গত আলোচনায় আমরা রাসূল (সা.)-এর বদৌলতে প্রাপ্ত দু’টি নেয়ামতের কথা আলোচনা করেছিলাম। আজ আরো কিছু নেয়ামতের কথা আলোচনা করা হলো। তৃতীয় নেয়ামত আহকাম ও হেদায়েত, স্রষ্টার নির্দেশ ও নির্দেশনা। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ জীবনের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে ঐশী বিধানের দাবিদার। একথা যেমন সত্য যে, পৃথিবীতে ধর্মের অবমাননা ও অস্বীকারকারীর অভাব নেই, তেমনি একথাও সত্য যে, সকল ধর্মের প্রভাবমুক্ত মানুষও পৃথিবীতে নেই।
সকল ধর্মের গোড়ার কথা, সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য ও উপাসনা। অথচ আনুগত্যের জন্য চাই বিধান আর উপাসনার জন্য পদ্ধতি। আল্লাহর আহকাম ও বিধানের সূত্র কী? পূর্বপুরুষের সংস্কার, গোত্রীয় রীতি-নীতি, সামাজিক প্রচলন, গোত্রপতি ও সমাজপতিদের আদেশ-নিষেধ, আহবার-রোহবান বা মুনি-ঋষিদের উদ্ভাবিত নিয়মকানুন-এসব কি আসমানী বিধানের সূত্র? নাউযুবিল্লাহ।
অথচ এসবের ভিত্তিতেই তো কত জাতি স্রষ্টার ‘উপাসনায়’ লিপ্ত এবং তাঁর ‘সন্তুষ্টি’ অন্বেষণে মগ্ন! অথচ এসব ছিদ্রপথেই মানব-সমাজে বিস্তার লাভ করেছে নানাবিধ কুসংস্কার এবং মানুষে মানুষে বিভেদ-বৈষম্য। কিছু মানুষ ‘স্রষ্টার আসন’ অধিকার করেছে আর কিছু মানুষ তাদের দাসত্বে নিয়োজিত হয়েছে। এইসব মানবরচিত নিয়মকানুন ঐশী বিধান নয়; বরং মানবজাতিকে এই চরম লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত করার জন্যই প্রয়োজন আসমানী আহকাম।
এই সত্যই রোস্তমের দরবারে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন আল্লাহর নবীর সাহাবী হযরত রিবয়ী ইবনে আমির (রা.)। তিনি বলেছিলেন : ‘আমরা এসেছি আল্লাহর আদেশে, মানুষকে মানুষের উপাসনা থেকে মুক্ত করে স্রষ্টার উপাসনায় নিয়োজিত করতে আবিল ও সংকীর্ণ জীবন থেকে মুক্ত করে উদার-স্বাধীন জীবনের সন্ধান দিতে এবং সকল মনগড়া মতবাদের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়ে ইসলামের সাম্য ও শান্তির ছায়ায় স্থান দিতে।’ (আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া)
আমরা কীভাবে এই নেয়ামতের শোকর আদায় করব যে, কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে রাব্বুল আলামীনের নির্দেশ ও নির্দেশনা শুধু আছে আমাদেরই কাছে। আমরা কি আল্লাহর শোকরগোযার বান্দা? আমরা কি নবীর ওয়াফাদার উম্মত? সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
চতুর্থ নেয়ামত আল্লাহর ওয়াদা। হৃদয় ও আত্মার শাশ্বত প্রশ্ন, আমি কোথা থেকে এসেছি এবং কোথায় চলেছি। এই জীবন-সফরে আমার গন্তব্য কী। এর জবাব শুধু আছে তাঁর কাছে যিনি হৃদয় ও আত্মার স্রষ্টা এবং যাঁর আদেশে প্রাণের বিকাশ ও পরিণতি। ইরশাদ হয়েছে : ‘তারা আপনাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, রূহ আমার পালনকর্তার আদেশঘটিত। আর তোমাদেরকে সামান্যই জ্ঞান দেওয়া হয়েছে।’ (সূরা বনী ইসরাইল : ৮৫)।
তিনিই বপন করেছেন মানব-হৃদয়ে প্রশ্নের বীজ। এরপর নিজেই তার জবাব দিয়েছেন। ঈমানদার বান্দাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জান্নাতের চিরশান্তির এবং রবের সন্তুষ্টির। জীবনের শেষে মুমিনকে বলা হবেÑ ‘হে প্রশান্ত চিত্ত! তুমি ফিরে এস পালকর্তার নিকট সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও। আর আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।’ (সূরা ফজর : ২৭-৩০)। এই সকল আসমানী নেয়ামত আমরা পেয়েছি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওসীলায়।
তিনি যেমন আল্লাহর কালাম কুরআন মজীদ পৌঁছে দিয়েছেন তেমনি নিজেও ছিলেন জীবন্ত কুরআন। তাঁর বাণী ও কর্ম কুরআন মজীদের সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। তিনি একদিকে ছিলেন আল্লাহর মহব্বত ও মারিফাত এবং ইবাদত ও ইতাআতের সর্বোত্তম নমুনা, অন্যদিকে ছিলেন বান্দার হক ও অধিকার এবং সৃষ্টির সেবা ও খিদমতের সর্বশ্রেষ্ঠ দায়ী।
তিনি যেমন রেখে গেছেন জীবন যাপনের সর্বোত্তম আদর্শ তেমনি দেখিয়ে গেছেন আখিরাতের প্রস্তুতির সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। তিনি তাঁর অতুলনীয় শিক্ষক-গুণের দ্বারা এমন এক জামাত তৈরি করেছেন, যাঁরা ছিলেন তাঁর প্রকৃত উত্তরসূরী। নবীর জীবন ও আদর্শকে তাঁরা ধারণ করেছেন, এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস। একদিকে আসমানী ইলম নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত হয়েছে অন্যদিকে জীবনের সকল অঙ্গনে আসমানী আহকাম বাস্তাবায়িত হয়েছে।
কুরআন ও সুন্নাহর সেবার জন্য উদ্ভাবিত হয়েছে অসংখ্য ফন ও শাস্ত্র এবং প্রস্তুত হয়েছে অসংখ্য মনীষীর চিন্তা ও গবেষণার অমূল্য ভান্ডার। ধর্মীয় জ্ঞানের এই বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার একমাত্র ইসলামেরই বৈশিষ্ট্য। খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামলে ইসলামী খিলাফতের বিপুল বিস্তার, সমাজের সর্বস্তরে ইনসাফ ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা, জনসাধারণের নৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতি, অর্থের সুষম বণ্টন এবং জ্ঞান ও গবেষণার উদার পৃষ্ঠপোষকতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে, অনাগত কাল পর্যন্ত যার কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ইসলামী খিলাফত ছিল সময় ও কালের ওই সোনালী পর্ব, যখন রাজ্যহীন ধর্মের অসহায়ত্ব আর ধর্মহীন রাজ্যের অভিশাপ থেকে মানবজাতি মুক্তি পেয়েছিল। সত্যিই আমরা কি আল্লাহর শোকরগোযার বান্দা? আমরা কি নবীর ওয়াফাদার উম্মত? সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন