জাদু বা ম্যাজিক দুটো শব্দই আমাদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। কারণ দুটো দেখেই আমরা মজা পাই। মানুষ মাত্রই এমন কিছু চায় যা কিনা সাধ্যের বাইরে, কাল্পনিক, মানুষ যা পারে না। এসব দেখতে, পড়তে মানুষের ভালো লাগে। এমনটাই অনুভব করেছেন যুগে যুগে অনেক কবি,দার্শনিক,চিত্রকর ও লেখকগণ। তাই তারা কাব্যে, গল্পে, চিত্রকল্পে এই ম্যাজিক রিয়ালিজম নিয়ে এসেছেন।
ম্যাজিক রিয়ালিজম কি?
যাকে বাংলায় বলি জাদু বাস্তবতা। তাহলে আমরা একটা জাদুর দৃশ্যে প্রবেশ করি।
সেখানে একটি লোক যার হাতে একটি কাগজের ব্যাগ, লোকটি সেই ব্যাগের মধ্যে একটি কবুতর ঢুকিয়ে দিয়ে গায়েব করে দিলো! কেমন লাগবে তখন? সবাই হতবাক! এটা কি করে সম্ভব! একেবারেই অবিশ্বাস্য!
অথচ বাস্তবে ঘটে গেছে শত শত মানুষের সামনে। আসলে কাজটি অবাস্তব। কিন্তু ম্যাজিক রিয়ালিজমে এটার ব্যাবহার অবিশ্বাস্য হলেও বাস্তব লাগবে। লেখক যে দিকে খুশি সেদিকে পাঠককে নিয়ে যেতে পারেন অবলীলায়, এখানে স্বাধীনতা অবাধ।
ধরে নিন এক লোকের তিন ছেলে, তারমধ্যে ছোটো ছেলেটির একটি অদ্ভুত গুন আছে। আর সেটা হলো, ছেলেটি তার হাত ইচ্ছে করলেই ৫ গুন লম্বা করতে পারে! এখন এই পরিবার নিয়ে একটি গল্পঃ লেখা হলো। যেহেতু গল্পে একটি ছেলের হাত লম্বা হয়, লেখক ইচ্ছে করলে এমন চরিত্র আরো বাড়াতে পারেন। ইদানিং অনেকেই এমন ধরনের গল্পঃ কবিতা লিখছেন। কিন্তু এই বিষয়টি মানুষকে কতদিন আনন্দ দিবে! সময়ের পরিভ্রমণে এটাও প্রবীণ হয়ে যাবে। তাই আমি বলি, যেহেতু সময় কম, ছোট্ট কথায় বিষাদ সিন্ধু ঢুকিয়ে দিতে হবে, সেইসাথে মান ভালো হতে হবে। একের ভেতর অনেক। একটা থ্রি ডি ছবির মতো। একটা থ্রিডি ফটোর দিকে তাকিয়ে থাকলে আরো দুটি তিনটি ছবি দেখা যায়। কিন্তু সাহিত্যে সেটা গোনা সম্ভব নয়, হাজার পাঠকের হাজার কল্পনা। আমি এটাকে বলি থ্রিডি কবিতা। যেটা নিয়ে কথা হচ্ছিলো সেই ম্যাজিক রিয়ালিজম। আচ্ছা বলুনতো যুগে যুগে নতুন কিছু আসে।
মানুষ তাকে গ্রহণ করে, আর কেউ কেউ অমর হয়ে যায়। ঠিক তেমনই এসেছে ম্যাজিক রিয়ালিজম। এসেছে সময়ের প্রয়োজনে। অথচ বিষয়টি যে ছিলো না, তা কিন্তু নয়, ছিলো, মানুষের অন্তরে,মানুষের ভাবনায়, তাই সেটার জন্ম হয়েছে।
জাদু বাস্তবতায় একটি অতি বাস্তবতা লুকিয়ে থাকে। মানুষ চায় এমনটা। তাই কবিতা বা গল্পে চিত্রকল্পে যেখানেই ম্যাজিক রিয়ালিজম হয়; মানুষ সেটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নেয়। কারণ বিষয়টি এমন ভাবে উপস্থাপন করা হয় যেনো বোঝা যায় ব্যাপারটা বাস্তবে ঘটছে। পাঠক অথবা দর্শক বিষয়টির সাথে জড়িয়ে পড়ে নিজের অজান্তে। নিজেকে একটি চরিত্রে প্রতিস্থাপন করে। এবং সেখানে সে মুক্ত স্বাধীন। সে আটকা পড়ে যায় মায়াজালে। এজন্য লেখার সময় খুব সচেতনতার সাথে শব্দের নির্বাচন করা আবশ্যক। ইন্দ্রিয় গিয়ে যখন অতীন্দ্রিয় তে আঘাত করবে, তখন যেনো প্রতিবিম্ব ফেরৎ না আসে। সে যতই গভীরে প্রবেশ করুক না কেনো, সবটাই যেনো স্বাভাবিক ভাবে সে গ্রহণ করে। আর সেই সাথে আরো গভীরের হাতছানি। এই হাতছানি টুকু পয়দা করাটাই পাণ্ডিত্য। সবাই এটা পারে না।
গল্পের ভেতরের গল্পঃ সাজানো সত্যিই একটু কঠিন বৈকি তবে অসম্ভব নয়। অর্থাৎ একটি গল্পঃ লেখার সাথে সাথে আরো দুটো তিনটে গল্পঃ লিখতে হয়। আর সেই গল্পগুলি লেখে হলো মনে মনে। কলমে বেরোয় মূল গল্পটি।
তাই ম্যাজিক রিয়ালিজম এর ব্যবহার একেবারে সহজ কিছু নয়।
বিষয়টি গবেষণার, ভাবনার, আলোচনার, চর্চা করার।
ধরা যাক একটি গল্পে এক রাখাল গেছে গরুকে ঘাস খাওয়াতে। রাখাল মাঠে নিয়ে গিয়ে গরুগুলোকে ছেড়ে দিলো। গরুগুলো ঘাস খাচ্ছে শান্ত মনে।
হঠাৎ শুরু হলো ফুটবল খেলা। গরুগুলো সবাই ফুটবল খেলছে।”
এরপর গল্পটিকে এমন ভাবে উপস্থাপন করতে হবে যেনো পাঠক সেটাকে মেনে নিয়ে গল্পের পরের অংশ পড়ার জন্য মুখিয়ে ওঠে।
কত্থেকে যেনো অনেক দর্শক এলো। সবাই কিছু না কিছু বাজিয়ে প্লেয়ার দের উৎসাহ দিচ্ছে।
বিষয়টি বেশি দীর্ঘ করা যাবে না। আর যদি দীর্ঘ করতে চান তবে ঐ যে আগেই বলেছি পণ্ডিত হতে হবে।
যাই হোক এই যাদু বাস্তবতা নিয়ে বললে শেষ করা যাবে না। তবু কিছু বলতেই হয়।
এ সম্পর্কে ম্যাক্সিকান সাহিত্য সমালোচক লুই লীল বলেছেন, ‘আপনি যদি ব্যাখ্যা করতে পারেন এটি কি, তাহলে তা জাদুবাস্তবতাই নয়।’ অর্থাৎ জাদুবাস্তবতা এমন এক বিষয় যা ব্যাখ্যা করা সহজ নয়
জাদুবাস্তবতার গডফাদার মার্কেজ বলেছেন, ‘আমরা যে বাস্তবকে দেখি, তার পেছনে যে ধারণাটা আছে সেটাই জাদুবাস্তবতা।’ সহজভাবে বলা যায়, বাস্তব পার্থিব কাঠামোর সঙ্গে ফ্যান্টাসির উপাদান মিলে তৈরি হয় জাদুবাস্তবতা। এটি এমন একটি জাদুময় অনুভূতি, যাতে মনে হবে যেকোন কিছুই ঘটা সম্ভব। তবে এ রীতিকে প্রায়ই মেলানো হয় পরাবাস্তব, অতিপ্রাকৃত, উদ্ভট, রূপকথা, আজগুবি ঘটনার সঙ্গে। কেননা শুধু জাদু সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে গল্প বললেই সেটি জাদুবাস্তবতা নয়। লিন্ডসে মুরের মতে, জাদুবাস্তবতা স্বাভাবিক ও আধুনিক পৃথিবীর মানুষ আর সমাজের বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনার প্রেক্ষাপটে স্থাপিত।
১৯২৫ সালে সমালোচক ফ্রাঞ্জ রোহ প্রথম ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তবতা শব্দের ব্যবহার করেন। তার ইচ্ছা ছিল জার্মান শিল্পীদের অঙ্কিত ছবিতে দৈনন্দিন জীবনের সাথে অতিপ্রাকৃতকে উপস্থান করার ধারাকে বর্ণনা করা। পরে চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে অন্যান্য সংস্কৃতির সমালোচকেরাও ধারণাটাকে নিজেদের মধ্যে আমদানি করল। জর্জ ওকিফে, ফ্রিদা কাহলো এবং এডওয়ার্ড হোপার—সকলেই এই জাদুবাস্তবতা চর্চাকারীদের আওতাভুক্ত।
ম্যাজিক রিয়ালিজমের চরিত্রেরা খুবই স্বাভাবিকভাবে তাদের অতিপ্রাকৃতিককে মেনে নেয়। সাধারণত হরর গল্পগুলোতে একধরনের কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা জাগিয়ে রাখার জন্য চরিত্রদের দিয়ে কারণ আবিষ্কারের চেষ্টা করানো হয়। জাদুবাস্তব সাহিত্যে এমনটা একেবারেই নেই। তাই বাগান থেকে কারো উধাও হয়ে যাওয়া অন্যান্য চরিত্রের কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হয় না। মনে হয় যেন এটা হওয়া খুবই সম্ভব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন