিশ বলে তার জন্য আইন আলাদা হবে, বিষয়টি এমন নয়। পুলিশে নিয়মিত ডোপ টেস্ট করা হচ্ছে। এ টেস্টে পজিটিভ হলে তাকে বরখাস্ত করা হচ্ছে। এ জায়গাটায় আমরা খুব কঠিন অবস্থানে চলে আসছি। চাকরির শুরুতে যারা সিলেক্টেড হবে, তাদেরকে ডোপ টেস্ট করার প্রচলন পুরোপুরি নিতে যাচ্ছি। পুলিশ-বিজিবি সব জায়গায় ডোপ টেস্টের প্রচলন রয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাদকাসক্ত হচ্ছে কি-না সেখানেও মনে হলে আমরা ডোপ টেস্ট করব। নেশা করে মাদক নেয় চিকিৎসক, সাংবাদিক, ইঞ্জিনিয়ার; আমরাও নিয়ে থাকি। চিকিৎসকরা মাদক নেবে না- এমনতো কথা নেই। তারা তো আলাদা জাতি না। দু-একজন পথভ্রষ্ট হতে পারে। মাদকের চাহিদা কমাতে হলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মাদকের কুফল সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে যে স্বপ্ন দেখছি, এই যে আমাদের উন্নয়ন, তার সব বরবাদ হয়ে যাবে যদি মাদকের ভয়াবহতা থেকে আমাদের ভব্যিষৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে না পারি। আমাদের সন্তানেরা অত্যন্ত মেধাবী। সেই প্রজন্মকে যদি মাদকাসক্তি থেকে রক্ষা করতে না পারি, তাহলে আমাদের স্বপ্ন অবাস্তবই থেকে যাবে। মাদকের চাহিদা কমাতে হলে মিডিয়ার অনেকখানি গুরুত্ব রয়েছে। আমরা মাদকের চাহিদা হ্রাসে শুধু ক্রোড়পত্র দেই না, ছোট ছোট টিভিসি বানাচ্ছি। প্রত্যেকটি জেলায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের জনবল ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করছি, ল্যাবও হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই অসাধু লোক রয়েছে মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, হেরোইন উদ্ধারের পর নাকি পরীক্ষায় পাউডার হয়ে যায়, অস্বীকার করছি না। কারণ শুধু পোর্টে কিংবা পুলিশে নয়, সব জায়গাতেই খারাপ-অসাধু মানুষ আছে। সীমান্তেও যেমন চোখ বন্ধ করে অনেকে আছে, তেমনই পুলিশেও অসাধু কেউ মাদক উদ্ধারের পর পাউডার দিচ্ছে ল্যাবে, এটাও সত্য।

দেশের জেলখানার ৬০ শতাংশ বন্দিই মাদককারবারি জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, শক্তিশালী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন করেছি। সারা বাংলাদেশে জেলখানার ধারণক্ষমতা আছে ৪১ হাজারের বেশি। কিছুদিনের মধ্যে এটা আরো বাড়বে। কিন্তু সবসময় থাকে ৮০ হাজার থেকে লাখের বেশি বন্দি, আর এর মধ্যে ৬০ শতাংশই মাদক ব্যবসায়ী। বিচারের সময় সাক্ষী পাওয়া যায় না, আর আমাদের লম্বা জট লেগেছে মামলার। সেখানে এই মাদক মামলা হারিয়ে যায়। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল চেয়েছি মাদক মামলার জন্য, যদিও আমরা সেটা এখনো পাইনি। যদি শাস্তিটা দৃশ্যমান হতো, তাহলে ডিমান্ড হ্রাস ও সাপ্লাই কমে যেত। মাদকের সরবারাহ কমাতে বিজিবি, কোস্ট গার্ডের সক্ষমতা ও জনবল বৃদ্ধি করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, বর্ডারে এখন অনেক কিছু করতেছি। টেকনাফে দেখেন নাফ নদীর যে বর্ডার তা দুর্গম, সেখানে বিওপি থেকে বিওপি যেতে সময় লাগে। সেন্সর লাগানো হচ্ছে সমস্ত বর্ডারে; হেলিকপ্টার টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে মাদকের সাপ্লাই বন্ধ করা সম্ভব হয়।

দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০ লাখ বলে ধারণা দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যথাযথ চিকিৎসা না থাকার কথাও বলেন। এজন্য ভালো হাসপাতাল নেই। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে অভিজ্ঞ ডাক্তার নেই, সাইকিয়াট্রিস্ট নাই। বেসরকারি খাতে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র চালুর জন্য সরকারিভাবে সহায়তা করার আশ্বাস দেন তিনি।
জাতীয় পার্টি নেতা এবং সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, অস্ত্র, সোনা ও মাদক ব্যবসায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হওয়া যায়। সংক্রামক রোগের মতো আজ মাদকসেবীর সংখ্যা বাড়ছে। তালেবানরা হেরোইন তৈরি করেছে কিন্তু সেবন করেনি। মায়ানমারও তা-ই করছে। সরকারি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা হচ্ছে না। উল্টো সময় নষ্ট হচ্ছে। শিশুদের কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখতে হবে। সামাজিক অবক্ষয় রোধে গোটা সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, মাদক সেবন একটি সামাজিক সমস্যা। এটাকে সামাজিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। বিশেষ করে ৮ম-নবম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে মাদকের ভয়াবহতা ও ক্ষতিকর দিক নিয়ে বেসিক ধারণা থাকতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রাখা দরকার বাধ্যতামূলকভাবে।

অ্যাথেনা মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও মানষিক স্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্রের মেন্টাল হেলথ কাউন্সেলর নুসরাত সাবরিন চৌধুরী বলেন, একমাত্র সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে সমাজ পরিবার সবাই মিলে, সর্বস্তরের সমন্বয়ে ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। তিনি বলেন, বিপুল সংখ্যক মাদকসেবীর বেশিরভাগই কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। মাদকাসক্তিকে অপরাধ বা নৈতিক সঙ্কট হিসেবে না দেখে একে রোগ হিসেবে দেখতে হবে। একইসাথে এ রোগের যথাযথ চিকিৎসা করাতে হবে। প্রথমে পরিবার থেকেই সচেতনতা বাড়াতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো আলোচনা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট এবং ছোট ভিডিওর মাদ্যমে পোস্ট করে প্রচারণা করা দরকার। যেহেতু এখন মাদকের কেনা বেচার একটা বড় অংশই হচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে।

বিজিবি’র সাবেক মহাপরিচালক লে.জে. (অব.) মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম বলেন, সরকার মাদকের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স বললেও মায়ানমার থেকে প্রতিনিয়ত মাদক আসছে। আগে মাদক আসার পথ বন্ধ করতে হবে। দেখেছি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে যে চিকিৎসা নিতে যান, তার চুল ছোট করে দেওয়া হয়, কেটে দেওয়া হয়, পানি দেওয়া হয়, এতে মাদকাসক্তের মানসিক দিকে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

প্রফেসর ড. অরুপ রতন চৌধুরী বলেন, ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী ইয়াবা আসক্ত। প্রথমেই ধূমপান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিশু ও নারীদের মধ্যে মাদক সেবনে আসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। আমার হিসাবে দেশে ১ কোটি মানুষ মাদকাসক্ত, ৭০ বা ৭৫ লাখ নয়।

সিজিএস’র চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় আরো অংশগ্রহণ করেন, এনবিআর’এর সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ, অর্থনীতিবিদ ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, পুলিশের সাবেক আইজিপি ড. এনামুল হক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মোজাহেরুল হক এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব নাঈমুল ইসলাম খান। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন সিজিএস’এর নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন