শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

যানজট কমাবে পাতাল রেল

স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন স্মার্ট যানবাহন : ওবায়দুল কাদের গণপরিবহনে সমন্বয় আনতে হবে : ড. শামছুল হক

একলাছ হক | প্রকাশের সময় : ২৫ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

যানজটের নগরী ঢাকাকে একটু স্বস্তি দিতে ইতোমধ্যেই নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। রাজধানীর যানজট নিরসন করে নগরবাসীকে সাচ্ছন্দ্যে চলাচলের জন্য একাধিক ফ্লাইওভার, ইউলুপ ও ইউটার্ন নির্মাণ করা হলেও শতভাগ উপকার পাননি সাধারণ মানুষ। বরং এখন যানজট নিরসনের জন্য নির্মিত ফ্লাইওভারের কয়েকটিতে নিয়মিতই যানজট লেগে থাকে। আর এই যানজটের কারণে কর্মজীবী মানুষকে রাস্তায় বসে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একই কারণে ঢাকাবাসীর নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার কর্মঘণ্টা।
যানজট নিরসনে রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত এমআরটি-১ এর আওতায় পাতাল রেল নির্মাণের চুক্তি ইতোমধ্যে সই হয়। এটি যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করছেন পাতাল রেলের স্বপ্ন এখন বাস্তবতার দ্বার প্রান্তে। রাজধানীর যানজট ও গণপরিবহনের নৈরাজ্যে টনিক হিসেবেই কাজ করবে পাতাল রেল। দৈনিক হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করবে মাটির নিচে দিয়ে। প্রতিদিনের নাগরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলবে সহজেই।
দেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেল প্রকল্পের পরামর্শকের দায়িত্ব পেয়েছে জাপানের নিপ্পন কোয়ে কোম্পানি লিমিটেড নেতৃত্বাধীন আট প্রতিষ্ঠান। গত রোববার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এ বিষয়ে একটি চুক্তিতে সই করেন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক এবং নিপ্পন কোয়ের নাও কি কুদো। ঢাকা ম্যাস ট্রান্সজিট কোম্পানি লিমিটেড আয়োজিত এমআরটি লাইন-১ (মেট্রোরেল) এর নির্মাণ কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ছয়টি এমআরটি লাইন নির্মাণ করা হবে। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন স্মার্ট যানবাহন। পৃথিবী এগিয়ে চলেছে আমরা পিছিয়ে থাকতে পারি না।
জানা যায়, ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট-১ লাইনের (এমআরটি-১) হিসেবে চিহ্নিত এ প্রকল্পে বিমানবন্দর থেকে কুড়িল, বাড্ডা, রামপুরা হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটারের পুরো অংশ হবে ভূগর্ভে। এ অংশে থাকবে মোট ১২টি স্টেশন। আরেক অংশ হবে এলিভেটেড সেই অংশ নতুন বাজার থেকে কুড়িল হয়ে যাবে পূর্বাচলে। ১১ দশমিক ৩৬৯ কিলোমিটারের এ অংশে থাকবে মোট নয়টি স্টেশন। মোট ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ ২০২৬ সাল নাগাদ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে দেশের প্রথম পাতাল রেল নির্মাণের তদারকির জন্য আট কোম্পানির একটি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড। চলতি বছরের ডিসেম্বরে শুরু হবে প্রকল্পটির কাজ।
চুক্তি অনুসারে, জাপানি নিপ্পন কোই কোম্পানি লিমিটেডের নেতৃত্বে কনসোর্টিয়ামটি রাজধানীতে ৩১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার পাতাল রেল প্রকল্প বা এমআরটি লাইন-১ নির্মাণের তত্ত্বাবধান করবে। কনসোর্টিয়ামভুক্ত কোম্পানিগুলো হলো- নিপ্পন কোই কোম্পানি লিমিটেড (জাপান) জেভি, ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্টস গ্লোবাল কোম্পানি লিমিটেড (জাপান), সিস্ট্রা এসএ (ফ্রান্স), দিল্লি মেট্রোরেল করপোরেশন লিমিটেড (ভারত), নিপ্পন কোই ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড, কাতাহিরা অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্টারন্যাশনাল (জাপান), ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্টস লিমিটেড (বাংলাদেশ) এবং নিপ্পন কোই বাংলাদেশ লিমিটেড। ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক এবং নিপ্পন কোই বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাওকি কুডো নিজ নিজ পক্ষের হয়ে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০১৯ সালে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকায় এমআরটি লাইন-১ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে। এরমধ্যে সরকার ১৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা এবং দেবে জাপান ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। তবে, কোভিড মহামারির কারণে একনেক অনুমোদনের পরেও নির্মাণ কাজ একাধিকবার বিলম্বের মুখোমুখি হয়েছে।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে কর্মকর্তারা বলেন, প্রকল্পটিকে ১২টি প্যাকেজে ভাগ করে পাতাল রেল নির্মাণের কাজ বাস্তবায়ন করা হবে। নভেম্বরে কনসালটেন্সি চুক্তি স্বাক্ষরের পর, ভূমি উন্নয়নের প্রথম প্যাকেজের কাজ চলতি বছরের ডিসেম্বরের প্রথমেই শুরু হবে। লাইনটিতে ২১টি স্টেশন থাকবে- ১২টি আন্ডারগ্রাউন্ড এবং নয়টি এলিভেটেড। এই লাইনে প্রতিদিন ৮ কোচ বিশিষ্ট ২৫টি ট্রেন চলাচল করবে। একটি ট্রেনের ধারণক্ষমতা হবে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৮৮জন। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর যেতে সময় লাগবে মাত্র ২৪ মিনিট ৩০ সেকেন্ড। এছাড়া, নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল যেতে ২০ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড এবং কমলাপুর থেকে পূর্বাচল যেতে লাগবে ৪০ মিনিট। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রুটে প্রতি আড়াই মিনিটে একজন যাত্রী ট্রেন ধরতে পারবেন, আর নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল রুটে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৪ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড। ট্রেনগুলো অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টারের মাধ্যমে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। যাত্রীদের সহজে রেল প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের জন্য পাতাল এবং এলিভেটেড স্টেশনগুলোতে থাকবে লিফট, সিঁড়ি এবং এসকেলেটর। ২০২৮ সালে উদ্বোধনের পরে প্রায় ৮ লাখ যাত্রী প্রতিদিন পাতাল রেলে যাতায়াত করতে পারবেন।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, পাতাল রেল যা মেট্রোরেলের লাইন বা এমআরটি-১ নামেও পরিচিত, সেটি বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত যাবে। মেট্রোরেলের মতো এটিও হবে বিদ্যুৎ-চালিত রেল। এবং এটি হবে দূর নিয়ন্ত্রিত ট্রেন। দূর নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য থাকবে অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টারও। এমআরটি-১ এর রেললাইনে দুটি অংশ থাকবে, প্রথম অংশটি পুরোপুরি পাতালপথে, দ্বিতীয়টি উড়ালপথ। এই দুই পথের জন্য মোট ১৯টি স্টেশন চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে পাতালপথে স্টেশন হবে ১২টি।
ঢাকা ম্যাস ট্র্যানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক বলেন, জনসাধারণ, সাংবাদিকসহ সকল অংশীজনের সহযোগিতা ছাড়া জনবহুল বাংলাদেশে এমআরটি লাইন-৬ বাস্তবায়ন সম্ভব ছিলো না। ইতোমধ্যে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পাতাল রেল মাটির কমবেশি ৩০ মিটার নিচ দিয়ে যাবে। টানেল বোরিং মেশিন দিয়ে এর নির্মাণকাজ চালানো হবে।
ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে এমআরটি লাইনের মাধ্যমে।
নিপ্পনের শীর্ষ কর্মকর্তা ইচি গুচি তমু হিতে বলেন, জাপান-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক এ প্রকল্পের মাধ্যমে আরও এগিয়ে যাবে। মাতারবাড়ী প্রজেক্ট, শীতলক্ষ্যা সেতু। এমআরটি-১ বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৩ বাংলাদেশের সাথে জাইকার যে দীর্ঘ সম্পর্ক তার সূচনা হয়। বর্তমানে বিভিন্ন সেক্টরের বিভিন্ন প্রকল্পে জাপান অর্থায়ন করছে। জাইকা বর্তমানে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম উন্নয়ন সহযোগী।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রফেসর ড. শামছুল হক বলেন, পাতাল রেল পরিবহন ব্যবস্থার পুর্ণঙ্গ রূপ না। ঢাকায় গণপরিবহনে সমন্বয় নেই। সেই সমন্বয় আনতে হবে। পাতাল রেলে ব্যয় বেশি, আলো সমস্যাসহ নানা সমস্যা থাকে। ঢাকার যানজট থেকে মুক্তির জন্য সাবওয়ে বা পাতালরেল হলো খন্ডিত উন্নয়ন। এককভাবে শুধু পাতাল রেল হলেই যানজট নিরসন হবে না। এই শহরের যানজট মুক্ত করতে হলে গণপরিবহন, সিগন্যালসহ সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন করতে হবে। আমাদের বিজ্ঞান ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে। কারো কারো চোখে হয়ত এমন দেখেন যে, পাতাল রেল হলেই ঢাকার যানজট মুক্ত হয়ে যাবে। ###

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন