শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মালয়েশিয়ায় কর্মী গমনে ধীরগতি

মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগানুমতি পেতে গলদঘর্ম, কুয়ালালামপুরে হাইকমিশনে ফাইলের স্তুপ

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ৩ অক্টোবর, ২০২২, ৭:৫২ পিএম

স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় কর্মী গমনে চলছে ধীরগতি। দীর্ঘ চার বছর পর দেশটিতে এক মাস দশ দিনে বিএমইটি থেকে কর্মী নিয়োগের ছাড়পত্র ইস্যু হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৫৮০ জন কর্মীর। আর দেশেটিতে গিয়েছে ২ হাজারের মতো কর্মী। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীদের নিয়োগানুমতি পেতে এজেন্সির মালিকদের গলদঘর্ম পোহাতে হচ্ছে। টেবিলে টেবিলে নানা প্রকার হয়রানি এবং চরম উদাসিনতার দরুণ বিএমইটি থেকে বর্হিগমন ছাড়পত্র পেতে কর্মীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে বলে অভিযোগ উঠছে। দেশটিতে ছয় লক্ষাধিক বাংলাদেশি কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে। কর্মী প্রেরণের গতি বাড়ানো সম্ভব হলে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স আয়ের পরিমাণও বাড়বে। একাধিক জনশক্তি রফতানিকারক এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

এদিকে, ডলার সঙ্কটের মধ্যে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে রেমিট্যান্স। মূলত নানা সুবিধা দেয়ায় বৈধ চ্যানেলে সাড়া মিলছে প্রবাসী আয়ে। আগস্ট মাসের মতো সেপ্টেম্বরেও প্রবাসী আয়ে সুবাতাস বইছে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১৫ দিনে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১০০ কোটি ৮৬ লাখ ডলার। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১০৮ টাকা হিসেবে) যার পরিমাণ ১০ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। এমন গতি ধারা অব্যাহত থাকলে এই মাসেও দুই বিলিয়ন ছাড়াবে প্রবাসী আয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের এক প্রতিবেদনে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

কর্মী নিয়োগ শুরু থেকে তিন বছরের মধ্যে দেশটিতে প্রায় ৫ লাখ কর্মী যাওয়ার সম্ভাবনা কথা জানিয়েছিলেন হাইকমিশনার গোলাম সরওয়ার। কর্মী প্রেরণে ধীরগতি অব্যাহত থাকলে দেশটিতে ৫ লাখ কর্মী যাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিবে।

বায়রার একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, বাংলাদেশ প্রান্ত থেকে কর্মী পাঠানোর গতি না বাড়ালে আবারও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার হাত ছাড়া হবার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মালয়েশিয়ার জাতীয় সাধারণ নির্বাচন সন্নিকটে। নির্বাচনের পরে বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকলে কর্মী নিয়োগ বন্ধ হবার সম্ভাবনা আছে বলে অনেকেই শঙ্কিত। তারা বর্হিবিশ্বে শ্রমবাজার সম্প্রসারণ এবং রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বিএমইটি থেকে মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের নিয়োগানুমতি ও বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যু কার্যক্রম সহজীকরণের জোর দাবি জানিয়েছেন। অন্যথায় বর্হিবিশ্বের শ্রমবাজারে বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।

কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে কর্মী নিয়োগের সত্যায়নের ফাইলের স্তুপ হয়ে আছে। হাইকমিশনে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের আবেদন জমা পড়েছে প্রায় ৭১ হাজার। কোম্পানী যাচাই বাছাইয়ের নামে কর্মী নিয়োগের ফাইলে সত্যায়ন কার্যক্রম বিলম্বিত হওয়ায় মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারাও ক্ষুব্ধ হচ্ছে বলে জানা গেছে। গতকাল বুধবার পর্যন্ত প্রায় ৪২ হাজার কর্মী নিয়োগের ফাইলে সত্যায়ন দেয়া হয়েছে। আরো ৩১ হাজার কর্মী নিয়োগের সত্যায়ন দেয়া বাকি রয়েছে। কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনের শ্রম উইংয়ের মিনিস্টার নাজমুস সাদাত সেলিম এতথ্য জানিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে মিনিস্টার সেলিম বলেন, বাংলাদেশ হাইকমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কর্মী নিয়োগের সত্যায়ন দ্রুত ইস্যু করছে। কর্মী নিয়োগের সত্যায়ন প্রদানে কোনো প্রকার হয়রানি ও অনিয়মের সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ৪২ হাজার কর্মী নিয়োগের সত্যায়ন দেয়া হয়েছে। আর বাংলাদেশ থেকে গতকাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় কর্মী এসেছে মাত্র দু’হাজারেরও কম। এতেই বুঝবেন মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে ধীরগতিটা কোথায় ?

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকেও মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের নিয়োগানুমতি পেতে অহেতুক বিলম্ব হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। ফলে দেশটিতে কর্মী গমনের কার্যক্রমে বাড়ছে না গতি। মালয়েশিয়ার সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার ধরে রাখতে এবং রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি বাড়াতে কর্মী নিয়োগানুমতি ও বর্হিগমন ছাড়পত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ইস্যু করার জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন রিক্রুটিং এজেন্সি নিউ এইজ ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মো.সওকত হোসেন সিকদার।

তিনি বলেন, প্রবাসী মন্ত্রণালয় থেকে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীদের নিয়োগানুমতি ও বিএমইটি থেকে বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যুতে বিলম্ব হওয়ায় দেশটিতে কর্মী নিয়োগে গতি বাড়ছে না। তিনি মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানির স্বার্থকতা ধরে রাখতে হলে কর্মী নিয়োগানুমতি ও বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যু কার্যক্রম আরো সহজীকরণ করতে হবে। অন্যথায় দেশটির শ্রমবাজার হাত ছাড়া হবার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, কর্মী পাঠাতে বিলম্ব হওয়ায় দেশটির নিয়োগকর্তারা চরমভাবে ক্ষুব্ধ হচ্ছে।

তিনি বলেন, নিউ এইজ ইন্টারন্যাশনাল মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের ৪ হাজার ৬শ’ চাহিদাপত্র লাভ করেছে। এর মধ্যে কুয়ালালামপুরস্থ হাইকমিশন থেকে ১২শ’ কর্মীর সত্যায়ন পাওয়া গেছে। গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চারটি ফ্লাইট যোগে ১০৯ জন কর্মীকে মালয়েশিয়ায় প্রেরণ সম্ভব হয়েছে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর ১৩০ জন কর্মীর নিয়োগানুমতির জন্য প্রবাসী মন্ত্রণালয়ে ফাইল জমা দেয়া হলে গত ১৯ সেপ্টেম্বর অনুমতি দেয়া হয়েছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত ৪১ জন কর্মীর বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যু করা হয়নি। এসব কর্মীর আজ বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ৪০ মিনিটে মালিন্দো এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নং (ওডি-১৬৫) যোগে কুয়ালালামপুরের উদ্দেশ্যে ঢাকাত্যাগের কথা। আজ দুপুরের মধ্যে এসব কর্মীর বর্হিগমন ছাড়পত্র হাতে না পেলে তাদের সকলের টিকিটের ১৩ লাখ ১২ হাজার টাকা গচ্চা যাবে।

আল-রাবেতা ইন্টারন্যাশনাল মালয়েশিয়ার বিভিন্ন কোম্পানীতে সাড়ে ৩ হাজার কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র লাভ করেছে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর মালিন্দো এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নং (ওডি নং-১৬৫) যোগে ২৪ জন কর্মীকে মালয়েশিয়ার ডোমিনিয়ন রাবার কোম্পানী এসডিএন বিএইচডিতে পাঠানো হয়েছে। যশোরের সোহেল রানা, রাকিবুল, তরিকুলগাজী, হৃদয় বৈঢ়াড়ী, বাঁশখালির মিজানুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, দীর্ঘ দিন পর ১৫শ’ রিংগিত মাসিক বেতনে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ পেয়ে আমরা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। অভিবাসন ব্যয় প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে সরকার নির্ধারিত ব্যয়ের অর্থ দিয়েই দেশটিতে যাচ্ছে বলে তারা দাবি করেন। আল রাবেতা ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী ও বায়রার নবনির্বাচিত সদস্য আলহাজ আবুল বাসার ইনকিলাবের সাথে আলাপকালে বলেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে আমরা উভয় দেশের নিয়ম নীতি অনুসরণ করেই পাঠাচ্ছি। তিনি কর্মী নিয়োগানুমতি ও বর্হিগমন ছাড়পত্র দ্রæত ইস্যুর ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করে বলেন, কর্মী প্রেরণের প্রক্রিয়ায় ধীরগতি অব্যাহত থাকলে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানিতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। তিনি নিয়োগানুমতি ও বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যুকে সহজীকরণের উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানান।

উল্লেখ্য, দশ সিন্ডিকেটের অনৈতিক কর্মকান্ডের দরুণ ২০১৮ সালে দেশটির তৎকালিন সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পরে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টা ও ব্যাপক ক‚টনৈতিক উদ্যোগের পর ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর দেশটিতে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের লক্ষ্যে উভয় দেশের মাঝে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রায় দেড় হাজার বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা দেশটিতে প্রেরণ করা হলে তারা মাত্র ২৫ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এ নিয়ে বঞ্চিত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ২৫ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী প্রেরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছিল। সিন্ডিকেট বিরোধী জোটই অতিসম্প্রতি বায়রা দ্বি বার্ষিক নির্বাচনে বিজয় লাভ করে। বায়রার নবনির্বাচিত কমিটি বাদ পড়া এজেন্সিগুলোকে কর্মী প্রেরণে সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে আরো ৭৫টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে অন্তর্ভুক্তকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে।

২৫ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গত ৯ আগস্ট থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ শুরু হয়। ওইদিন ক্যাথারসীজ ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ৫৩ জন কর্মী নিয়ে এয়ার এশিয়ার একটি ফ্লাইট কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে পৌঁছে। মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার গোলাম সারোয়ার বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে তাদের স্বাগত জানান। এই সময়ে হাই কমিশনের শ্রম উইংয়ের মিনিস্টার নাজমুস সাদাত সেলিমসহ মালয়েশিয়ার মানব সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। মালয়েশিয়াস্থ জিমাত জায়া নামক একটি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে উক্ত কর্মীরা নিয়োগ লাভ করেছেন। মালয়েশিয়ার সরকারের নতুন বেতন কাঠোমো অনুযায়ী তারা প্রতিমাসে অন্তত পক্ষে ১৫০০ মালয়েশিয়ান রিংগিত অর্থাৎ বাংলাদেশি প্রায় ৩৭ হাজার টাকা বেতন পাবেন। এছাড়া তারা মালয়েশিয়ার আইন অনুযায়ী প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ওভার টাইম, বিনামূল্যে বাসস্থান, স্বাস্থ্য বীমা, কর্মস্থলে দুর্ঘটনা জনিত বীমাসহ অন্যান্য সব সুবিধা পাবেন।

দেশটিতে কর্মী নিয়োগের সত্যায়িত ফাইল দ্রুত প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় নিয়োগানুমতির জন্য জমা হলেও এসব ফাইল দ্রæত ছাড় পাচ্ছে না। মন্ত্রণালয়ের টেবিলে টেবিলে নানা হয়রানির দরুণ মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের নিয়োগানুমতি পেতে অহেতুক বিলম্ব হচ্ছে বলে একাধিক এজেন্সি নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ অভিযোগ উত্থাপন করেছে।

কর্মী প্রেরণে ধীরগতির ফলে শ্রম সঙ্কটে থাকা মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা চরম হতাশায় ভুগছেন। কর্মী নিয়োগে গতি বৃদ্ধির জন্য সেদেশের বিরোধী দল ডি এ পির চেয়ারম্যান মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানানের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছে বলে জানা গেছে।

মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুরা ঋণ করে টাকা নিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোতে পাসপোর্ট জমা দিয়ে মাসের পর মাস হয়রানির শিকার হচ্ছে। হাজার হাজার মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মী চড়া দামে মেডিকেল পরীক্ষা করেও দেশটিতে দ্রুত যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। তারা রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোতে প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন