‘হাওয়া‘ বুঝে এগোচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আমলে নিয়ে ফেলছে সতর্ক পদক্ষেপ। নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে দৃশ্যত : ‘মধ্যপন্থা’ অবলম্বনের সিদ্ধান্ত রয়েছে। অনুসন্ধান ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যস্ত রাখা হয়েছে ছোটখাটো দুর্নীতির ফাইল দিয়ে। এজেন্ডাভিত্তিক ফাইলের ক্ষেত্রে অবলম্বন করা হচ্ছে ‘ধীরে চলো’ নীতি। অর্থ পাচার, ব্যাংকের অর্থ আত্মসাত, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিষয়ে সংস্থাটি এখন চুপ। দুদকের বিগত ৬ মাসের কার্যক্রম পর্যালোচনায় অন্তত : এমনটিই পরিলক্ষিত হয়েছে।
বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেছে, দুদকের কাজের গতি এখন শ্লথ। যে ধারণাগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে ২০০৪ সালে দুর্নীতিবিরোধী রাষ্ট্রীয় এ সংস্থার জন্ম হয়েছিল বর্তমান কমিশন তা থেকে অনেকটা দূরে। স্বশাসিত স্বাধীন সত্তার কথা প্রতিষ্ঠানটি যেন ভুলেই গেছে। পরিচালিত হচ্ছে অদৃশ্য ইশরায়। জন্মলগ্ন থেকে শাসকগোষ্ঠীর আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ পুরোনো। কমিশন গঠনে আইন ও বিধিবিধান থাকলেও কমিশনার এবং চেয়ারম্যান নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি।
ক্ষমতাসীনদের প্রচ্ছন্ন প্রভাব এবং আমলা-আধিক্যে বিগত তিনটি কমিশনের কার্যক্রম ছিল নির্বাহী বিভাগের অন্য যেকোনো সংস্থার মতোই প্রশ্নবিদ্ধ। বর্তমান কমিশন সে ধারাবাহিকতাই অব্যাহত রেখেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। অনুসন্ধান-তদন্তের নামে ব্যবহৃত হচ্ছে এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে। নিরীহদের হয়রানি এবং চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের তোষণনীতি এখনও দৃশ্যমান। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিবেচনায় ভিন্ন ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে দুদক।
আলোচিত পিকে হালদারের মতো ব্যক্তি যখন হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে, দুর্নীতি দমন কমিশন তখন নির্বিকার। দেশে থাকতে তাকে কোনোরকম ‘বিরক্ত’ করেনি দুদক। হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাউথ-বাংলা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ। স্থল সীমান্ত দিয়ে সপরিবারে ভারত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়ার ১৫ মিনিট পর ইমিগ্রেশনে পৌঁছায় তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার নোটিশ।
একইভাবে যন্ত্রপাতি কেনার নামে স্বাস্থ্য খাতকে ফোকলা-ছোবড়া করে দেয়ার সময় আলোচিত চরিত্র মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুকে দুদক সমীহই করেছে। তার বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তার ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীকে শায়েস্তা করার মাধ্যমে নির্বিঘ্ন করেছে মিঠুর লুণ্ঠনের পথ। ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষিতে মিঠুকে তখনই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয় যখন তিনি সেকেন্ড হোমে থিতু হয়েছেন। এমন দৃষ্টান্ত দেয়া সম্ভব ভুরি ভুরি। আলোচিত বহু দুর্নীতির ফাইল ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আবার তফসিলভুক্ত নয়Ñ এমন বিষয়ের অনুসন্ধান শুরু করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করছে। তাই দুদক যে অনুসন্ধান-তদন্ত একেবারেই বন্ধ রেখেছে এমনটি বলারও জো নেই।
অবসরে চলে যাওয়া কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ক্ষুদ্র ও মধ্যম পর্যায়ের ব্যবসায়ী এবং প্রতিষ্ঠান মালিকদের ‘অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান’ জাতীয় বিষয় নিয়ে কর্মকর্তারা যারপর নাই ব্যস্ত। অ্যানফোর্সমেন্ট ইউনিটের প্রতিরোধ কার্যক্রম (মূলত: প্রচারণামূলক) ব্যবহৃত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির সংবাদ শিরোনাম হওয়ার কাজে। তবে কারাভ্যন্তরে প্রবেশে কারা-বিধিলঙ্ঘনের দোহাই তুলে দুদকের অ্যানফোর্সমেন্ট টিমকে রীতিমতো ‘হাই কোর্ট’ দেখিয়ে দিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দুর্নীতিবিরোধী ‘অভিযান’ চালাতে গিয়ে উল্টো নাজেহাল হয় দুদক টিম। ফলে সংস্থাটির ‘ঝটিকা অভিযান’ও এখন ম্রিয়মাণ।
দুদকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রতি মাসেই কিছু না কিছু মামলা দায়ের হচ্ছে। কিন্তু আসামি গ্রেফতার হচ্ছে না। আপাত: গ্রেফতার না করার বিষয়ে রয়েছে কমিশনের অলিখিত নির্দেশনা। তাই কোনো প্রকার জামিন না নিয়ে এজাহারভুক্ত শতাধিক আসামি ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রকাশ্যে। অনেক আসামি জামিন ছাড়াই দুদকে এসে তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। আবার অভিন্ন আসামিকে যদি অন্যকোনো আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী ভিন্ন মামলায় গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় দুদক তাকে ‘শ্যোন অ্যারেস্ট‘ দেখাচ্ছে। এভাবে ‘মরা সাপকেই মারা’র কৃতিত্ব নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। নিজস্ব মামলায় সরাসরি গ্রেফতারকে বর্তমান কমিশন মনে করছে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’।
বহুল বিতর্কিত (অথচ সহজলভ্য) ‘ট্র্যাপ কেস’ বা ‘ফাঁদ মামলা’ থেকেও দুদক আপাত : নিবৃত। মামলার বিচারের সময় সাক্ষী উল্টে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক সময়ে ফাঁদ মামলার কথা আর জানা যায় না। তবে তফসিলভুক্ত অনেক অভিযোগের অনুসন্ধান না করে যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই প্রতিষ্ঠানেই ‘ব্যবস্থা নেয়া’র জন্য ফেরত পাঠানোর রীতি অব্যাহত রয়েছে। অথচ অভিযোগ ফেরত পাঠানোর কোনো বিধান আইনে নেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ‘ঝটিকা অভিযান’ পরিচালনার মতো প্রদর্শনমূলক কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে। চালু রয়েছে ১০৬ হটলাইনও।
ইকবাল মাহমুদ কমিশনের এমন ‘সৃজনশীল কার্যক্রম’র অনেক কিছুরই উত্তরাধিকার অক্ষুণ্ন রেখেছে বর্তমান কমিশন। ব্যত্যয়-ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে শুধু দুদকের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে। পরীক্ষা পদ্ধতির উদ্ভট বিধান করে ৫ বছরের বেশি সময় পদোন্নতি ঠেকিয়ে রেখেছিল বিগত কমিশন। বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানটিকে পরিণত করা হয়েছিল আমলানির্ভর অথর্ব প্রতিষ্ঠানে। বর্তমান কমিশন সেই প্রথা ভেঙে প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে বিগত ৩টি কমিশন আমলেই সুপারসিডেড অথচ দক্ষ, অভিজ্ঞ সিনিয়র কর্মকর্তাদের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্নই রেখেছে এই কমিশন।
অনুসন্ধান-তদন্তে অব্যাহত রয়েছে ‘পিক অ্যান্ড চ্যুজ’ নীতি। সুইসব্যাংকে বাংলাদেশিদের পাচারকৃত অর্থের পাহাড় ক্রমেই উঁচু হচ্ছে। দুদকের ভূমিকা এখানে এমএলএআর, চিঠি চালাচালি। বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ অনুসন্ধান-তদন্তে রয়েছে দুদকের দোদল্যমানতা। কখনও বলছে, অর্থ পাচারের বিষয়ে দুদকের কিছুই করার নেই। কখনও বলছে, সব ধরনের অর্থ পাচারের অনুসন্ধান-তদন্ত দুদকই করবে। একেক সময় একেক ব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠানটিকে ‘ইচ্ছে-ঘুড়ি’তে পরিণত করেছে। ব্যক্তি পর্যায়ের অনুসন্ধান-তদন্তের এখতিয়ার দুদকের নেই। এমন বক্তব্য দিয়ে ই-ভ্যালির অনুসন্ধান সিআইডিতে ফেরত পাঠিয়েছে।
অথচ ১১৬ জন আলেমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত এবং পরে অস্বীকারের মধ্য দিয়ে দোদল্যমানতার জানান দেয় কমিশন। আবার এজেন্ডাভিত্তিক অনুসন্ধানেও তৎপর দেখা যায় দুদককে। নোবেল বিজয়ী একমাত্র বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে চলছে একাধিক মামলা চলছে। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাত রয়েছেÑ সরকারদলীয় নেতৃবৃন্দ এমন প্রচারণায় নিবিষ্ট। এ বাস্তবতায় দুদকও ড. ইউনূস প্রতিষ্ঠিত ‘গ্রামীণ টেলিকম লি:’র শীর্ষ কর্মকর্তাদের ‘অর্থ পাচার’ বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
অনুসন্ধানের ধারাহিকতায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেও দুদকে তলব এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা হবেÑ মর্মে কমিশন ইংগিত দিয়েছে। এর মধ্যেই বহু রেকর্ডপত্র হস্তগত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এরই একপর্যায়ে গত ১৪ সেপ্টেম্বর দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন যুক্তরাষ্ট্রের দূত পিটার ডি হাস। দূতের সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সেক্রেটারি স্কট ব্যান্ডম, মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের লিগ্যাল রেসিডেন্ট অ্যাডভাইজার সারা অ্যাডওয়ার্ডসও ছিলেন। এ সাক্ষাতের বিষয়বস্তু কমিশন সংবাদ মাধ্যমের কাছে খোলাসা করেনি।
তবে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, পিটার ডি হাসের নেতৃত্বে মার্কিন প্রতিনিধি দল মূলত ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতে দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকালে দুদক সচিব মো: মাহবুব হোসেন, বদলি হয়ে যাওয়া মহাপরিচালক (যুগ্ম-সচিব) কেএম সোহেল সঙ্গে ছিলেন। অপর দুই কমিশনারÑ ড. মোজাম্মেল হক খান (অনুসন্ধান) এবং মো: জহুরুল হককে (তদন্ত) আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি। এমনকি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তাদের পরিচয়ও করিয়ে দেয়া হয়নি। ফলে ওই বৈঠকটি ছিল নিতান্তই দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে। কমিশনের সঙ্গে নয়। তবে ওই সাক্ষাতের পরই গ্রামীণ টেলিকম লি:র বিরুদ্ধে অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় আর কাউকে তলব করা হয়নি।
সূত্রটি জানায়, এজেন্ডাভিত্তিক অনুসন্ধান-তদন্তের নজির প্রতিষ্ঠানটিতে পুরোনো। তা সত্ত্বেও আগামি নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক উস্কানিমূলক কোনো অনুসন্ধান-তদন্ত শুরু না করার নীতি অনুসরণ করছে। পুরোনো অনুসন্ধানগুলোর বিষয়েও আপাত: তৎপরতা না দেখানোর মনোভাব স্পষ্ট। বলাবাহুল্য, বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে দুদকে বহু অনুসন্ধান-তদন্ত চলমান। তাই রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়াতে পারেÑ এমন ফাইলগুলোর সম্পর্কে ‘ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণের প্রচ্ছন্ন নির্দেশনা রয়েছে। আগামী এক বছর দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কোনদিকে গড়ায়- সেই ‘হাওয়া’ বুঝেই সতর্ক পদক্ষেপে চলছে প্রতিষ্ঠানটি।
তবে এমনটি অস্বীকার করে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান এ প্রতিবেদককে বলেন, হাওয়া বুঝে সতর্ক পদক্ষেপ ফেলছে দুদকÑ এ কথার সঙ্গে আমি এক মত নই। অনুসন্ধান-তদন্তের গতিশ্লথ হয়েছেÑ এটিও সত্য নয়। বরং অনুসন্ধান কর্মকর্তাগণ সুপারিশ সম্বলিত যেসব প্রতিবেদন কমিশনে জমা দিচ্ছেন, আমরা সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছি। যাতে কোনো দুর্নীতিবাজ আইনের ফাঁকফোকড়ে বেরিয়ে যেতে না পারে। একইভাবে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিও যেন হয়রানির শিকার না হন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আমাদের কিছুটা সময় লাগছে। কিন্তু কাজ বন্ধ নেই। কাজের গতি আগের চেয়ে এখন বরং বেড়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন