শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

দেশে কৃষিপর্যটন বিকাশের সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়ছে

কৃষিবিদ বশিরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা দেশকে নিয়ে বাঙালি গর্ব করে এসেছে আদিকাল থেকেই। গর্বের কারণ হচ্ছে, এদেশের মাঠ-ঘাট, সাগর-নদী-পাহাড়-ঝর্ণা, হাওর-বাওর, পাহাড়, টিলা আর ছায়া সুনিবিড় গ্রাম। এসবের সৌন্দর্যের বর্ণনা পত্রপত্রিকা কিংবা বইপত্রে আছে। পত্রপত্রিকা বা বই পড়ে জ্ঞান লাভ আর ভ্রমণে জ্ঞান লাভের মধ্যে আদিগন্ত তফাৎ বিদ্যমান। তাই জানার নেশায় পর্যটক ঘুরে বেড়ায় দেশ থেকে দেশান্তরে।
এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা কিংবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি দেয়া, থাকা-খাওয়া, বিনোদন সব কিছুর খরচ বহন করতে হয় নিজেকেই। তার ব্যয়িত অর্থই হয় অন্য দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস। কাজেই যে কোনো দেশের জন্য পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগ একটি লাভজনক ব্যাপার। আসলে, পর্যটন এমন একটি শিল্প যেখানে বিনিয়োগ, চাকরি ও আয়ের কোনো সীমা নেই। শুধু অভ্যন্তরীণ পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ঘটিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশ জাতীয় অর্থনীতিতে সুদৃঢ় অবদান রাখছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত হিসেবে গ্রহণ করেছে।
পর্যটনে উৎকর্ষ সাধনের পর্যাপ্ত সুযোগ যেমন আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে রয়েছে, তেমনি রয়েছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। এ ছাড়া এদেশের আবহাওয়া, ভৌগোলিক অবস্থান, নৈসর্গিক স্থান, পরিবেশ সবই পর্যটন শিল্পের অনুকূলে। কৃষিকে সম্পৃক্ত করে এ শিল্পকে বিশেষভাবে বিকাশিত করা যায়।
কৃষিপর্যটন মূলত অবকাশ যাপনের এক ধরনের খামার, যেখানে আতিথেয়তার আয়োজন থাকবে। এক্ষেত্রে একেকটি এক একটি খামার হবে একটা পর্যটন স্থান। সেখানে থাকবে বিভিন্ন ধরনের ফসল, শাকসবজি, ফলমূল অন্যদিকে পুকুরের মাছ, গরু-হাঁস-মুরগির খামার। বাচ্চারা প্রকৃতি ও গাছপালার সঙ্গে পরিচিত হবে। ফ্রেশ এবং নির্ভেজাল ফলমূল, শাকসবজি, নিজ হাতে গাছ থেকে পাড়বে। পুকুর থেকে মাছ ধরবে। সাঁতার কাটবে। কৃষিপর্যটনটি এমনই ক্ষেত্র, যেটি শান্ত, নিরিবিলি আর সবুজে আচ্ছাদিত একটি জায়গা, যেখানে মানুষ দূষণমুক্ত হাওয়ায় তৃপ্তিসহকারে প্রশান্তি অনুভব করতে পারবে। পাশাপাশি কৃষকদের সঙ্গে তাদের স্থানীয় সংস্কৃতিকে উপভোগ করবে। পর্যটকরা বুকিং এর মাধ্যমে সেখানে বিনোদনের জন্য দিনভর কাটাতে পারবে।
ঢাকার অদূরেই কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া গ্রামে গ্রিনারি এগ্রোর খামার। ঢুকতেই চোখে পড়বে বিশাল কয়েকটি পুকুর। এসব পুকুরে চাষ হচ্ছে মাছ। মাছের খাবারে কোনো ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার হয় না। পাশেই রয়েছে সবজিক্ষেত। মৌসুম ভেদে শাক ও সবজি ফলানো হয় এখানে। আরো উৎপাদন হয় মৌসুমি ধান ও গম। রয়েছে দেশীয় ফলের সমাহার। আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, ডাব কী নেই এখানে।
আমের মৌসুমে রংপুরের বদরগঞ্জে পরিবার নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। দেখলাম, সেখানে বিভিন্ন বয়সের মানুষ আম কিনতে এসেছে। গাছগুলোতে ঝুলছে থোকায় থোকায় পাকা আম। আমের ভারে নুয়ে পড়ছে গাছ ডালপালা। বিমুগ্ধ হয়ে ছবি তুলছে অনেকে! আর আমরা বাগান মালিকের অনুমতি নিয়ে গাছ থেকে পাকা আম পেড়ে খাচ্ছি। সে এক অন্য রকম অনুভূতি। আমার চার বছরের মেয়ে আনিসা তো মহা আনন্দে বাগান থেকে আসতেই চাচ্ছিল না। ফ্রেশ আমগুলোর দামও বাজারে তুলনা কম ছিল।
‘কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (এআইপি) সম্মাননা ২০২০ পেয়েছেন মো. শাহাবাজ হোসেন খান মিল্টন। পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার শৌলা গ্রামে নূরজাহান গার্ডেনের সমন্বিত কৃষির মাধ্যমে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার স্বীকৃতিস্বরূপ। তার বাগানে গাছে গাছে নানা জাতের রং-বেরঙের ফল। আছে বাহারি ফুলের থোকা। বেডের মাটিতে বিছিয়ে আছে বিভিন্ন জাতের শাক। পুকুরে পর্যাপ্ত মাছ। বাগানজুড়ে পাখপাখালির মাতামাতি, রঙিন প্রজাপতির ওড়াউড়ি। সেই বাগানের আকর্ষণে প্রতিদিন আসছে শত শত মানুষ। পর্যটকদের পদচারণে মুখর থাকে চারদিক।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পলাশবাড়ী গ্রামে গড়ে উঠা উদ্যোক্তা হাসান আল সাদী পলাশের ড্রিমার্স গার্ডেন। তেরো বিঘা জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির সাড়ে তিনশো আমগাছ। প্রতিটি গাছই পনের থেকে ষোলো বছর বয়সী। সাথে ছয় রঙের টিউলিপ, গাঁদা, গøাডিওলাস, পিটুনিয়া সহ ষোলো প্রজাতির ফুল, যা দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী ভিড় জমাচ্ছে। অবশ্য তার জন্য প্রতিটি দর্শনার্থীদের পঞ্চাশ টাকা মূল্যের টিকিট ক্রয় করতে হচ্ছে।
ইট-পাথরের এ শহরে আজ আমাদের প্রায় নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা যে পরিবেশে বড় করছি; সেটা স্বাস্থ্যকর বা সন্তোষজনক নয়। নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার, প্রকৃতি, মাটির গন্ধ, আলো-বাতাসে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেড়ে উঠবে এটাই সবার প্রত্যাশা। এই প্রত্যাশা পূরণে আমরা পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন জায়গায় কৃষি পর্যটন গড়ে তুলতে পারি। যেমন, পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। রাজধানী থেকে মাত্র এক ঘন্টার দূরত্বে এতদাঞ্চলের পদ্মা অববাহিকার সমৃদ্ধ কৃষিপর্যটন শিল্পের বিনিয়োগও এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। এছাড়া গোপালগঞ্জ ও বরিশাল জেলায় প্লাবনভূমিতে ভাসমান বাগানে কৃষিপর্যটন প্রতিষ্ঠার সুযোগ রয়েছে। ভাসমান বাগান ইউএন এফএও দ্বারা ২০১৬ সালে গেøাবালি ইমপর্টেন্ট এগ্রিকালচারাল হেরিটেজ সিস্টেমস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে এই ক্ষেত্রটি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করা যেতে পারে, যেখানে পর্যটকরা নৌকায় ভ্রমণের পাশাপাশি অর্গানিক শাকসবজি ও ফলের স্বাদ পাবে। সিলেটের জলাভূমি- রাতারগুল, খুলনার সুন্দরবন, পাহাড়ি কৃষি, হাওর অববাহিকায় মাছ ধরা, চা বাগান, দেশের বিভিন্ন এলাকায় হলুদে ভরপুর সরিষা জমিতে মৌ চাষ, দিনাজপুরের লিচু বাগান, যশোরের ফুলের বাগান, নরসিংদীর লটকন বাগান, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, রংপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বাগান সম্ভাব্য কৃষি পর্যটনের ভালো কিছু উদাহরণ। এ ছাড়া ঐতিহ্যগতভাবে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে জুম চাষ এবং গ্রামীণ নারীদের বাড়ির আঙিনায় উৎপাদিত ফসলও জৈব চাষ হিসেবে স্বীকৃত, যার পুষ্টিমান অনেক বেশি।
যদিও আমাদের গ্রামগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ছোঁয়া লেগেছে। তারপরও আমাদের প্রত্যেকটা গ্রামই ট্যুরিস্টদের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে। অনেক গ্রামেই আছে মাছ ধরার জায়গা, ফসলের জমি, গরু- হাঁস-মুরগী খামার। লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করা, ঢেঁকিতে ধান ভাঙ্গানো হচ্ছে, উঠান ঝাড়– দেওয়া, মাছ ধরা, ফসলের ক্ষেতে কাজ করা এগুলো প্রতি বিদেশি ট্যুরিস্টদের আগ্রহ অনেক বেশি এবং তারা উপভোগ করে। কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রামগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা ওয়েবসাইটে প্রচার করে বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি কৃষি পর্যটনের প্রচারে সাহায্য করতে পারে। প্রচারের কৌশল হিসেবে আমাদের ট্রাভেল গাইড, ম্যগাজিনে আকর্ষণীয় এবং সৃষ্টশীল বিজ্ঞাপন ছাপানো যেতে পারে এবং বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর, ট্রাভেল এজেন্ট এবং ট্রাভেল রাইটারদের মাধ্যমে সবাইকে জানাতে পারি।
কৃষিভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন অঞ্চলকে অবশ্যই মূলধারার পর্যটন খাতের স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন এবং এসব স্থান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফসল, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ বিভাগে কর্মরত ব্যক্তিদের পরামর্শ নিয়ে করা উচিত। নীতিমালা প্রণয়নের সুবিধার্থে এবং পর্যটন বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নীতি কাঠামোতে কৃষি পর্যটন স্বীকৃত। জাতীয় কৃষি নীতিমালা ২০১৮ এবং জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতিমালা ২০২০ কৃষি পর্যটনকে উন্নত করার জন্য পরামর্শ দিয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতিমালা কৃষি পর্যটনের সম্ভাবনার কয়েকটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছে।
কৃষিপর্যটনের বদৌলতে আমরা একদিকে যেমন ভোক্তার কাছে কৃষক তার পণ্য বিক্রি করে ন্যায্যমূল্য পেতে পারে, অন্যদিকে ভোক্তাও বিষমুক্ত পণ্য কিনে জীবনমানের উন্নতি করতে পারে। আমাদের দেশে বিভিন্ন বাগান, ফার্ম, খামারবাড়ি গড়ে উঠলেও আজও কৃষিপর্যটন তেমন বিকাশ লাভ করতে পারেনি। অথচ, আমাদের বাগান এবং খামার মালিকরা চাইলে সহজেই কৃষিপর্যটন গড়ে তুলতে পারে। এতে তাদের পণ্য খামারেই বিক্রি হয়ে যাবে। ক্রেতার পেছনে তাদের ছোটা লাগবে না বরং ক্রেতাই তাদের পণ্য ক্রয়ের জন্য এগিয়ে আসবে । এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই লাভ। বাজারে যে দামে পণ্য বিক্রি হয়, তার চেয়ে কম দামে ফ্রেশ, টাটকা শাকসবজি আহরণ করতে পারবে পর্যটকরা।
লেখক: উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন