আজকের নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যার উভয় তীরে অবস্থিত হলেও বর্তমানে এর পশ্চিম তীরই সবদিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দূর অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায় মুসলিম আমলে সোনারগাঁ যখন বাংলার রাজধানী ছিল তখন নারায়ণগঞ্জের অস্তিত্ব ছিল না তখন শীতলক্ষ্যার পূর্বপাড় কদমরসুল বন্দর ও মদনগঞ্জ এলাকাই ছিল ব্যবসাও বাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী।
মরক্কোর বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা সোনারগাঁ ভ্রমণ করেন। তিনি এখানে দীর্ঘদিন অবস্থান করেন। এ সময় তিনি বাণিজ্যিক এলাকা বন্দরে শীতলক্ষ্যার তীরে যাভা দ্বীপে গমনরত বাণিজ্য তরী দেখতে পান। বন্দর শীতলক্ষা নদীতে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ ও চীনের বণিকেরা বাণিজ্যের জন্য তাদের বাণিজ্যতরী নিয়ে এ দেশে আসতো। বণিকরা মসলিন ও বিভিন্ন খবার রান্নার মসলাসহ খাদ্যশষ্য তাদের বাণিজ্যতরী বোঝাই করে দেশে ফিরত।
সুপ্রসিদ্ধ ভ্রমণকারী রালফফিচ উল্লেখ করেন যে, সোনারগাঁয়েই ভারতবর্ষের সর্বোৎকৃষ্ট বস্ত্র প্রস্তত হতো। তিনি তার ভ্রমণ কাহিনিতে আরো উল্লেখ করেন যে, পর্তুগীজ জলদস্যুদের হামলাও লুটপাট থেকে বিদেশি বণিকও তাদের বাণিজ্যতরীগুলোকে রক্ষা করতে শীতলক্ষ্যা নদীতে অসংখ্য খাড়ী খনন করা হয়। ইংল্যান্ডের টেমস নদীর পরে দ্বিতীয় খাড়ীবেস্টিত নদী এই শীতলক্ষ্যা। আবুল ফজল তদীয় আইন এ আকবরী গ্রন্থে সোনারগাঁয়ে মসলিন ব্যবসা ও শীতলক্ষ্যা তীরের বাণিজ্য বন্দরের কথা উল্লেখ রয়েছে।
ওই সময় নারায়ণগঞ্জের অস্তিত্ব ছিল না; তখন এর নাম ছিল খিজিরপুর। ১৭৬০ সালে এই খিজিরপুরের নামকরণ করা হয় নারায়ণগঞ্জ। ১৮৬২ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত স্টীমার সার্ভিস চালু হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জর ব্যবসা-বাণিজ্যের বৈপ্লবিক উন্নতি সাধিত হয়। এরপর কলকাতা-নারায়ণগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ-আসাম স্টিমার সার্ভিস চালু হয়। এদেশে বৃটিশ আগমনের পর ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ হয়ে চট্টগ্রাম এর বাণিজ্যিক প্রসারে নারায়ণগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হয়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নারায়ণগঞ্জের হারানো অতীত গৌরব উদ্ধারে তৎপর হয়ে হাতে নিয়েছে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়ককে যানজটমুক্ত করতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইন বোর্ড মোড় থেকে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া মোড় পর্যন্ত রাস্তাটি ৬ লেন করার প্রকল্প, চাষাড়া থেকে পঞ্চবটি পর্যন্ত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পুরান সড়কটিকে ৪ লেন করে পঞ্চবটি থেকে মুন্সিগঞ্জ মুক্তারপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন চারলেন ফ্লাইওভার এর সাথে সংযুক্ত করা।
অপরদিকে পদ্মা সেতু থেকে মুন্সিগঞ্জ হয়ে যে চার লেন সড়ক দ্রতগতিতে এগিয়ে চলছে তা বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিম ওসমান ৩য় শীতলক্ষ্যা সেতুর সঙ্গে যুক্ত হবে। এই নির্মাণ কাজ শেষ হলে পদ্মা সেতু হয়ে চট্টগ্রাম-সিলেটগামী যানবাহন রাজধানীতে প্রবেশ না করে মুন্সিগঞ্জ হয়ে সরাসরি শীতলক্ষ্যা ৩য় সেতু দিয়ে বের হয়ে যেতে পারবে। ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জগামী যাত্রী সাধারণ ২৫ থেকে ৩০ মিনিটে তাদের গন্তব্যে পৌঁছেতে পারবেন।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা ও পাশের জেলা নারায়ণগঞ্জকে যানজটমুক্ত এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নগরবাসীর যাতায়াত সহজ করতে সেতু বিভাগ সাবওয়ে তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরই অংশ হিসেবে ২০১৮ সালে শুরু হয় সাবওয়ে প্রকল্পের সমীক্ষার (ফিজিবিলিটি স্টাডি) কাজ।
একনেকে প্রধানমন্ত্রীর পাশ করা বন্দর উপজেলার শান্তিরচর নীটপল্লী এই নীটপল্লী বাস্তবায়িত হলে প্রায় ২০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে। নবীগঞ্জে শীতলক্ষ্যায় আর একটি ব্রীজ এবং লাঙ্গলবন্দে ইতোমধ্যেই অর্থ বরাদ্দ হয়ে গেছে। যখন এই প্রকল্পগুলো চালু হয়ে যাবে, তখন বন্দরবাসী অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে।
নারায়ণগঞ্জের খানপুরে হচ্ছে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার এবং বাল্ক টার্মিনাল। প্রথমে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) এই প্রকল্প করার প্রস্তাব থাকলেও বেসরকারি বিনিয়োগকারী না পাওয়ায় সরকারের নিজস্ব অর্থে হচ্ছে এই অভ্যন্তরীণ কনটেইনার এবং বাল্ক টার্মিনাল। এই টার্মিনাল নির্মাণ হলে চট্টগ্রাম ও মোংলাসহ অন্যান্য বন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ নৌপথের মাধ্যমে পরিবাহিত কনটেইনার ওঠানামা সহজ হবে।
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান ইনকিলাবকে বলেন, নারায়ণগঞ্জবাসী জাতির পিতার কন্যার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা এমন একটি জায়গায় চলে এসেছি, আল্লাহ যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হায়াতে তাইয়েবা দান করেন, তাহলে আমার বিশ্বাস নারায়ণগঞ্জ ঢাকা থেকেও উন্নত জায়গায় পরিণত হবে। নারায়ণগঞ্জের মানুষ একটা স্বাধীন দেশে যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা পাওয়া উচিৎ, তার সবগুলো সুবিধা পাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন