জনসংখ্যা, বাণিজ্য ও অর্থনীতি ও সমরশক্তিতে চীন বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে দেশটি এখন অন্যতম বিশ্বনিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় রয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধোত্তর রাশিয়া যখন নানাবিধ অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে পশ্চিমাদের মোকাবেলা করে কোনো রকমে টিকে থাকার যুদ্ধে লিপ্ত, তখন চীন আগামী বিশ্বের নেতৃত্বের ছক এঁকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে রাশিয়া এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব যখন প্রবল প্রতাপে মুখোমুখী অবস্থান নিয়েছে, চীন তখনো দুই পক্ষের মাঝখানে একটি ফলাফল নির্ধারণী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইউক্রেন ঘিরে গত কয়েক মাসের নাটকীয় ঘটনাক্রম চীনের শীতল ও কৌশলী ভূমিকার পেছনে রয়েছে তাদের পুরনো মহাপরিকল্পনার ছক। অনেকেই সিসিপি বা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় কংগ্রেসে নতুন সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্ব নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে ছিল। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো এবং কাউন্সিলররা দলের নেতা হিসেবে শি জিনপিংকে বেছে নিয়েছেন। একইভাবে আগামী বছর প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তিনি তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন হবেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। একদিকে চীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচন অনেকটা পূর্বনির্ধারিত শৃঙ্খলার মধ্যে, অন্যদিকে ক্ষয়ীষ্ণু পরাশক্তির ব্রিটেন তার নেতৃত্ব নির্বাচনে অনেকটা বিশৃঙ্খল ও টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বরিস জনসনের পদত্যাগের পর মাত্র দেড়মাসের ব্যবধানে আরেক নেতা লিজ ট্রাসও পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এখন ভারতীয় বংশোদ্ভুত সাবেক অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাকই একমাত্র যোগ্য প্রার্থী হিসেবে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে চলেছেন।
যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না বলে কথা রয়েছে। অথচ যে ব্রিটেন এশিয়া-আফ্রিকা, উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করে সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ভোগ করেছিল, সেই ব্রিটেন এখন নিজ দেশের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং ইউরোপের আঞ্চলিক অবস্থান নিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থায় রয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও জায়নবাদী অপশক্তির লেজুড়ে পরিনত হয়েছে। এক সময়ের বিশাল সাম্রাজ্যের নিয়ন্তা এবং কমনওয়েলথের নেতা হিসেবে ব্রিটেন শান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে কোনো ভূমিকাই পালন করতে পারছে না। ওয়ার অন টেররিজমের নামে মুসলিম বিদ্বেষী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের শুরুতে আফগানিস্তান ও ইরাকে আগ্রাসন, প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে হত্যার পেছনে জর্জ বুশের মিথ্যা এজেন্ডা ও প্রোপাগান্ডার প্রধান সহযোগী ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি বেøয়ার। সেসব যুদ্ধে দুই দশকে ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি পরাজিত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। তবে এতেও তাদের নীতির তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূমিকার পাশে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে অন্যতম বশংবদ শিখণ্ডী হিসেবে দেখা গেছে। দেশটি ইউক্রেন যুদ্ধে ক্রমাগত উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। ব্রেক্সিট তথা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা ও কারিগর বরিস জনসনের হঠকারি সিদ্ধান্তে যুক্তরাজ্য ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক অবস্থার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছে। খাদ্যসংকটসহ নানা সমস্যায় আভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন এক পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ রাজনীতিতে ভারতীয় বংশোদ্ভুত অর্থনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের ভূমিকা দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব।
বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি চীনের সাথে সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেনের সম্প্রীতি ও সহাবস্থান চলমান বিশ্বের অনেক সংকট উত্তরণে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। ইরাক-আফগানিস্তানে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের ফলাফল পশ্চিমাদের পক্ষে যায়নি। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফলও পশ্চিমাদের পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এহেন বাস্তবতায় যুক্তরাজ্যকে যুদ্ধের উস্কানিদাতার ভূমিকা থেকে সরে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে শি জিনপিংসহ চীনের নতুন নেতৃত্বের সাথে নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতামূলক মনোভাব ও সম্পর্কোন্নয়নের বারতা বিশ্বকে নতুন আলোর পথ দেখাতে পারে। বরিস জনসনের হঠকারিতা ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বকে নড়বড়ে করে তুলেছে। শক্ত প্রতিদ্ব›দ্বী লেবার পার্টি ও লিবারেল ডেমোক্রেট দলের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে নতুন জাতীয় নির্বাচনের দাবি উঠতে শুরু করেছে। ব্রিটিশ রাজনৈতিক ঐতিহ্য এবং ভারতীয় উপমহাদেশসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধানে নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর যোগ্যতা ও দূরদর্শিতা এখন সময়ের পরীক্ষার সম্মুখীন। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক-কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও আন্তরিক সদিচ্ছায় ইউরোপ ও এশিয়ার রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সহজতর হতে পারে। আমরা আশা করি, তারা একসঙ্গে কাজ করে বিশ্বকে শান্তির পথ দেখাবে। তৃতীয়বারের মতো চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে আসায় প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে অভিনন্দন। বর্ণবাদপুষ্ট ব্রিটেনে প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভুত ও অস্বেতাঙ্গ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া নি:সন্দেহে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি।
মন্তব্য করুন