এ সকল অধিকার কেউ হরন করতে পারে না। ইসলামে মানবাধিকারের ধারণা শুধু কোন ঘোষণার মধ্যে সীমিত নয় বরং এটি প্রত্যেকটি মুসলমানের বিশ্বাসেরও অবিচ্ছেদ অংশ। মানুষকে তার পূর্ণাঙ্গ অধিকারের ঘোষণা প্রদান করেই ইসলাম থেমে থাকেনি, বরং প্রত্যেকটি অধিকার কার্যকর করে মানব জাতিকে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। ইসলাম কোন ভ্রান্ত বা অপূর্ণাঙ্গ মতবাদ নয়; আর মানুষের মঙ্গল-চিন্তা তার স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের চেয়ে কে বেশি করতে পারে? ইসলাম ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সকল মানুষকে তার ন্যায্য মানবাধিকার দিতে কোন কুন্ঠাবোধ করেননি, ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা:) তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রাম করে সকল মানুষের সকল ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। জাতিপুঞ্জ, জাতিসংঘ এবং পাশ্চাত্য সমাজের মত মানবাধিকারকে ইসলাম পদদলিত করেনি, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে কোনরূপ প্রতারণার আশ্রয় নেয়নি। বিংশ শতকের মাঝামাঝিতে এসে পাশ্চাত্য জগত মানবাধিকার সম্পর্কে কিছু বুলি আওড়াতে শুরু করলেও কার্যত: তা অনেকটা প্রতারণার শামিল। অথচ ইসলাম এবং এর নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে সকল মানুষের পরিপূর্ণ মানবাধিকার সুনিশ্চিত করেছেন এবং এতে কোনরূপ প্রতারণা প্রবঞ্চনা ছিল না, থাকতে পারে না। হযরত মুহাম্মদ (সা:) মানব জাতির সত্যিকার মুক্তির লক্ষ্যে সত্যিকার অর্থে সকল মানুষকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে যে সমস্ত মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার প্রদান করেন, তার একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা নিম্নে প্রদান করা হল ঃ
জীবন ধারণ বা জীবনের নিরাপত্তা লাভের অধিকার মানুষের অন্য সকল অধিকারের মূল। কেননা এছাড়া অন্য সকল অধিকার অর্থহীন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ- ভাষা সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল মানুষের জীবনের নিরাপত্তা প্রদান করেছে ইসলাম। রাজনৈতিক বা অন্য কোন মতামত, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় অবস্থান কোন কারণেই কেউ অপর মানুষের এ মৌলিক অধিকার খর্ব করতে পারে না। এক্ষেত্রে আল-কোরআনের ফরমানঃ
“নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ব্যতিরেকে কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল, আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবজাতিকে প্রাণে রক্ষা করল। যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তথা আইনের যথাযথ পদ্ধতি (উঁব ঢ়ৎড়পবংং ড়ভ ষধ)ি ব্যতিরেকে কাউকে হত্যা করাকে ইসলাম নিষেধ করেছে। উপযুক্ত আদালতের সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে কারও প্রাণ হরণ করা ইসলামে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এক্ষেত্রে মহানবী (সা:)-এর বহুসংখ্যক হাদীসও রয়েছে। বলা হয়েছে, “অমুসলিম জিম্মীকে যদি কেউ হত্যা করে তাহলে সে বেহেশতের ঘ্রাণও পাবে না। বিদায় হজ্জের ভাষণে প্রিয়নবী (সা:) ইরশাদ করেন “হে লোকসকল! পরস্পরের জানমাল ও ইজ্জত আবরুর উপর হস্তক্ষেপ তোমাদের জন্য হারাম করা হল।’’
আইনের দৃষ্টিতে সমতা হল আইনের শাসন এবং মানুষের স্বাধীনতা সংক্রান্ত অধিকারের মূলমন্ত্র। প্রিয়নবী (সা:) সকল মানুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র- ভাষা প্রভৃতি কোন কারণে কারও প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার মূলমন্ত্র হল সকল মানুষ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। এ ধারণার উপর প্রিয়নবী (সা:) মানবজাতির সামনে আল্লাহর ফরমান পেশ করেন। ‘‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে। অত:পর তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যেন তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার।’’ প্রিয়নবী (সা:) ইরশাদ করেন ঃ “কোন আরবের প্রাধান্য নেই অনারবের উপর, কোন অনারবের প্রাধান্য নেই কৃষ্ণাঙ্গদের উপর, কিংবা কৃষ্ণাদের প্রাধান্য নেই শ্বেতাঙ্গদের উপর। বরং তোমরা সকলে আদমের সন্তান এবং আদমকে সৃষ্টি করা হয় মাটি থেকে। ইসলাম সকল মানুষকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সকলের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা করেছে, আইনের দৃষ্টিতে পুরোপুরি পক্ষপাতহীন করেছে। চুরির অপরাধে সম্ভ্রান্ত বংশীয় জনৈকা ফাতেমা অভিযুক্ত হলে কয়েকজন সাহাবা নবীজীকে অনুরোধ করলেন সম্ভ্রান্ত বংশের এ মহিলাকে যেন কম শাস্তি প্রদান করা হয়। নবীজী (সা:) এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে সাহাবাদের হুশিয়ার করে দেন, তোমাদের পূর্বে বহু জাতি ধ্বংস হয়েছে এরকম পক্ষপাতমূলক বিচারের জন্য। প্রিয়নবী (সা:) ইরশাদ করেন “আজ যদি আমার মেয়ে ফাতিমাও চুরির অপরাধে অভিযুক্ত হত, আল্লাহর শপথ, আমি তারও হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দিতাম। আইনের দৃষ্টিতে সমতার এ বিরল দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)। তবে ইসলাম অবশ্য একটি মানদন্ডের ভিত্তিতে একে অপরের উপর প্রাধান্যকে স্বীকার করে। প্রিয়নবী (সা:) মানবজাতির সামনে আল্লাহর ফরমান পেশ করেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সেই সর্বাধিক সম্মানিত যে সর্বাধিক পরহেজগার।’’ প্রত্যেকের জন্য তাদের কৃতকর্ম অনুযায়ী বিভিন্ন স্তর রয়েছে, যাতে আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দেন। বস্তুত: তাদের প্রতি যুলুম করা হবে না। আইনের দৃষ্টিতে সমতা নীতিটি কার্যকর করার পাশাপাশি একে অপরের উপর প্রাধান্য সম্পর্কিত উল্লেখিত মানদন্ডের মাধ্যমে ইসলাম মূলত: প্রত্যেক মানুষকে সৎকর্মে প্রতিযোগী করে সর্বাঙ্গীণ সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
শুধু জীবনের নিরাপত্তা নয়, বরং মান-মর্যাদার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা হযরত মুহাম্মদ (সা:) প্রদান করেন। মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত-এর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি এবং এ মানুষ সম্পর্কে ইসলামের ভাষ্য ঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষকে সর্বোত্তম আদর্শরূপে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের মান-মর্যাদার নিশ্চয়তা প্রদান করতে যেয়ে প্রিয়নবী (সা:) আল্লাহর বাণী পেশ করেন ঃ “হে ঈমানদারগণ! কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে উপহাস না করে। কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর কোন নারীকে যেন উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় উপহাসকারিনী অপেক্ষা সে উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। তোমরা একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার আপন মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করতে পছন্দ কর? বস্তুত: তোমরা তা অপছন্দ কর।’’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন