ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য যখন ইউক্রেনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রচেষ্টাকে দ্বিগুণ করে তুলেছে, তখন সউদী আরবের ছায়া শাসক মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) পুতিনের সাথে তার সম্পর্ককে আরো গভীর করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। গত বুধবার ভিয়েনায় জ্বালানি তেলের সংস্থা ওপেক প্লাসের সভাটি রাশিয়া-সউদী আরব সম্পর্কের সর্বশেষ ল্যান্ডমার্কে পরিণত হয়েছে, যা রিয়াদের মিত্রদের জোরালো দাবিকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পুতিনের জন্য স্বস্তি এনে দিয়েছে। রিয়াদ এবং মস্কোর এ ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মিত্র হারানোর ভয়ে শঙ্কিত করে তুলেছে পশ্চিমাদের।
রাশিয়া এবং সউদী আরব উভয় দেশই বিশ্বব্যাপী তেলের সরবরাহ প্রতিদিন ১ লাখ থেকে ২ লাখ ব্যারেল কমিয়ে তেলের দাম বাড়িয়ে রাখতে চাচ্ছে। এ পদক্ষেপ যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট ইউরোপের গ্যাস সরবরাহে ব্যাপক বিঘœ ঘটাবে এবং শীতকাল ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে অঞ্চলটির জ¦ালানি নিরাপত্তার সঙ্কটকে আরো গভীর করে তুলবে। এটি ওয়াশিংটনকেও সউদী আরব থেকে আরো বিচ্ছিন্ন করে দেবে, যে রিয়াদকে তার বিশাল তেলাধার ব্যবহার করে সরবরাহে চাপ কমানোর জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল।
শুধু তাই নয়, দু’দেশের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা বদলে দেবে বর্তমান বিশ^ শাসন ব্যবস্থার আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক চিত্রটিও। যুক্তরাষ্ট্র-সউদী আরবের সম্পর্কের দূরত্বটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজেকে মধ্যপ্রাচ্যের একজন অংশীদার মনে করে গ্রীষ্মে ব্যক্তিগতভাবে সউদী আরব সফর করেন। তাকে তেল চুক্তিতে ব্যর্থতা নিয়ে দেশটি থেকে বিদায় নিতে হয়, যার ফলে, মধ্যবর্তী মার্কিন নির্বাচনে তাকে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা হ’ল, সউদী আরবের নেতৃত্বে ওপেক প্লাসের এই দর বৃদ্ধি রাশিয়ার যুদ্ধের অর্থায়নে সহায়তা হিসাবে কাজ করতে পারে।
কামার এনার্জি’র প্রধান নির্বাহী রবিন মিল্স বলেন, ‘পূর্বববর্তী সউদী প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের অনুভ‚তি এবং বার্তার প্রতি অনেক বেশি সংবেদনশীল ছিল, যদিও তারা সম্ভবত একই কাজ করত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পক্ষপাতিত্ব নির্বিশেষে তেলের ক্ষেত্রে সউদী যা চেয়েছে তা সবসময় করেছে, তবে এটি সাধারণত নমনীয়তা বজায় রাখতো। কিন্তু এবার নয়’।
মস্কো এবং রিয়াদের মধ্যে একটি গভীর বন্ধনের আরেকটি চিহ্ন গত মাসে দৃশ্যমান হয়, যখন বৈশ্বিক ক‚টনীতির একটি বিরল মুহূর্তে সউদী ক‚টনীতিকরা ইউক্রেন যুদ্ধে বন্দি পাঁচ ব্রিটিশসহ আন্তর্জাতিক বন্দির মুক্তি নিশ্চিত করেছিলেন। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত রাশিয়ার জন্য পরিস্থিতিটি ছিল অত্যন্ত কঠিন। তারপরেও মস্কো রিয়াদের জন্য বিশ্ব মঞ্চে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহ‚র্ত অনুমোদন করে। এখানে সউদী ক‚টনীতিকরা একটি চুক্তির মধ্যস্থতা করেন, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে স্পষ্টতই যেটির কোনো সম্পর্ক ছিল না।
সউদীর মধ্যস্থতাটি দেশটির সিংহাসনের উত্তরাধিকারীকে ভিন্নমতাবলম্বী সউদী সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাÐের পর চার বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী সমালোচিত হয়ে এখন বিশ্বব্যাপী ইতিবাচক ভাবমর্যাদা নিয়ে প্রত্যাবর্তনের পথ সহজতর করে দিয়েছে। রাজনীতি বিশেষজ্ঞ একজন ব্রিটিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি এমবিএসের জন্য পুতিনের তরফ থেকে একটি উপহার। পুতিন চেয়েছিলেন এটি ঘটুক এবং তিনি চেয়েছিলেন যেন মনে হয় যে, সউদীরা ক‚টনীতির মাধ্যমে এটি অর্জন করেছে।’
পুতিন এবং মোহাম্মদ বিন সালমানের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। এমবিএস এবং পুতিন উভয়ই সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাইডেনের প্রতি তাদের তিক্ততার কারণে আরো কাছাকছি হয়েছেন, যার প্রশাসন ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র দেওয়ার জন্য চাপের নেতৃত্ব দিয়েছে এবং রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বাইডেন এমবিএসকে কোনঠাসা করার জন্যও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যার ফলে বাইডেনকে জেদ্দা থেকে খালি হাতে বিদায় নিতে হয়। কঠোর জাতীয়তাবোধ এবং ইতিহাস তৈরির মনোভাবের জন্য পরিচিত এমবিএম ও পুতিন উভয়ই জ¦ালানির বাজারে উল্লেখযোগ্য আধিপত্য ধরে রেখেছেন।
এছাড়া, রিয়াদ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পুতিনের কোনো সমালোচনা করেনি এবং মস্কো গত পাঁচ বছরে ইয়েমেনে সউদী আরবের যুদ্ধে নাক গলায়নি। ২০১৬ সালে যখন এমবিএস প্রতিরক্ষা উপ-মন্ত্রী ছিলেন, তখন ব্রিটিশ ক‚টনীতিকদের রিয়াদে ডেকে পাঠান, যাদের মধ্যে সিনিয়র এমআই৬ কর্মকর্তারাও ছিলেন। বৈঠকটির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, পুতিনের বিষয়ে কী করা যায়, সে বিষয়ে যুক্তরাজ্যের পরামর্শ নেওয়া। তাদের একজন বেশ কয়েক বছর পর সংবাদমাধ্যম ‘দ্য অবজার্ভারকে বলেছিলেন, ‘সে তার প্রতি মুগ্ধ ছিল। মনে হয়েছিল যে, তিনি তার ভক্ত। তিনি (পুতিন) যা করেন, তিনি তা পছন্দ করেন।’
ব্রিটিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘পুতিন এটিকে নতুন বিশ্বব্যবস্থার অংশ হিসাবে দেখেন এবং মনে করেন যে তিনি এমবিএসকে তার পাশে রাখতে পারেন।’ তিনি বলেন, ‘সউদীরা তেলের একটি খুব শক্তিশালী সম্পদের ওপর বসে আছে, যার এখনও একটি কৌশলগত ভ‚মিকা রয়েছে। এমবিএস পুতিনকে সাহায্য করার পরিণতি জানেন, কিন্তু তিনি পাত্তা দেন না। প্রগতিশীল উদারপন্থীরাও না। তারা শাসন ব্যবস্থাকে একই চোখে দেখে। সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন