শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ঈদ এ মিলাদুন্নবী

ঈদে মিলাদুন্নবীতে বিনীত নিবেদন

| প্রকাশের সময় : ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক : আমি মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমাকে কোনো পশু বা অন্য প্রাণী হিসেবে না পাঠিয়ে, মানুষ হিসেবে পাঠিয়েছেন। আমি মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমাকে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ হিসেবে না পাঠিয়ে, আধুনিক যুগের একজন মানুষ হিসেবে পাঠিয়েছেন। আমি মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমাকে পাথর-পূজারী বা সূর্য-পূজারী বা অগ্নি-পূজারী ইত্যাদি হিসেবে না পাঠিয়ে, নিরাকার মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বান্দা হিসেবে পাঠিয়েছেন। শত শত হাজার হাজার বছর ধরেই আল্লাহর বান্দা হিসেবে মানুষ পৃথিবীতে এসেছে। আমি মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞ এই জন্য যে, তিনি আমাকে তাঁরই মহান বন্ধু প্রিয়তম বন্ধু সর্বশেষ নবী ও রাসূলের উম্মত হিসেবে পাঠিয়েছেন। আমার জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার পর, আমি জানতে পেরেছি যে, সর্বশেষ নবীর উম্মত হতে পারাটাই এটি মহাসৌভাগ্যের ব্যাপার। অতএব আমি সেই সর্বশেষ নবী ও মহান আল্লাহ তায়ালার প্রিয়তম বন্ধুর ব্যাপারে আগ্রহী থাকব, তাঁর প্রশংসা করব এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক। আজ মঙ্গলবার, খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডার মোতাবেক, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬। কিন্তু হিজরি ক্যালেন্ডার মোতাবেক এটি অতি বিখ্যাত ঐতিহাসিক দিন। আজ ১৪৩৮ হিজরি সালের রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ। সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-এর জন্মদিবস। ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। বিশ্বমানবতার আশীর্বাদ, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। বারটি ছিল সোমবার। ইনকিলাব-এর একটি পৃষ্ঠায় একটি নাতিদীর্ঘ কলামে, নবীজীবন সম্বন্ধে আলোচনা একটি অতি বিনীত প্রয়াস।  
হিজরি বছর যেহেতু চন্দ্র বছর তথা চন্দ্র-পঞ্জিকা অনুসরণ করে, তাই হিজরি বছর আমাদের সুপরিচিত বছর বা সৌর বছর থেকে ১১ দিন কম হয়। ৩৩ সৌর বছর থেকে একটু কম বা একটু বেশি সময়ে চন্দ্র বছর (তথা হিজরি বছর) সৌর বছরের সঙ্গে একই সমান্তরালে বা একই রেখায় একবার আসে। উদাহরণ দিয়ে বললে এরকম বলা যায় যে, ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ বা সৌর বছরে পবিত্র হজ সম্পাদিত হয়েছে ১৪ অক্টোবর তারিখে। ঐদিন সৌদি আরবে ছিল জিলহজ মাসের ৯ তারিখ এবং বাংলাদেশে ছিল জিলহজ মাসের ৮ তারিখ। কেন সৌদি আরব ও বাংলাদেশ তথা এই দুই জায়গায় দুইটি তারিখ হলো সেই গবেষণা এই কলামে করব না। আনুমানিক ৩৩ বছর পর অর্থাৎ ২০৪৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসের ৭, ৮, ৯, ১০ বা ১১ তারিখ আবার হজ হবে। যখন দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) হিজরি ক্যালেন্ডার চালু করেন তখন তৃতীয় মাস হিসেবে স্থির করেছিলেন রবিউল আউয়াল মাসকে। অর্থাৎ রবি (বসন্ত) আউয়াল (প্রথম) মাস। এর পরের মাসই হলো রবি (বসন্ত) সানি (দ্বিতীয়)। এর পরের দুই মাস হলো জমাদিউল আউয়াল (বা জমাদিউল উলা) এবং জমাদিউস সানি (বা জমাদিউল উখরা)। জমদ শব্দের অর্থ হলো বরফ জমাট বাঁধা। ঐ সময় শীত ছিল প্রচুর তাই এই দুই মাসকে পঞ্চম এবং ষষ্ঠ মাস হিসেবে স্থির করা হয়েছিল। আমরা এটুকু বললাম এ কারণে যে, ইসলামী সংস্কৃতির অনেক কিছুই আজকের বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম জানেন না। না জানার জন্য তারা অর্থাৎ তরুণরা, যতটুকু না দায়ী, তার থেকে অনেক বেশি দায়ী আমরা যারা প্রবীণ, তারা। এটি আমার ব্যক্তিগত অভিমত। আমরা বলতে নিশ্চিতভাবেই আমার সমমনাদেরকে বোঝাচ্ছি। কারণ, যারা আমার সমমনা নয় তারা এই দায়ভার কেন গ্রহণ করবেন, এটিও একটি অতি সঙ্গত প্রশ্ন। কোমলমতি শিশুদের লেখাপড়ার সিলেবাসে মহানবী (সা.)-এর জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু লেখা নেই। যা কিছু লেখা সেটি দায়সারা গোছের। তাহলে কোমলমতি শিশুরা মহানবী (সা.)-এর জীবন সম্বন্ধে কিছু জানার জন্য আনুষ্ঠানিক আর কোনো পদ্ধতি নেই। যারা সমাজে প্রবীণ তাঁদের ওপর দায়িত্ব বর্তায়, বাংলাদেশে বিদ্যমান চলমান বৈরী পরিবেশে নবীন ও কনিষ্ঠদেরকে দ্বীন ইসলামের কথা এবং নবী (সা.)-এর কথা জানানো।   
রবিউল আউয়াল মাস মানব ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়ের স্মারক। রবিউল আউয়াল মাস যখন আসে তখন সাধারণভাবে প্রথম বারো দিন বাংলাদেশে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে বিভিন্ন প্রকারের আলোচনা সভা এবং সেমিনার এবং সর্বোপরি, বারোতম দিবসে  মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। সাম্প্রতিক তথা পনেরো-বিশ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি যে, মিলাদুন্নবী উদযাপন করা হবে নাকি সিরাতুন্নবী উদযাপন করা হবে, এই নিয়ে বিতর্কও চলবে। পত্রিকায় পক্ষে-বিপক্ষে কলাম লেখা হবে, টেলিভিশন টকশোগুলোতে বিজ্ঞ আলেম-ওলামাগণ পক্ষে-বিপক্ষে মতামত প্রদান করবেন এবং সাধারণ শ্রোতাম-লী নীরব দর্শক হিসেবে সেগুলো শুনবেন। কোনো কোনো কলাম লেখক বা টিভি আলোচকগণ বলবেন যে, মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয় অবৈধ এবং সিরাতুন্নবী অনুষ্ঠানই কাম্য। কোনো কোনো কঠোর মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি কঠোর মতবাদ, ফতোয়া ইত্যাদি ব্যক্ত করবেনই। অপরপক্ষে মিলাদুন্নবীর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে, মিলাদুন্নবীর উপযুক্ততা নিয়ে, মিলাদুন্নবীর প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও টেলিভিশনে আলোচনা হবে, পত্রিকায় কলাম লেখা হবে। আমি নিশ্চিতভাবেই মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠানের পক্ষে। আমার মতে, আমি যাঁর উম্মত, আমি তাঁর জন্মদিনে অবশ্যই আনন্দের মাধ্যমে আলোচনা করব এবং দিবসটিকে শরিয়তসম্মতভাবেই আনন্দের মাধ্যমে উদযাপন করব। এইদিনে বা এইদিনের আগেভাগে পূর্ববর্তী দিনগুলোতে বিভিন্ন আমলও হবে; নফল রোজাও হবে। নবীজির (সা.) জন্মের কারণে বছরের প্রতিটি সোমবারই অতি মূল্যবান হয়ে গেছে। তাই এদিনে নফল রোজা রাখার অভ্যাসকে স্বাগতম জানানো হয়েছে। এ দিনে রোজা রাখা প্রকৃত নবী-প্রেমের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে নির্দেশনা দিয়েছেন, মহানবী (সা.)কে মান্য করতে ভালোবাসতে। ভালোবাসা প্রকাশ আনন্দের মাধ্যমেই উপযুক্তভাবে করা হয়। ভালোবাসার প্রকাশ সহমর্মিতার মাধ্যমেই হয় যেমন কিনা হযরত ওয়ায়েস করনি রাদিআল্লাহু আনহু, ওহুদের যুদ্ধের পরে, রাসূল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ তাঁর নিজের দাঁতগুলো উপড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।   
এই কথাগুলো আমি বলছি একান্তভাবেই আমার অভিজ্ঞতার আলোকে। আরবি শব্দের ব্যাখ্যা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিবাদ না করে আমরা কর্মের দিকে মন দিতে চাই। ভালোবাসাও একটি কর্ম। নেতাকে ভালোবাসা সকল অনুসারীর জন্য অপরিহার্য কর্ম। সাধারণ ভাষায় নেতা বললেও, ইসলামী সংস্কৃতির পরিভাষায় মহানবী (সা.)-এর জন্য শুধুমাত্র নেতা শব্দটি কোনোমতেই যথেষ্ট নয়। তিনি নবীগণের নেতা, তিনি রাসূল এবং রাসূলগণের ইমাম বা নেতা। তাঁর প্রতি মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেই সম্মান প্রদর্শন করেন, দরুদ পাঠ করেন। তাহলে আমরাও সম্মান প্রদর্শন করব, দরুদ পাঠ করব। একা একা এবং সমষ্টিগতভাবে। কিন্তু এটাই শেষ নয়; আমাদের উপর অতিরিক্ত কিছু দায়িত্বও আছে। আমরা যেন সেই দায়িত্বগুলোর দিকেও মনোযোগী হই।
বাংলাদেশে ইসলামের আগমন হয়েছিল পীর দরবেশ আওলিয়াগণের মাধ্যমে। বাংলাদেশে বর্তমান মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৃহদাংশই অতীত ও বর্তমানের সম্মানিত শ্রদ্ধেয় পীর দরবেশ আউলিয়াগণের ভক্ত, অনুরক্ত এবং অনুসারী। রবিউল আউয়াল মাসের প্রথম দশ বারো বা চৌদ্দ দিন প্রায় শতকরা একশ ভাগ সম্মানিত পীর দরবেশ আউলিয়াগণের দরবারে তথা খানকায় মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠান হবে। ১২ রবিউল আউয়াল মহানবী (সা.)-এর পবিত্র জন্মদিবস তথা মিলাদুন্নবী দিবস তথা রাসূল (সা.)-কে ভালোবাসেন এমন সকল ব্যক্তির জন্য আনন্দের দিবস। আনন্দ এই জন্য যে, এই দিনটি আমাদের প্রিয় নেতার জন্মদিন। আমি পুনরায় উল্লেখ করছি যে, বিকল্প উন্নত শব্দের অভাবেই মাত্র আমি নেতা শব্দটি ব্যবহার করছি। বিকল্প শব্দ থাকতেই পারে; সেক্ষেত্রে আমার অজ্ঞতাই এটির জন্য দায়ী। আমাদের প্রিয় নেতা যদি পৃথিবীতে না আসতেন তাহলে আমরা তো তার অনুসারী (উম্মত) হতে পারতাম না। আমরা সৌভাগ্যবান যে, আমরা তাঁর উম্মত (অনুসারি) হতে পেরেছি। অতএব আমরা মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে যতবার সুযোগ পাব, যত রকম সুযোগ পাব, সবসময় সবরকমভাবেই আমরা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই থাকব এই মর্মে যে, তিনি মানবতার সেবায় ও মানবতার কল্যাণে মহানবী (সা.)কে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন এবং অতি দয়া পরবশত আমাদেরকে তাঁর উম্মত করেছেন। এখানেই শেষ নয়। ব্যক্তি ইবরাহিম এবং রাজনৈতিক কর্মী ইবরাহিম উভয়ের অনুভূতি সম্মিলিতভাবে অতি শক্তিশালী। পবিত্র কোরআনের ২১তম সূরা (তথা সূরা আম্বিয়া)-এর ১০৭ নম্বর আয়াত দ্রষ্টব্য। মহান আল্লাহ তায়ালা বলছেন যে, তিনি আল্লাহর রাসূলকে পাঠিয়েছেন, বিশ্ব-ব্রম্মা-ের জন্য রহমতস্বরূপ। আল্লাহ তায়ালার অন্যতম পরিচয় হচ্ছে তিনি আলামিন-এর রব। আমরা তাঁর প্রশংসা করি তথা আমরা বলি আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামিন। যেই আলামিন-এর রব হলেন মহান আল্লাহ তায়ালা, সেই আলামিনের জন্যই নির্ধারিত রহমত হলেন মহানবী (সা.)। মহানবী (সা.) হলেন কল্যাণের প্রতীক। তাহলে আমরা যারা তাঁর উম্মত, আমাদেরকেও চেষ্টা করতে হবে কল্যাণের প্রতীক হওয়ার জন্য। কল্যাণের প্রতীক হতে হলে, কল্যাণের কর্মী হতে হলে, আমাদেরকে মহানবী (সা.)-এর জীবন জানতে হবে এবং মানতে হবে। আলোচনার এই স্তরে আমার নিবেদন হচ্ছে, পৃথিবী তো কল্যাণই পেত না যদি না মহানবী (সা.)-এর জন্ম হতো। তাহলে ঐজন্ম অতি মূল্যবান, ঐজন্ম অতি উপকারী, ঐজন্ম সৃষ্টি জগতের অস্তিত্বের জন্য, সৃষ্টি জগতের উন্নতির জন্য, সৃষ্টিজগতের বিকাশের জন্য একটি অজুহাত বা উসিলা। অতএব ঐ জন্মকে তথা ঐ জন্মদিনকে স্মরণ করা যৌক্তিক-ই বটে।
উম্মত হিসেবে আমাদের দায়িত্ব একাধিক। প্রথম দায়িত্ব এবং করণীয় মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসা। পবিত্র কোরআনের নির্দেশ মোতাবেক আমরা আমাদের প্রিয় রাসূল (সা.)-কে আমাদের পরিবার পরিজন এবং পৃথিবীর অন্য সবকিছু থেকে বেশি ভালোবাসতে হবে। পারি বা না পারি, চেষ্টাতো করতেই হবে। দ্বিতীয় দায়িত্ব মহানবী (সা.)-এর সুন্নাতকে সমুন্নত রাখা। সুন্নত হচ্ছে একাধিক আঙ্গিকের। রাসূল (সা.) যা বলেছেন তাকে, সত্য হিসেবে স্বীকার করা ও মান্য করা। রাসূল (সা.) যেরকম নিয়মে ব্যক্তিগত জীবনযাপন করেছেন সেই নিয়মে নিজের ব্যক্তিগত জীবনযাপনের চেষ্টা করা, রাসূল (সা.) যেই নিয়মে সামাজিক জীবন প্রতিষ্ঠা করেছেন সেই নিয়মে নিজেকে খাপ খাওয়ানো এবং রাসূল (সা.)-এর সম্মানকে সমুন্নত রাখা। রাসূল (সা.)-এর সম্মানকে সমুন্নত রাখা প্রত্যেক ঈমানদারের অতি পবিত্র অপরিহার্য দায়িত্ব। মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেই ঘোষণা করেছেন পবিত্র কোরআনের একাধিক জায়গায় যে, তিনিই তাঁর প্রিয় রাসূলকে সম্মানিত করেছেন, মহিমান্বিত করেছেন এবং তাঁর সম্মানকে সর্বদা সমুচ্চ রাখার ব্যবস্থা তিনি আল্লাহ তায়ালাই রাখবেন। যেই কাজ আল্লাহ নিজে করছেন সেই কাজ আমরা বান্দাহগণ এবং উম্মতগণ কীভাবে না করি? বরং আমাদের ভূমিকাটিই হতে হবে সম্পূরক। এই কলামের শেষে আমি সামাজিক কথাগুলো নিয়ে বলব।
মহানবী (সা.) একজন ব্যতিক্রমী ধর্মীয় নেতা। তিনি শুধু নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের পদ্ধতি শিক্ষা দেননি। তিনি যা যা শিক্ষা দিয়েছেন, সেইসব কিছুই তাঁর সুন্নত এবং দ্বীন ইসলামের আওতাভুক্ত। আমরা শুধু নামাজ পড়ার পদ্ধতি গ্রহণ করব এবং সমাজে পরস্পরের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত সেই পদ্ধতি গ্রহণ করব না, এটা অনুচিত এবং অকাম্য। মহানবী (সা.)-এর আমলে নগর রাষ্ট্র মদিনার পরিধি ছোট ছিল, জনসংখ্যা কম ছিল। এতদসত্ত্বেও তিনি একটি রাষ্ট্রীয় ও সরকারি কাঠামোর গোড়া পত্তন করেছিলেন। মদিনার সনদ, এই একবিংশ শতাব্দীতেই গণতান্ত্রিক বিশ্বের ইতিহাসে স্বীকৃতভাবে প্রথম লিখিত রাষ্ট্রীয় সংবিধান বা তার কাছাকাছি একটি দলিল। মহানবী (সা.) যেই নীতিগুলো প্রচার করে গিয়েছিলেন বা কাঠামো স্থাপন করে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেগুলোকে বিকশিত করেছিলেন তাঁর পরবর্তী চারজন সত্যপন্থী খলিফা। বিগত ১৩০০ বছরে (১৪০০ শত নয়) আরো অনেক মুসলিম শাসক ও জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ বিভিন্ন দেশে এই অঙ্গনটিতে অবদান রেখেছেন। এই ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে তথা ১৪৩৮ হিজরিতে আমরা বাংলাদেশের মুসলমানগণ কী চিন্তা করতে পারি? ১৩০০ বা ১৪০০ বছর পূর্বে মোবাইল ফোন ছিল না, ফেইসবুক ছিল না। তাই বলে কি আমরা মোবাইল ফোন এবং ফেইসবুক ব্যবহার করব না? আমরা অবশ্যই করব কিন্তু মোবাইল ফোন বা ফেইসবুকের অশোভন সাইডটিকে পরিহার করব। উদাহরণস্বরূপ একটিমাত্র কথা বললাম। ১৩০০ বা ১৪০০ বছর পূর্বে যেসব মূলনীতি প্রচারিত হয়েছিল, সেই মূলনীতিগুলো এখনো প্রযোজ্য; সমাজে এবং রাষ্ট্রে। কিন্তু আজকের লেখাপড়া জানা মানুষগণ যদি ঐ মূলনীতিগুলো কী ছিল সেটা না জেনেই মন্তব্য করেন তাহলে সেটা দুঃখজনক।
আমি একটি উদার কথা বলব এবং যুগপৎ একটি কঠোর কথা বলব। উদার কথা কথা হলো এই যে, আপনি এই পৃথিবীর যে কোনো একজন মানুষ, আপনি মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি বিশ্বাস এবং রাসূল (সা.)-এর প্রতি বিশ্বাস এনে তথা ঈমান এনে মুসলমান হবেন কি হবেন না এটা একান্তই আপনার ইচ্ছা। এই নিয়ে আপনার সঙ্গে আমি বিতর্কে যাব না। শান্তিপূর্ণভাবে আপনার মতকে আমি সম্মান জানাব; আপনিও আমার ঈমান ও বিশ্বাসকে সম্মান জানাবেন। কঠোর কথা হলো এই যে, আপনি যদি নিজের ইচ্ছায় মুসলমান হন, তাহলে মুসলমানের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হবে, প্রয়োজনে জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং আপনার নিজের বিশ্বাসকে আপনি পৃথিবীর সামনে খাটো করতে পারবেন না। একটি সাংসারিক উদাহরণ দিই। ভোটের দিন ভোট কেন্দ্রে গিয়ে, ব্যালট পেপার দেখে একটি মার্কাতে ভোট দিতে হয়। এমন কোনো বিধান নেই যে, আপনার সিলটি দুই মার্কার উপরে দিবেন। অনুরূপ আপনার বিশ্বাসকে দ্বিখ-িত করার কোনো অবকাশ নেই; হয় আপনি মুসলমান হবেন এবং মুসলমানের মতো চলবেন অথবা চলবেন না। মুখে যদি বলেন আপনি মুসলমান এবং কাজকর্ম যদি মুসলমানের মতো না হয় তাহলে আপনার পরিচয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বিভিন্ন ব্যক্তি আপনাকে বিভিন্ন নেতিবাচক শব্দে অভিহিত করবে।
আমাদেরকে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন বৃত্তান্ত জানতে হবে; তাঁর জীবনের সংগ্রামী অধ্যায়গুলো জানতে হবে। মনের মধ্যে ভালোবাসার ঘাটতি পূরণ করতে হবে। রবিউল আউআল মাসে হলেও মন ও মানসিকতাকে প্রস্তুত করতে হবে। সম্মান যে কোনো সময়, যে কোনো মাসে বা স্থানে অবশ্যই জানোনো যায়; আমরা জানাতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু এই সংসার জগতে যেমন বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য বিশেষ বিশেষ সময় আছে তেমনই মহানবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য এবং সমষ্টিগতভাবে আনন্দ উৎফুল্লতার মাধ্যমে সেটি প্রকাশ করার জন্য, এবং তাঁকে অনুসরণের সংকল্প আরো শক্তিালী করার জন্য একটি বিশেষ সময় হলো, রবিউল আউয়াল মাস। আমি ব্যক্তিজীবনে আলেম নই, সাধারণ অভ্যাসরত মুসলমান। আমার পক্ষ থেকে আমার মতো সকল মুসলমান ভাই, বিশেষ করে তরুণদের প্রতি আবেদন যেন প্রত্যেকেই কয়েকটি ঘণ্টা ব্যয় করে চেষ্টা করি রাসূল (সা.)-কে জানতে, চিনতে এবং মানসপটে স্থান দিতে। কমপক্ষে রবিউল আওয়াল মাসে ইবাদতে নিজেকে ব্যস্ত রাখি।

রাসূল (সা.)-কে জানতে হলে, তাঁর জীবনী পড়তে হবে এবং বুঝতে হবে। রাসূল (সা.)-এর পরিবার সম্বন্ধে বা পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে জানতে হবে। রাসূল (সা.)-এর পরিবারকে তথা পরিবারভুক্ত ব্যক্তিগণকে মহান আল্লাহ তায়ালা বিশেষ মর্যাদায় সম্বোধন করেছেন, বিশেষ তাগাদা দিয়েছেন। মহানবী (সা.)-এর সম্মানিতা স্ত্রীগণ সম্মন্ধে মুসলমানগণকে সাবধান করে দিয়েছেন এই বলে যে, উনারা মুসলমানগণের জন্য মাতৃতুল্য বা আরবি পরিভাষায় বহুবচনে উম্মাহাতুল মোমিনিন। একটি প্রখ্যাত হাদিস আছে, এরকম। একদা বিশিষ্ট সাহাবীগণ রাসূল (সা.)-এর সম্মানিতা স্ত্রী মা আয়েশা (রা.)-এর নিকট নিবেদন করলেন যে, আমাদেরকে রাসূল (সা.)-এর জীবন সম্পর্কে বলুন। উম্মুল মোমিনিন আয়েশা (রা.) বললেন, তোমরা কি কোরআন পড়নি? কোরআনই উনার জীবন অর্থাৎ কোরআনের শিক্ষাগুলোর প্রতিফলন উনার জীবন। তাহলে এই একবিংশ শতাব্দীতে আমাদেরকেও রাসূল (সা.) সম্পর্কে জানতে হলে কোরান পড়তে হবে এবং রাসূল (সা.)- এর জীবনী পড়তে হবে। বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় রাসূল (সা.)-এর অনেকগুলো জীবনী সুলভে পাওয়া যায়। আমি কোনো একটির নাম এখানে নিচ্ছি না তবে ব্যক্তিগতভাবে কোনো পাঠক যদি যোগাযোগ করেন, আমি তাকে দু’একটির নাম উল্লেখ করতে পারব।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
ইমেইল : mgsmibrahim@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Abu Faiz Bulbul ৮ জুন, ২০১৮, ১০:১১ পিএম says : 0
Nice
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন