বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন নীতি কি ব্যর্থ হয়েছে?

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০৩ এএম

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর ‘কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন’, এমন একটি মতের উদ্ভব হয়। এর আগে এ ধরনের মত কখনো উত্থাপিত হয়নি। কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম উপাদানই ছিল ‘গণতন্ত্র’। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা ছিল এর লক্ষ্য। গণতন্ত্র থাকলে যেমন শাসন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকে, তেমনি উন্নয়নের ভিত্তিও দৃঢ় হয়। দুর্নীতি, অপশাসন, স্বৈরশাসন কিংবা কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে মুক্ত থাকা যায়। গণতন্ত্রের পথ সংকুচিত বা রুদ্ধ হলে নানা প্রকার অপসংস্কৃতি গেড়ে বসে। বিশ্বের যেসব দেশ গণতন্ত্র ধারণ করেছে, সেসব দেশে মানুষের অধিকার যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তেমনি উন্নয়নও টেকসই হয়েছে। যারাই গণতন্ত্রকে সংকুচিত, বাক্সবন্দী করে উন্নয়ন করতে গিয়েছে, তাদের কারো পরিণতিই ভালো হয়নি, উন্নয়নও টেকসই হয়নি। সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে, শ্রীলঙ্কা। রাজাপাকসে সরকার বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর এমনই শাসন ব্যবস্থা কয়েম করেছিল যে, দেশটিকে শেষ পর্যন্ত দেউলিয়া হয়ে যেতে হয়েছে। সরকার উন্নয়নকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে যেসব অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করেছিল, সেখানে জবাবদিহির পরিবর্তে দুর্নীতির মচ্ছব চলেছিল। ব্রিজ, সড়ক, স্টেডিয়াম, বন্দরের মতো বড় বড় প্রকল্প নিয়ে সেগুলোকে অর্থ লুটের উৎসে পরিণত করা হয়েছিল। বৈদেশিক ঋণ দেশকে ঋণের সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছিল। যখন ঋণ পরিশোধ করা শুরু হয়, তখন দেখা যায়, দেশটির মূলধন বলতে কিছু নেই। অভাব-অনটন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে শুরু করে জনগণের না খেয়ে থাকার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সরকার উন্নয়ন করছে দেখানোর জন্য যেসব উন্নয়নমূলক প্রকল্প নিয়েছিল, সেগুলো মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের ভিত্তি হতে পারেনি। গণতন্ত্রকে উপেক্ষা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত না করার কারণে দেশটির এ পরিণতি হয়েছে।

দুই.
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই এমন ধারণা নিয়ে শাসন কাজ পরিচালনায় মনোনিবেশ করে যে, উন্নয়ন করতে গেলে, অবাধ গণতন্ত্র তাতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। নানা সমালোচনা ও জবাবদিহির নামে উন্নয়নকাজ ধীর ও বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। এর পরিবর্তে বিরোধীদলকে দমিয়ে কোণঠাসা করে উন্নয়ন কাজ করে যেতে হবে, যাতে এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন, আন্দোলন বা সমালোচনা করা না যায়। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে যাবে। উন্নয়ন যেমন হবে, তেমনি বিরোধীদলের প্রতি মানুষের অনাস্থাও বাড়বে। মানুষের মধ্যে এমন ধারণার উদ্ভব হবে, সরকার ভালো করছে, বিরোধীদলের আন্দোলন-সংগ্রামের দরকার কী! সরকার উন্নয়নের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়ার জন্য বিরোধীদলের স্বাভাবিক রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে সংকুচিত করার পলিসি নিয়ে এগুতে থাকে। এমন এক কঠোর নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে পদ্মাসেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর, চার-ছয় লেনের সড়ক-মহাসড়কসহ বড় বড় উন্নয়নমূলক প্রকল্প হাতে নেয়। বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে কুইক রেন্টাল স্থাপনসহ ভারত থেকে বিদ্যুৎ এবং অন্যদেশ থেকে গ্যাস আমদানি নীতি অবলম্বন করে। দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়। বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের উৎসবও পালন করা হয়। এমনকি সঞ্চালন লাইনের অভাবে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না বলেও বলা হয়। অন্যদিকে, ধান-চাল, মাছ, গবাধিপশু, শাক-সবজি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কথা বলা হয়। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা দেখাতে শ্রীলঙ্কায় চাল রফতানি করা হয়। প্রতিবছর উত্তরোত্তর মাথাপিছু আয় ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান পরিবেশন করা হয়। জাতীয় বাজেটের আকারও বৃদ্ধি করা হয়। স্লোগান দেয়া হয়, বিশ্বে ‘বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল’। সরকারের পরিকল্পনামতো সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় করোনা মহামারি। এই মহামারিতে পুরো বিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বিপুল ক্ষতির মুখে পড়ে। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতে ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা অর্থনীতিকে আরও বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেয়। অর্থনীতির ভিত্তিটি দুর্বল হয়ে পড়ে। এখন পরিস্থিতি এমন যে, সঞ্চয় ভেঙে খেতে খেতে সাধারণ মানুষ নিঃস্ব অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। পণ্যমূল্য ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় খরচ কমিয়েও তাদের টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। সরকার বরাবরই উন্নয়নের পরিসংখ্যান নির্ভরশীল। তবে এ সময়ে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কী, তার কোনো পরিসংখ্যান দিতে দেখা যায় না। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী বুঝতে অসুবিধা হয় না, সাধারণ মানুষ অত্যন্ত শোচনীয় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছে। আয়ের সাথে ব্যয় সংকুলান করতে পারছে না। দেশের দারিদ্র্যসীমা বসবাস করা মানুষ প্রায় ৪৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। এ হিসেবে দেশের প্রায় সাড়ে ৬ কোটির বেশি মানুষ দরিদ্র হয়ে গেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকে গিয়ে ঠেকেছে। অসংখ্য নিম্নবিত্ত দরিদ্র, মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে পরিণত হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় প্রায় প্রতিদিনই মানুষের কষ্টের জীবন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। এসব প্রতিবেদনের কেস স্টাডি থেকে জানা যায়, সন্তানদের আগে যে খাবার দিতে পারত, এখন সে খাবার দিতে পারছে না। সন্তানের চাহিদামতো খাবার দিতে না পারায় বাবা-মায়ের কষ্ট সীমাহীন হয়ে পড়েছে। গত সপ্তাহে একটি চ্যানেলের বাজার প্রতিবেদনে দেখানো হয়, জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় এক বয়স্ক মানুষ তার চাহিদামতো খাদ্যপণ্য কিনতে পারছেন না। ‘কীভাবে বাঁচব’ এবং ‘আল্লাহ সহায় না হলে বাঁচতে পারব না’ বলে তিনি কেঁদে ফেলেন। আরেক ব্যক্তি বলেন, আগে মাসের বাজার খরচ বাবদ ত্রিশ হাজার টাকা লাগত, এখন এ খরচ বেড়ে হয়ে গেছে পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি। এ দুটি বাস্তব ঘটনা থেকে বোঝা যায়, নিম্নবিত্ত মানুষ দরিদ্র হয়ে গেছে এবং উচ্চ মধ্যবিত্তও খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। তবে উচ্চবিত্তদের এ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তাদের অঢেল অর্থের কিছু বাড়তি অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এ সংখ্যাটা জনসংখ্যার এক-দুই শতাংশের বেশি নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, জনসংখ্যার অর্ধেক যখন দরিদ্র হয়ে পড়ে তখন তার বোঝা এত ভারি হয় যে, এর পুরো ভার অর্থনীতির উপর পড়ে। অর্থনীতিকে নিচের দিকে টেনে ধরে। অর্থনীতির গতি হয়ে পড়ে ধীর। আমরা যে উন্নয়নশীল কিংবা মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হয়েছি, এখন সেই ক্যাটাগরিতে রয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যে রিজার্ভ নিয়ে এতদিন গর্ব করা হতো, সেই রিজার্ভে এখন টান ধরেছে। দিন দিন কমছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ৪২ বিলিয়ন ডলার থেকে নেমে ৩৬ বিলিয়নে নেমেছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশের অর্থনীতি নিম্নমুখী।

তিন.
একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়, জনগণের জীবনমানের টেকসই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা। এ উন্নয়ন এমনই যে, হঠাৎ সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিপর্যয় ঘটলেও তার প্রভাব জনগণের জীবনমানের ওপর পড়লেও তা ততটা তীব্র হবে না। হঠাৎ করে দরিদ্র হয়ে যাবে না। আমাদের দেশে এ উন্নয়নটি যথাযথ বা টেকসইভাবে হয়নি। হলে হুট করে দারিদ্র্যসীমা এক লাফে দ্বিগুণের বেশি হয়ে যেত না। সাধারণ মানুষের মধ্যে হাহাকার সৃষ্টি হতো না। বিগত প্রায় চৌদ্দ বছর ধরে সরকার যে উন্নয়ন করেছে এবং তার ফানুস উড়িয়েছে, সেটাও ফুস করে চুপসে যেত না। এই চৌদ্দ বছরে যে উন্নয়ন হয়নি, তা নয়। তবে টেকসই উন্নয়ন বলতে যা বোঝায়, তা হয়নি। মনুমেন্টাল বা স্থাপত্যগত উন্নয়নকেই ব্যাপক পরিসরে তুলে ধরা হয়েছে। পরিসংখ্যান দিয়ে উন্নয়নের চিত্র দেখানো হয়েছে। বলা বাহুল্য, সব পরিসংখ্যান উন্নয়নের প্রকৃতচিত্র তুলে ধরে না। সরকারের পরিসংখ্যান নিয়ে সবসময় প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ, সব সরকারেরই উন্নয়নচিত্র ঊর্ধ্বমুখী দেখাতে হয়। এই যেমন, জিডিপির হার নিয়ে সরকার যে চিত্র দেখায়, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ দেশের অর্থনীতিবিদদের চিত্রের সাথে তা মেলে না। তাদের চিত্র সরকারের হিসাবের চেয়ে কম থাকে। মানুষ সরকারের হিসাব নয়, বেসরকারি হিসাবটাই বেশি গ্রহণ করে। চৌদ্দ বছরে সরকারের উন্নয়নের চিত্রটি এই সময়ে এসে ফিকে হয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পর আমাদের দেশ শ্রীলঙ্কার মতো হবে কিনা, এমন বিতর্কে বেসরকারি সংস্থা সিপিডি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিল, এখন না হলেও আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে ওরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এখন অনেকে বলছেন, ইতোমধ্যে ভেতরে ভেতরে শ্রীলঙ্কা হয়ে গেছে। সরকারের কাছে টাকা নেই। দেশ চালাতে সমস্যা হচ্ছে। দেশ চালাতে গিয়ে অর্থের সংস্থান করতে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ অন্যান্য সেবাখাতে দাম বৃদ্ধি করাসহ বিভিন্নভাবে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে অর্থ কেড়ে নিচ্ছে। এতেই জনগণ চরম অভাব-অনটনের মধ্যে পড়েছে। অন্যদিকে, অসাধু ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার কিছু করতে পারছে না এ কারণে যে, সরকারও ব্যবসায়ীদের কাছে কোনো না কোনোভাবে ধরা খেয়ে আছে। দেখা যাচ্ছে, বিগত চৌদ্দ বছর ধরে যে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, তার ভিত্তি শক্ত হয়নি। অর্থনীতিবিদরা বহু বছর ধরে সরকারকে টেকসই উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে। সরকার তা আমলে নেয়নি। ফলে যে উন্নয়ন হয়েছে, তা করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধে অনেকটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ার মধ্যে রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন হলে মন্দাবস্থার সৃষ্টি হতো, তবে একেবারে শোচনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। সরকার কথায় কথায় উন্নত বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার কথা বললেও, সেসব দেশের উন্নয়নের ভিত্তিটা এত শক্ত যে তা সাময়িকভাবে টললেও দ্রুতই সোজা হয়ে যায়। সেসব দেশের সাথে আমাদের অর্থনীতির তুলনা করা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। টেকসই উন্নয়নের অন্যতম উপাদান হচ্ছে, উৎপাদন খাত সৃষ্টি ও রফতানি বৃদ্ধি করা। আমাদের দেশে রফতানি খাতের মধ্যে উল্লেখ করার মতো দুটি খাত রয়েছে। একটি গার্মেন্ট, আরেকটি জনশক্তি রফতানি। গার্মেন্ট থেকে মোট রফতানির ৮৩ ভাগ আয় হয়। দেখা যাচ্ছে, গার্মেন্ট ও জনশক্তি ছাড়া এমন আর কোনো খাত বিগত চৌদ্দ বছরে সৃষ্টি করা যায়নি, যা এ দুটির সাথে উল্লেখ করা যায়। বরং রফতানি খাত বাড়ানোর পরিবর্তে আমদানি খাত বেশি খোলা হয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, চাল, ডাল, তেল, শিশু খাদ্যসহ এমন কোনো পণ্য নেই, যার আমদানি বৃদ্ধি পায়নি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলা হলেও এখন লাখ লাখ টন চাল ও গম আমদানি করতে হচ্ছে। অথচ, দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান খাত হচ্ছে রফতানি। তা বৃদ্ধি না করে আমদানি নির্ভরতা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যে গ্যাস সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে, সেই গ্যাসও আমদানি নির্ভর করা হয়েছে। অথচ, দেশের গ্যাস ক্ষেত্রগুলো খননের উদ্যোগ নেয়া হলে, সংকট অনেকটাই সামাল দেয়া যেত। আমদানি নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ করার কারণে এ খাতটি এখন নাজুক হয়ে পড়েছে। টেকসই হয়নি। কুইক রেন্টাল নিয়ে যাতে প্রশ্ন তোলা না যায়, এজন্য ইনডেমনিটি দেয়া হয়েছে। এমন চুক্তি করা হয়েছে যে, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র বিদ্যুৎ সরবরাহ না করলেও সরকারকে দাম দিতে হচ্ছে। ফলে এসব প্রকল্পের মালিকরা যা খুশি তা করেছে। কারো কারো বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগও উঠেছে। একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক তো সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে। তার সম্পদের পরিমাণ ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। বলা হয়, তার বেশিরভাগ অর্থ পাচার করে নেয়া। তাহলে, গণতন্ত্র ও জবাবদিহি সংকুচিত করে কী উন্নয়ন হলো? বরং সরকারের নীতির বিরুদ্ধে যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে, এজন্য নিবর্তনমূলক আইন করে মতপ্রকাশ ও বাকস্বাধীনতাকে সংকুচিত করে সরকার যা খুশি তা করার প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে। ফলে সরকার যেসব উন্নয়নমূলক প্রকল্প নিয়েছে, সেগুলো টেকসই উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। প্রকৃত উন্নয়নের পরিবর্তে সরকারের কথার উন্নয়ন বেশি হয়েছে। কথা দিয়ে যে চিড়া ভেজে না, তা এখন সাধারণ মানুষের জীবনে টানাপড়েন ও দুর্বিষহ হয়ে উঠা থেকেই বোঝা যাচ্ছে।

চার.
গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে বা রুদ্ধ করে কোনো দেশ যে উন্নতি করেনি তা নয়, করেছে। তবে তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা এমনই যে, তাতে সততা যেমন ছিল, তেমনি অর্থনীতি ও মানুষের জীবনমানের উন্নয়নও টেকসই হয়েছে। ফলে এ নিয়ে তাদের জনগণের মধ্যে কোনো অসন্তুষ্টি নেই। যদি গণতন্ত্র দমিয়ে উন্নয়ন টেকসই না হতো, তাহলে সেসব দেশের সরকার কোনোভাবেই টিকে থাকতে পারত না। আমাদের সরকার এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে গিয়ে তা করতে পারেনি। উল্টো দেশের অর্থনীতির অবনমন ঘটেছে। এমনই উন্নয়ন হয়েছে যে, একটি শ্রেণি অঢেল সম্পদ ও বিত্তের মালিক হয়েছে এবং তাদের অনেকে অর্থপাচার করে বিদেশে বিনিয়োগ ও বাড়ি-ঘর করেছে। সেখানেই তাদের স্থায়ী বসবাসের ঠিকানা করেছে। এদের সরকার ঠেকাতে পারছে না। এর কারণ, সরকারই তাদের প্রশ্রয় দিয়েছে। সরকার যে এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বমুখী দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না এবং বাজার স্থিতিশীল রাখতে পারছে না, তার কারণ, যাদের নিয়ন্ত্রণ করবে তাদের দ্বারাই সরকার সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছে। ফলে সরকারেরও বলার কিছু থাকছে না। একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের উন্নয়নের দিকটি উপেক্ষা করতে হয়েছে। এটা হয়েছে ‘কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন’ নীতির কুফলের কারণে। যদি গণতন্ত্র, সুশাসন ও জবাবদিহির জায়গাটি নিশ্চিত করে উন্নয়নের পথে হাঁটত, তাহলে উন্নয়ন যেমন টেকসই হতো, তেমনি সাধারণ মানুষেরও জীবনমানের উন্নয়ন ঘটত। এমন দুর্ভোগে তাদের পড়তে হতো না।

darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন