আমাদের অনেকেরই বিভিন্ন ধরনের বদ-অভ্যাস রয়েছে যার কারনে আমাদের দাঁত ও মুখের ক্ষতি হয়। এ ধরনের বদ-অভ্যাস অবশ্যই বর্জন করতে হবে। দাঁতের সুরক্ষায় যা কিছু করনীয় এবং বর্জনীয় তা সবার জানা প্রয়োজন।
১. দাঁত দিয়ে দাঁত ঘষা বা দাঁত কামড়ানো ব্রুকসিজম নামে পরিচিত। যারা দাঁত কামড়ানোজনিত সমস্যায় আক্রান্ত তারা সাধারনত রাতের বেলায় ঘুমের মধ্যে দাঁত কামড়ায়। দাঁত কামড়ানোর লক্ষণগুলো হলো চোয়ালে ব্যথা, কানে ব্যথা, মাথা ব্যথা এবং দাঁত ফেটে যাওয়া বা দাঁতে ফাটল ধরা। দাঁত কামড়ানোর পুরোপুরি কারন জানা যায়নি। তবে মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, নাক ডাকা অন্যতম। এছাড়া ক্যাফেইন, এলকোহল এবং নিকোটিনের ব্যাবহার দাঁত কামড়ানোতে ভুমিকা রাখে। দাঁত কামড়ানোর জন্য প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে মাউথ গার্ড ব্যাবহার কার্যকরী। কখনো কখনো মাউথ স্প্লিন্ট ব্যাবহার প্রয়োজন হতে পারে দাঁত কামড়ানোর হাত থেকে দাঁত ও মুখের অন্যান্য অংশকে রক্ষা করার জন্য।
ঘরোয়া চিকিৎসাঃ ঘুমানোর আগে কুড়মুড়ে বা মচমচে স্ন্যাকস খাওয়া যেতে পারে। চিবানোর কারনে চোয়ালের মাংসপেশী শিথিল বা রিলাক্স হয় যার কারনে রাত্রিবেলা আপনার দাঁত কামড়ানোর সম্ভাবনা কম থাকবে। চোয়ালের উপর হালকা উষ্ণ কমপ্রেস প্রয়োগ করা যেতে পারে মাংসপেশী রিলাক্স করার জন্য। নিয়মিত ইয়োগা অথবা মেডিটেশন করতে হবে মানসিক চাপ কমানোর জন্য। এভাবে ঘরোয়া পদ্ধতিতে চেষ্টা করা যেতে পারে দাঁত কামড়ানোর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। ঔষধের মধ্যে মাসল রিলাক্সজেন্ট জাতীয় ঔষধ এবং ক্লোনাজিপাম দাঁত কামড়ানো রোগীদের ক্ষেত্রে বেশ কাজে আসে।
২. বরফ চোষাঃ বরফ চোষা অথবা কামড়ানো দাঁতের জন্য ক্ষতিকর। এতে করে দাঁতের এনামেলে ছোট ক্র্যাক বা ফাটল দেখা দিতে পারে যা সময়ের সাথে সাথে বড় আকার ধারন করে এবং সবশেষে দাঁতে ফ্র্যাকচার দেখা যায়।
মাউথ গার্ড ব্যাবহারঃ সব ধরনের খেলাধুলাতে ইনজুরি বা আঘাত অথবা ডেন্টাল ইনজুরির ঝুঁকি থাকে। স্পোর্টস মাউথ গার্ড ব্যাবহার কমন ডেন্টাল ইনজুরির ঝুঁকি কমায় যেমন দাঁতের ফ্র্যাকচার, বের হয়ে যাওয়া দাঁত, টেম্পেরোম্যাণ্ডিবুলার জয়েন্ট স্থানচ্যুত হওয়া। তাই স্পোর্টস মাউথ গার্ড ব্যাবহার করা প্রয়োজন।
৩. ঘুমানোর সময় বোতল মুখে রেখে ঘুমানো শিশুদের জন্য ক্ষতিকর। দুধ-দাঁত অস্থায়ী হলেও সেগুলো পুষ্টির জন্য এবং ভবিষ্যৎ স্থায়ী দাঁতের পথ প্রস্তুত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘুমানোর সময় বোতল দিয়ে দুধ খাওয়ালে দাঁতে ক্ষয় হতে পারে। দাঁতের এই ক্ষয়কে নার্সিং বোতল ক্যারিজ বা বেবি বোতল টুথ ডিকে বলা হয়। দুধে চিনি থাকে যা ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ব্যাকটেরিয়া এসিড তৈরি করার মাধ্যমে দাঁতের ক্ষয় করে থাকে। শিশুকে দুধ খাওয়ানোর পর গজ বা পরিষ্কার পাতলা কাপড় দিয়ে দাঁত এবং মাড়ি পরিষ্কার করে দিতে হবে। আর অন্য একটি বোতলে একটু পানি নিয়ে খাওয়াতে হবে। তাহলে মুখের অভ্যন্তর ভাগ পরিষ্কার হয়ে যাবে। কাশির জন্য যে সিরাপ সেবন করা হয় সেখানে যদি চিনি মিশ্রিত থাকে তাহলে তা আপনার দাঁতের ক্ষয় সৃষ্টি করবে। কাশির সিরাপ সেবন করার সময় চিনি মিশ্রিত সিরাপ আপনার দাঁতে লেগে থাকে। অনুকূল পরিবেশে চিনি ব্যাকটেরিয়ার বংশ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং এসিড সৃষ্টির মাধ্যমে দাঁতের ক্ষয় করে থাকে। তাই কাশির সিরাপ সেবন করতে হলে চিনিমুক্ত সিরাপ সেবন করাই শ্রেয়। যদি আপনি চকোলেট, ললিপপ, আঠালো ক্যান্ডি খেতে পছন্দ করেন তাহলে এগুলো খাওয়ার সময় দাঁতের সাথে লেগে থাকে। এর ফলে বিদ্যমান চিনি ব্যাকটেরিয়ার বংশ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। আঠালো ক্যান্ডি অনেক সময় ধরে দাঁতে লেগে থাকে। তাই ব্যাকটেরিয়া সময় নিয়ে দাঁতের এনামেলের ক্ষয় করে থাকে। দাঁতের ক্ষয় থেকে রক্ষা পেতে হলে চকোলেট, ক্যান্ডি পরিহার করতে হবে। প্রয়োজনে চিনিবিহীন বা সুগারলেস চুইংগাম চোষা যেতে পারে। সোডা পান আপনার দাঁত ও শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এটি উচ্চমাত্রায় চিনির একটি উৎস। চিনিযুক্ত সোডা দাঁতের ক্ষয় বৃদ্ধি করে থাকে। সোডাতে রয়েছে উচ্চ মাত্রায় ফসফরিক এসিড এবং সাইট্রিক এসিড যা দাঁতের এনামেলের ক্ষয় করে থাকে। আর সোডা যদি একান্তই খেতে হয় তাহলে পাইপ (স্ট্র) দিয়ে পান করলে দাঁতে লাগলেও খুব সামান্য পরিমানে লাগে। সোডা পান করার পর পানি দিয়ে কুলি করলে দাঁতে লেগে থাকা চিনি অপসারিত হয়। সোডা পান করার ৩০ মিনিট পর দাঁত ব্রাশ করবেন। কারন, সোডা পান করার পর দাঁতের এনামেল তুলনামূলকভাবে নরম থাকে। তাই সাথে সাথে দাঁত ব্রাশ করলে দাঁতের এনামেলের ক্ষতি হতে পারে। সোডা পান ডায়াবেটিস এবং মোটা হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে থাকে। দাঁত দিয়ে বোতলের মুখ খোলা উচিত নয়। এতে করে দাঁতের এনামেলে ফ্র্যাকচার হতে পারে। আবার সামনের দাঁতের কোনো ফিলিং আংশিক উঠে যেতে পারে।
৪. সোডার মত স্পোর্টস ড্রিংকে রয়েছে চিনি এবং এসিড যা দাঁতের ক্ষয় করতে পারে। স্পোর্টস ড্রিংক পান করার ২০ মিনিট পর্যন্ত তা দাঁতের ক্ষতি করতে পারে। সোডার চেয়ে স্পোর্টস ড্রিংকে কম চিনি রয়েছে। এই কারনে স্পোর্টস ড্রিংক তুলনামুলকভাবে মিষ্টি কম। কেউ যদি স্পোর্টস ড্রিংক বেশি পান করে তাহলে তা ডায়াবেটিস এবং মোটা হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে থাকে। কারন, বেশি পান করলে চিনি বেশি খাওয়া হচ্ছে।
৫. কিছু ফলের রসে সুগারের পরিমান সোডায় বিদ্যমান সুগারের মত। উচ্চ চিনিযুক্ত ফলের রস দাঁতের ক্ষয়ের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে থাকে। সাইট্রাস জুস যেমন অরেঞ্জ জুস এবং লেমনয়েড এসিডিক হওয়ায় দাঁতের এনামেলের ক্ষয় করতে পারে। ফলে বিদ্যমান চিনি, এসিড এবং ক্যালরি সব সময় শরীর ও দাঁতের জন্য ভালো নয়। স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে ফলের রস পান করলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে।
৬. উচ্চ শ্বেতসার সমৃদ্ধ খাবার দাঁতে লেগে থাকে এবং লম্বা সময় ধরে উপস্থিত থাকে। পটেটো চিপস এর একটি উদাহরণ। এগুলো খাওয়ার পর আমাদের দাঁতের ফাঁকে লম্বা সময় ধরে লেগে থাকে এবং এর ফলাফল অনবরত স্ন্যাকস জাতীয় খাবার গ্রহণের মত। শ্বেতসার জাতীয় খাবার মুখে বিদ্যমান ব্যাকটেরিয়ার খাবার হিসাবে কাজ করে থাকে। ব্যাকটেরিয়া এসিড উৎপন্ন করে এবং এসিড দাঁতের এনামেলের ক্ষয় করে। এর ফলে দন্তক্ষয় শুরু হয়। তবে আপেল বা গাজর খাওয়ার মাধ্যমে দাঁতে লেগে থাকা শ্বেতসার জাতীয় খাবার অপসারন করা যায়। ব্রাশ এবং ফ্লসিং এর মাধ্যমে খাদ্যকনা পরিষ্কার করা যায়।
৭. অনবরত স্ন্যাকস্ জাতীয় খাবার গ্রহণের অর্থ হলো দাঁত বেশি সময় ধরে চিনির সংস্পর্শে থাকা। মুখে বিদ্যমান ব্যাকটেরিয়া চিনিকে খাবার হিসাবে গ্রহণ করে এবং এসিড উৎপাদনের মাধ্যমে দাঁতের এনামেলের ক্ষয় করে থাকে। অনবরত স্ন্যাকস্ জাতীয় খাবার গ্রহণ করার ফলে শুধুমাত্র দাঁতের ক্ষয় হয় না বরং মোটা হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
৮. কাঠপেন্সিল, কলম, ইরেজার, বোতলের মুখ এবং অন্যান্য বস্তু কামড়ানো বা চোষার বদ-অভ্যাস অনেকেরই রয়েছে। এগুলো দাঁতের জন্য ক্ষতিকর। দাঁতের উপর অপ্রয়োজনীয় চাপ পড়ে। এর ফলে দাঁতে ফাটল বা ফ্র্যাকচার দেখা দিতে পারে। এছাড়া বিপজ্জনক ব্যাকটেরিয়া মুখে প্রবেশ করতে পারে। এ ধরনের বদ-অভ্যাসের কারনে মাড়ি এবং নরম কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কলম বা পেন্সিল ক্রমাগত চোষার অভ্যাস থাকলে দাঁত উঁচু-নিচু বা আঁকা-বাঁকা হতে পারে। চোষার অভ্যাস থাকলে জাইলিটল সমৃদ্ধ সুগার ফ্রি গাম চোষা যেতে পারে। জাইলিটল লালা নিঃসরণ বৃদ্ধি করে যা দাঁতের জন্য উপকারী।
৯. ধূমপান দাঁত ও মুখের কোষ এবং শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ধূমপানের ফলে শুষ্ক মুখের সৃষ্টি হয় যার ফলে প্ল্যাক গঠন অধিকতর সহজ হয়। ধূমপান মাড়ি রোগের রিস্ক ফ্যাক্টর। মাড়ি রোগ থেকে পেরিওডন্টাইটিসের কারনে বয়স্কদের দাঁত পড়ে যেতে পারে। ধূমপানের ফলে দাঁতে দাগ পড়তে পারে এবং দাঁতে ক্ষয়ের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। ধূমপানের ফলে মুখ এবং ফুসফুসের ক্যান্সার হতে পারে। তাই ধূমপানের বদ-অভ্যাস বর্জন করতে হবে।
১০. অনেকে সকালে নাস্তার পর কফি দিয়ে দিন শুরু করে। কিন্তু কফি পানের মাধ্যমে শুষ্ক মুখ এবং দন্তক্ষয়ের সৃষ্টি হয়। কফি দাঁতে দাগ সৃষ্টি করে এবং লালা নিঃসরণ কমিয়ে দেয়। লালা এসিডকে নিরপেক্ষ করে। তাছাড়া দাঁতে জমে থাকা খাদ্যকনা অপসারনে সাহায্য করে। চিনি মিশ্রিত কফির মাধ্যমেও দাঁতে ক্ষয় হতে পারে। তাই কফি পান করার পর পানি দিয়ে কুলি করবেন। সম্ভব না হলে একটু পানি পান করবেন। এর ফলে দাঁতের গায়ে লেগে থাকা কফি অপসারিত হবে। সুগারফ্রি গাম চোষা যেতে পারে যাতে করে চিনি সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে। পাইপ(স্ট্র) দিয়ে কফি পান করলে দাঁতে দাগ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে।
১১. লাল ওয়াইনের তিনটি উপাদান ক্রমোজেনস, এসিড এবং ট্যানিন দাঁতের এনামেলের সাথে সংযুক্ত হতে থাকে। ক্রমোজেনস লাল ওয়াইনকে গাঢ় লাল রং দিয়ে থাকে। এসিড দাঁতের এনামেলের ক্ষয় করে থাকে। ট্যানিন মুখ শুষ্ক করে। ফলে লাল পিগমেন্ট বাইন্ডিং হতে থাকে। সাদা ওয়াইনও দাঁতের ক্ষয় করে থাকে। সাদা ওয়াইনেও ট্যানিন ও এসিড রয়েছে। তাই এলকোহলের বদ-অভ্যাস অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে।
মুখ ও দাঁতের সুরক্ষায় সব ধরনের খারাপ অভ্যাস বর্জন করতে হবে। জীবনযাপন স্বাস্থ্যসম্মত হতে হবে। খাবার গ্রহনে সচেতন হতে হবে এবং সর্বোপরি দাঁতের যত্ন নিতে হবে। তাহলে দাঁত ও মুখের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। দাঁত ও মুখের স্বাস্থ্য ভালো থাকলে সার্বিক স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।
ডাঃ মোঃ ফারুক হোসেন
মুখ ও দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ
ইমপ্রেস ওরাল কেয়ার
বর্ণমালা সড়ক, ইব্রাহিমপুর, ঢাকা।
মোবাইলঃ ০১৮১৭-৫২১৮৯৭
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন