শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা

মো. আরাফাত রহমান | প্রকাশের সময় : ৩১ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বৈশ্বিক লক্ষ্যগুলোর একটি সংগ্রহ, যা সকলের জন্য একটি ভালো এবং টেকসই ভবিষ্যৎ অর্জনের পরিকল্পনা হিসাবে তৈরি করা হয়েছে। জাতিসংঘ লক্ষ্যগুলো প্রণয়ন করেছে এবং ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা’ হিসেবে লক্ষ্যগুলোকে প্রচার করেছে। এসব লক্ষ্য সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে প্রতিস্থাপন করেছে, যা ২০১৫ সালের শেষ নাগাদ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মেয়াদ ২০১৬ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। এতে মোট ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা ও ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

১৭টি লক্ষ্যমাত্রা হলো: ১. দারিদ্র্য বিলোপ; ২. ক্ষুধা মুক্তি; ৩. সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ; ৪. মানসম্মত শিক্ষা; ৫. লিঙ্গ সমতা; ৬. নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন; ৭. সাশ্রয়ী ও দূষণমুক্ত জ্বালানি; ৮. শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি; ৯. শিল্প, উদ্ভাবন ও অবকাঠামো; ১০. অসমতার হ্রাস; ১১. টেকসই নগর ও জনপদ; ১২. পরিমিত ভোগ ও উৎপাদন; ১৩. জলবায়ু কার্যক্রম; ১৪. জলজ জীবন; ১৫. স্থলজ জীবন; ১৬. শান্তি, ন্যায়বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান; ১৭. অভীষ্ট অর্জনে অংশীদারিত্ব।

বিশ্বের সকল দেশ এই অভীষ্টগুলো বাস্তবায়নে কাজ করবে, যার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে জনগণের সকল ধরনের দারিদ্র্যের অবসান ঘটানো সম্ভব হবে। সকল ধরনের বৈষম্যের অবসান ও অসমতা হ্রাসের গুরু দায়িত্ব পালন করাসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলার কাজও এগিয়ে নেয়া যাবে। আর এসব কর্মকাণ্ডের মূলমন্ত্র হবে ‘কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়’ নীতি অনুসরণ। জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেছে।

লক্ষমাত্রাগুলো বিস্তৃত এবং পরস্পর নির্ভরশীল। ২০১৭ সালের ৬ জুলাই সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত জাতিসংঘের একটি রেজোলিউশনের মাধ্যমে এসডিজিগুলোকে আরও কার্যকর করা হয়। রেজোলিউশনে প্রতিটি লক্ষ্যমাত্রার অগ্রগতি পরিমাপ করতে বেশ কয়েকটি সূচকের সাথে প্রতিটি লক্ষ্যের জন্য নির্দিষ্ট অভিষ্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০২০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। কয়েকটি লক্ষ্যমাত্রার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা হয়নি।

এসডিজি ১ হলো সর্বত্র সব ধরনের দারিদ্র্যের অবসান। এসডিজি ১ অর্জন করলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী চরম দারিদ্র্যের অবসান ঘটবে। এ লক্ষ্যের অগ্রগতি পরিমাপ করার জন্য সাতটি লক্ষ্য এবং ১৩ টি সূচক রয়েছে। পাঁচটি ফলাফল লক্ষ্য হল: চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ; সমস্ত দারিদ্র্য অর্ধেক হ্রাস; সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন; মালিকানা, মৌলিক সেবা, প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক সম্পদের সমান অধিকার নিশ্চিত করা এবং পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করা। এসডিজি ১ অর্জনের উপায় এর সাথে সম্পর্কিত দুটি লক্ষ্য হলো দারিদ্র্যের অবসানের জন্য সম্পদ সংগ্রহ করা এবং সকল স্তরে দারিদ্র্য বিমোচন নীতি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা।

চলমান অগ্রগতি সত্ত্বেও বিশ্বের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এবং পানি ও স্যানিটেশনের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সংগ্রাম করে। নিম্ন-আয়ের দেশগুলোতে চরম দারিদ্র্য রয়ে গেছে বিশেষ করে যারা দ্বন্দ্ব এবং রাজনৈতিক উত্থান দ্বারা প্রভাবিত। সামাজিক নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না হলে, ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পাবে। গ্রামীণ দারিদ্র্যের প্রায় অর্ধেক শিশু। সেপ্টেম্বর ২০২০-এ প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে দারিদ্র্য মাত্র কয়েক মাসে ৭ শতাংশ বেড়েছে।

এসডিজি ২ হল: ‘ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষির প্রসার।’ এসডিজি ২ এর অগ্রগতি পরিমাপের জন্য আটটি লক্ষ্য এবং ১৪টি সূচক রয়েছে। পাঁচটি ফলাফল লক্ষ্য হল: ক্ষুধা নিবারণ এবং খাদ্যের প্রাপ্তি ব্যবস্থা উন্নত করা; সব ধরনের অপুষ্টির অবসান ঘটানো; কৃষি উৎপাদনশীলতা; টেকসই খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা এবং স্থিতিস্থাপক কৃষি পদ্ধতি; বীজের জিনগত বৈচিত্র্য,গাছপালা চাষ করা এবং গৃহপালিত প্রাণী পালন; বিনিয়োগ, গবেষণা এবং প্রযুক্তি। তিনটি ‘অর্জন করার উপায়’ লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে: বিশ্ব কৃষি বাজার, খাদ্য পণ্যের বাজার এবং তাদের আহরণ-এ বাণিজ্য সীমাবদ্ধতা এবং বিকৃতি মোকাবেলা করা।

এটি মোকাবিলা করার একমাত্র সহজ উপায় হচ্ছে উন্নত বিশ্বে শ্রমবাজার জোরদার করা যাতে স্বল্পতায় উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে দক্ষ, আধা দক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিক আসতে পরে এবং উন্নয়নশীল দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা। বিশ্বব্যাপী ৯ জনের মধ্যে ১ জন মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে যাদের অধিকাংশই উন্নয়নশীল দেশে বাস করে। পুষ্টিহীনতার কারণে বিশ্বব্যাপী ৫২ মিলিয়ন শিশুর উচ্চতার তুলনায় কম বা অতি কম ওজন হয়। এটি প্রতি বছর পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রায় অর্ধেক মৃত্যুর জন্য দায়ী।

এসডিজি ৩ হলো ‘সকল বয়সী সকল মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ।’ লক্ষ্যমাত্রার দিকে অগ্রগতি পরিমাপ করার জন্য এসডিজি ৩-এ ১৩ টি লক্ষ্য এবং ২৮ টি সূচক রয়েছে। প্রথম নয়টি লক্ষ্যমাত্রা হল: মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস করা; পাঁচ বছরের কম বয়সী সকল প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু শেষ করা; সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করা; অসংক্রামক রোগ থেকে মৃত্যুহার হ্রাস নিশ্চিত করা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রচার করা; মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার প্রতিরোধ ও চিকিৎসা করা; রাস্তায় আঘাত এবং মৃত্যু হ্রাস করন; যৌন এবং প্রজনন যত্ন, পরিবার পরিকল্পনা এবং শিক্ষার সার্বজনীন অ্যাক্সেস মঞ্জুরকরন; সার্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ অর্জন; এবং বিপজ্জনক রাসায়নিক এবং দূষণ থেকে অসুস্থতা এবং মৃত্যু হ্রাস করা।

এসডিজি ৩ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চারটি উপায় হলো: তামাক নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাঠামোগত সম্মেলন বাস্তবায়ন করা; গবেষণা, উন্নয়ন এবং সাশ্রয়ী মূল্যের ভ্যাকসিন ও ওষুধের সার্বজনীন প্রাপ্তি সমর্থন; উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্বাস্থ্য অর্থায়ন বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য কর্মী বাহিনীকে সহায়তা করা; এবং বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ঝুঁকির জন্য প্রারম্ভিক সতর্কতা ব্যবস্থা উন্নত করা।

এসডিজি ৪ হলো ‘সকলের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি।’ এসডিজি ৪ এর দশটি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, যা ১১ টি সূচক দ্বারা পরিমাপ করা হয়। সাতটি ‘ফলাফল-ভিত্তিক লক্ষ্য’ হলো: বিনামূল্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা; মানসম্পন্ন প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় সমান প্রবেশাধিকার; সাশ্রয়ী মূল্যের কারিগরি, বৃত্তিমূলক এবং উচ্চ শিক্ষা; আর্থিক সাফল্যের জন্য প্রাসঙ্গিক দক্ষতা সহ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি; শিক্ষায় সকল বৈষম্য দূর করা; সর্বজনীন সাক্ষরতা; টেকসই উন্নয়ন এবং বিশ্ব নাগরিকত্বের জন্য শিক্ষা। তিনটি ‘লক্ষ্য অর্জনের উপায়’ হলো: অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং নিরাপদ বিদ্যালয় নির্মাণ ও আপগ্রেড করা; উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য উচ্চ শিক্ষা বৃত্তি প্রসারিত করা এবং উন্নয়নশীল দেশে যোগ্য শিক্ষকের সরবরাহ বড়াতে হবে।

 

এসডিজি ৫ হলো ‘লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং সকল নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন।’ এসডিজি ৫-এর লক্ষ্য নারী ও মেয়েদের সমান অধিকার, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য বা কোনো সহিংসতা সহ বৈষম্য ছাড়াই মুক্তভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ প্রদান করা। এটি লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং সমস্ত নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়নের জন্য।

এসডিজি ৬ হলো ‘সকলের জন্য পানি ও স্যানিটেশনের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শিশু জরুরি তহবিল ইউনিসেফের জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম ২০১৭ সালে রিপোর্ট করেছে ৪.৫ বিলিয়ন লোকের বর্তমানে নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই।

এসডিজি ৭ হলো ‘সকলের জন্য সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য, টেকসই ও আধুনিক জ্বালানি সহজলভ্য করা।’
এসডিজি ৮ হলো ‘সকলের জন্য পূর্ণাঙ্গ ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং শোভন কর্মসুযোগ সৃষ্টি এবং স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন।’
এসডিজি ৯ হলো ‘অভিঘাতসহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই শিল্পায়নের প্রবর্ধন এবং উদ্ভাবনার প্রসারণ।’
এসডিজি ১০ হলো ‘অন্তঃ ও আন্তঃ দেশীয় অসমতা কমিয়ে আনা। এসডিজি ১১ হলো ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ, অভিঘাতসহনশীল এবং টেকসই নগর ও জনবসতি গড়ে তোলা।’
এসডিজি ১২ হলো ‘পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদন ধরন নিশ্চিত করা।’
এসডিজি ১৩ হলো ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব মোকাবেলায় জরুরি কর্মব্যবস্থা গ্রহণ।’
এসডিজি ১৪ হলো ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য সাগর, মহাসাগর ও সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার।’
এসডিজি ১৫ হলো ‘স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার ও সুরক্ষা প্রদান এবং টেকসই ব্যবহারে পৃষ্ঠপোষকতা, টেকসই বন ব্যবস্থাপনা, মরুকরণ প্রক্রিয়ার মোকাবেলা, ভূমির অবক্ষয় রোধ ও ভূমি সৃষ্টি প্রক্রিয়ার পুনরুজ্জীবন এবং জীববৈচিত্র হ্রাস প্রতিরোধ।’
এসডিজি ১৬ হলো ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থার প্রচলন, সকলের জন্য ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ সুগম করা এবং সকল স্তরে কার্যকর, জবাবদিহিতাপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণ।’
এসডিজি ১৭ হলো ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব উজ্জীবনকরণ ও বাস্তবায়নের উপায়সমূহ শক্তিশালী করা।’


লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন