ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়া ও সংকটের কারণ দেখিয়ে দেশে প্রায় তিন মাস আগে সরকার ঘোষণা দিয়ে দিনে এক ঘন্টা লোডশেডিং শুরু করে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, সেপ্টেম্বরের পর আর লোডশেডিং থাকবে না। তার আশ্বাস অনুযায়ী কাজ হয়নি। লোডশেডিং এখনও চলছে। এর মধ্যে জাতীয় গ্রীডে বিপর্যয় ঘটেছে। ফলে দেশব্যাপী বিদ্যুৎ সংকট আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। এক ঘন্টার লোডশেডিং বৃদ্ধি পেয়ে এখন গড়ে তিন-চার ঘন্টা দাঁড়িয়েছে। এই সংকটের কারণে গরমে সাধারণ মানুষ যেমন দুর্ভোগে পড়েছে, তেমনি শিল্প উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। গতকাল একটি দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার দিনে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১১ হাজার ৬৫৪ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ৯ হাজার ৮২১ মেগাওয়াট। লোডশেডিং করতে হয়েছে ৬৮৯ মেগাওয়াট। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়েছে, শিঘ্রই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের কারণ উদ্ঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কি কারণে এ বিপর্যয় ঘটেছে, তা তারা এখনও জানাতে পারেনি। বিপর্যয়ের কারণ উদ্ঘাটন করতে না পারা।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দেয়। রেন্টাল-ক্যুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনসহ বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ ও ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির উদ্যোগ নেয়। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং লোডশেডিংও কমে যায়। সরকার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার ঘোষণা দেয়। উপযুক্ত সঞ্চালন লাইনের অভাবে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না বলেও বলা হয়। বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়ে আলোকোৎসব করা হয় এবং রফতানির কথা বলা হয়। লোডশেডিং জাদুঘরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে এবং মাঝে মাঝে লোডশেডিং করে লোডশেডিংয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়ার মতো কথাও বলা হয়েছে। বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মধ্যেও প্রতিবছর দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়াতে থাকে। চলমান বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে পুনরায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের চরম অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে এটা ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’র শামিল। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি দিলেও তা সঞ্চালনের যে সিস্টেম, সেটি উন্নতির দিকে খুব একটা জোর দেয়নি। এতে উৎপাদিত অতিরিক্ত বিদ্যুৎ যেমন সঞ্চালন করা সম্ভব হচ্ছে না, তেমনি জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঞ্চালন লাইন হচ্ছে মহাসড়কে মতো। কোথাও সমস্যা দেখা দিলে তার প্রভাব মহাসড়কে পড়ে তা অচল করে দেয়। বিদ্যুৎ উপৎপাদনের পর সেটি গ্রিড সাবস্টেশনে পৌঁছানো এবং সঞ্চালনের মাধ্যমে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দেয়া হয়। এতে বিঘ্ন ঘটলেও বিপর্যয় দেখা দেয়। দেশে এখনও বিদ্যুৎ সঞ্চালনের মহাসড়কসহ অন্যান্য সরবরাহ কেন্দ্র আধুনিকভাবে গড়ে তোলা হয়নি। ফলে মাঝে মাঝেই গ্রিড বিপর্যয় ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেই হয় না, তা সরবরাহের পথ মসৃণ করতে হয়। এই পথটি বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ ঠিক করতে পারেনি। ফলে যতই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হোক না কেন, সঞ্চালন পথ ঠিক না থাকলে বিপর্যয়ের শঙ্কা থেকেই যাবে।
বিদ্যুতের সার্বিক যে পরিস্থিতি, তাতে এখন সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে, সরকার বড় গলায় যেভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলেছে, এখন সে বিদ্যুৎ গেল কোথায়? সরকারের পক্ষ থেকে নানা ব্যাখ্যা দেয়া হলেও তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। বাস্তবতা হচ্ছে, তারা বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। তারা মনে করছে, ক্ষমতা গ্রহণের পর যে পরিস্থিতিতে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়, সেই পরিস্থিতিতেই এখন ফিরে গেছে। চাহিদা ও কলেবর বাড়লেও পরিস্থিতি সেই সময়ের মতো হয়ে গেছে। তাহলে উন্নতি হলো কোথায়? বরং বিদ্যুৎ উৎপাদনকে কেন্দ্র করে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা বেশি শোনা গেছে। ভর্তুকির নামে জনগণের পকেট থেকে অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এমনকি বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ ব্যাপক লাভ করেছে। বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির কথাও উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে যে ব্যাপক উল্লাস ছিল, এক বিপর্যয়ে তা মলিন হয়ে গেছে। বিদুৎ খাতের উন্নয়নের বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। জাতীয় গ্রিডে যে বিপর্যয় এবং বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছে, তার জন্য প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয় দায় এড়াতে পারে না। তারা একেক সময় একেক কথা বলে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরনের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা দূর এবং সঞ্চালন লাইন আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই। যেকোনো মূল্যে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে আমরা আশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন