শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আন্তর্জাতিক সংবাদ

বিশ্ব নেতাদের জন্য শিক্ষণীয় ব্রিটেনের কঠিন বাস্তবতা

গভীর অর্থ মন্দার ফাঁদে লিজ ট্রাসের সরকার

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

পশ্চিমের সরকারী নেতারা এবং উদ্বিগ্ন ভোটাররা যখন ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, মন্থর প্রবৃদ্ধি, শীত ও উচ্চ জ্বালানি বিল নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত, তখন ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি এ সঙ্কট থেকে উদ্ধারের জন্য একটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন, যা উল্টো দেশটির অর্থ বাজারকে চরম অস্বস্তিতে ফেলেছে, বিশ্ব নেতাদের এবং জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে এবং তার সদ্য পাওয়া গদিটিকে নড়িয়ে দিয়েছে। ইউরোপীয় সরকারগুলোর জন্য এবং যাদের অর্থনীতিগুলো ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে সঙ্কটের মুখে পড়েছে এবং জ¦ালানি মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের জন্য ব্রিটেনের এ অর্থনৈতিক পরাজয় বা ট্রাস সরকারের নৈতিক পরাজয়ের মধ্যে সময়োপযোগী শিক্ষা রয়েছে।

শুক্রবার ট্রাস অর্থহীন ট্যাক্স কাটছাঁটের প্যাকেজ তৈরি, শত কোটি পাউন্ড মূল্যের ব্যয় পরিকল্পনা এবং কঠোর কর নীতি উঠিয়ে ফেলার জন্য তার অর্থমন্ত্রী কোয়াসি কোয়ার্তেংকে বরখাস্ত করেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গ্যাসের দাম এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে তার নিজস্ব রাজনৈতিক লড়াই চালানোর সময় ট্রাস সরকার যে ধরনের নীতির প্রণয়নের চেষ্টা করেছিল, তেমন কিছু প্রস্তাব করেননি বা ইউরোপের অন্য কোনও নেতাও নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেই ভর্তুকিগুলোর অর্থায়নে সহায়তা করার জন্য জ¦ালানি শক্তি সংস্থাগুলোর ওপর লাভের ওপর একটি উইন্ডফল ট্যাক্স প্রস্তাব করেছে। অন্য অনেক দেশ ঠিক একই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু ট্রাসের পরিকল্পনা ছিল বিশাল এবং খুব অনিশ্চিত।

ট্রাস জ্বালানি সহায়তায় অর্থ প্রদানের উপায় প্রস্তাবের পরিবর্তে, কর্পোরেট কর বৃদ্ধি এবং জনসংখ্যার সবচেয়ে ধনী অংশের জন্য আয়কর কমানোর জন্য চাপ দিয়েছেন। ফলাফল ছিল সরকারের রাজস্ব হ্রাস এবং ব্রিটেনের ফেঁপে ওঠা ঋণ বেলুন। প্রসাদ বলেছেন, ‘সামগ্রিকভাবে, পরিকল্পনাটি মুদ্রাস্ফীতি না বাড়িয়ে কীভাবে স্বল্পমেয়াদে অর্থনীতিকে সমর্থন করবে, তার পরিপ্রেক্ষিতে খুব বেশি স্পষ্টতা ছিল না।’ মুদ্রাস্ফীতিকে আরও ধামাচাপা দিয়ে না রেখে, বরং কীভাবে সবচেয়ে দুর্বলদের উপর মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবকে কমানো যায়, তা নিয়ে বিশ্বের প্রতিটি সরকার দ্বিধাদ্বন্দ্বের মুখোমুখি। কর্নেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ ইশ্বর প্রসাদ বলেন, ‘সময়ের এখন এটাই প্রশ্ন।’

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অর্থনীতিবিদ মারিয়ানা মাজুকাতো বলেন যে, ব্রিটেনের যেটির অভাব রয়েছে, তা হল একটি দূরদর্শী পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম। যেমন, ট্রিলিয়ন ডলারের জলবায়ু এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন দ্বারা গৃহীত ডিজিটালাইজেশন পরিকল্পনা বা যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু ও অবকাঠামো কর্মসূচি। তিনি বলেন, ‘যদি আপনার একটি প্রবৃদ্ধি পরিকল্পনা, একটি শিল্প কৌশল উদ্ভাবন নীতি না থাকে, তাহলে আপনার অর্থনীতি সম্প্রসারিত হবে না।’

যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোজোন উভয় দেশেই ব্রিটেনের তুলনায় কিছুটা বেশি নড়বড়ে জায়গা রয়েছে, কারণ ব্রিটিশ পাউন্ডের তুলনায় রিজার্ভ রাখা মুদ্রা হিসেবে বিশ্বজুড়ে ডলার এবং ইউরো অনেক বেশি ব্যবহৃত হয়। অন্যান্য অর্থনীতিতে কী ঘটছে তার হিসাবও তাদের নিতে হয়। একাডেমি অফ সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর প্রেসিডেন্ট উইল হাটন বলেছেন, জি৭-এর জোটে গঠিত ধনী দেশগুলো মূলত একই ‘আর্থিক এবং অর্থ কাফেলার’ অংশ। তিনি বলেন, ‘থ্যাচার-যুগের খাড়া কর কাটছাঁট এবং নিয়ন্ত্রণহীনতার মিশ্রণকে পূঁজি করে ট্রাস সরকার বাকিদের থেকে এবং অর্থনৈতিক মূলধারা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।

কর ছাড়ের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে নির্বাচনের আগে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছিলেন ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস। করপোরেট কর বাড়ানোর পদক্ষেপ বাতিলের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাস্তবে দেশটির গভীর মন্দা সামাল দিতে দিশেহারা হয় পড়েন তিনি। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে লিজ ট্রাস ঘোষণা করেন যে, তিনি কর্পোরেশন ট্যাক্সের পরিকল্পিত বৃদ্ধি পুনর্বহাল করবেন, যা তিনি উল্টো ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে জয়ী হন। যারা দেড় লাখ ইউরো বা এর বেশি আয় করেন তাদের ওপর কর ৪৫ থেকে কমিয়ে ৪০ শতাংশ করা হবে বলে জানিয়েছিলেন লিজ ট্রাসের সাবেক অর্থমন্ত্রী। তিনি এটি স্বীকার করেন যে বাজারের প্রত্যাশার চেয়ে আরও বেশি এবং দ্রুত নেওয়া হয়েছিল এ সিদ্ধান্ত।

চলতি বছর মার্চের বাজেটে তৎকালীন ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক এই কর ২০২৩ সালের এপ্রিলে ১৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্তই বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ট্রাস। গত মাসে সুনাককে হারিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় নেতা নির্বাচিত হন সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস। কিন্তু অবশেষে তিনি সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসায় সুনাকের সিদ্ধান্তই বহাল রইল।

ট্রাস এখন বলছেন যে, তার অগ্রাধিকার ঋণদাতাদের কাছে ব্রিটেনের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার করা। মাঝারি মেয়াদে জিডিপির শতাংশ হিসাবে ঋণ কমবে, তা নিশ্চিত করার জন্য তিনি ‘যা কিছু প্রয়োজন’ তা করবেন। এর ফলে, এপ্রিল থেকে আড়াই লাখ ইউরো মুনাফাসহ যাদের আয় বেশি তাদের কর ১৯ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে, যা ফ্রান্স এবং জার্মানির সঙ্গে তুলনীয় একটি স্তর। এতে রাজকোষে ২০২৬ থেকে ২৭ সালের মধ্যে বছরে প্রায় ১৯ বিলিয়ন পাউন্ড জমা হবে বলে আশা করছে ট্রাস সরকার। তবুও এটি ব্রিটেনকে মন্দার খাদ থেকে বের করে আনার জন্য অপর্যাপ্ত। সূত্র : দ্য নিউইয়র্ক টাইম্স।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন