বিদেশে বসে বাংলাদেশের সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা, উস্কানিমূলক ও বানোয়াট বক্তব্য দেয়া ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদের অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে আওয়ামী লীগের সদস্য নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের এক প্রশ্নের লিখিত উত্তরে তিনি এ কথা জানান। তিনি বলেন, সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে উন্নয়ন ও গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এর আগে সকালে বিসিএস প্রশাসন একাডেমিতে ১২৪তম, ১২৫তম এবং ১২৬তম আইন ও প্রশাসন প্রশিক্ষণ কোর্সসমূহের সমাপনী ও সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমরা কঠিন সময় পার করছি। দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা আমাদের নিজেদের নিশ্চিত করতে হবে। ইউক্রেনের যুদ্ধ ও স্যাংশানের (নিশেধাজ্ঞা) কারণে আমাদের যথেষ্ট সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সে জন্য সবাইকে কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে। উৎপাদন বৃদ্ধি করা এখনকার যুগে সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে করোনার অভিঘাত, সেই সঙ্গে এসেছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। তার সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা। যার ফলে আমদানি করা প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বেড়ে গেছে।
সংসদে প্রধানমন্ত্রী : জাতীয় সংসদের অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসী/অভিবাসী বাংলাদেশি ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট দেশে তাদের মেধা, শিক্ষা ও কাজের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর পাশাপাশি স্বাগতিক দেশে তাদের ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের নাম ও ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করেন। স্বাগতিক দেশে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণেও তারা অনেক সময় ভূমিকা রাখতে পারেন। দুঃখজনক হচ্ছে, ইতিবাচক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রবাসী/অভিবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে কিছু লোক দেশের বাইরে অবস্থান করে বাংলাদেশ এবং সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারনায় লিপ্ত হন। সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা, উস্কানিমূলক ও সম্পূর্ণ বানোয়াট বক্তব্য প্রদানকারীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির/বিচারের মুখোমুখি করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
বিদেশে সরকাববিরোধী কর্মকাণ্ডকারীদের বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী জানান, অপপ্রচার মোকাবিলা করতে এবং বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমর্যাদা তুলে ধরার জন্য আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোয় এবং অনলাইন মিডিয়াতে নিয়মিতভাবে তথ্যবহুল সংবাদ, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রকাশের বিষয়ে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে নিয়মিত প্রচেষ্টা চলমান। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অসত্য ও অপপ্রচারমূলক সংবাদ/প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনকূটনীতি অণুবিভাগ এসব প্রতিবেদনের বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যবহুল প্রতিবাদলিপি পাঠিয়ে থাকে, যা ঐ সব গণমাধ্যমে প্রকাশ বা প্রচার করা হয়ে থাকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরকারের কূটনৈতিক ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেমন- ফেসবুক পেজ ও টুইটারের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানানোর মাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতকল্পে কাজ করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনকূটনীতি অণুবিভাগ এবং বিদেশস্থ মিশনগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের প্রচার মাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশবিষয়ক খবর বা আর্টিক্যালগুলো নিয়মিতভাবে মনিটরিং করা হয়। অসত্য ও অপপ্রচারমূলক সংবাদ/প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব প্রতিবেদনের বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যবহুল প্রতিবাদলিপি ছাড়াও বিভিন্ন প্রকাশনা পাঠিয়ে থাকে, যা ঐসব গণমাধ্যমে প্রকাশ বা প্রচার করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমর্যাদা তুলে ধরার জন্য আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোয় এবং অনলাইন মিডিয়াতে নিয়মিত তথ্যবহুল সংবাদ, প্রবন্ধ, ফিচার, ক্রোড়পত্র ও নিবন্ধ প্রকাশের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। অপপ্রচারকারীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারকারীদের বানোয়াট এবং ভিত্তিহীন পোস্টগুলো নজরদারি করা হয়।
বিসিএস প্রশিক্ষণের সনদ বিতরণ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নবীন বিসিএস কর্মকর্তাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশবাসীর ভাগ্যের পরিবর্তনে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমি নবীন অফিসারদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ পাকিস্তান আমলে কোনো বাঙালি একমাত্র কর্নেল ছাড়া সচিব, জেনারেল ও মেজর জেনারেল হতে পারত না। তিনি বলেন, এখন আপনাদের (সরকারি কর্মকর্তা) মনে রাখা উচিত দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা সব কিছুই হতে পারছি। সে কথা মনে রেখেই সবাইকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের ব্রত নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বিসিএস প্রশাসন একাডেমি মিলনায়তন শাহবাগে অনুষ্ঠিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত থেকে ৩টি ব্যাচের ১০৩ জন কর্মকর্তার হাতে সনদ তুলে দেন এবং ফটোসেশনে অংশ নেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের যারা নবীন অফিসার তাদের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তিনি যখন কোনো এলাকায় কাজ করেন তখন সেই এলাকার উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখার সুযোগ পান। কোথাও কাজে নিযুক্ত হলে বিভিন্ন জন বিভিন্ন দেনদরবার নিয়ে আসবে তবে সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ না করে সঠিক পরিকল্পনানুযায়ী এগোতে হবে। তাহলেই আমরা সঠিকভাবে উন্নতি করতে পারব। আমি চাই আমাদের নবীন অফিসাররা সেভাবেই ব্যবস্থা নিবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেয়া জাতির পিতার ভাষণের চুম্বকাংশ তুলে ধরে প্রশাসনের নবীন কর্মকর্তাদের আরো জনসেবায় নিবেদিতপ্রাণ হবার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, এখন থেকে অতীতের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিবর্তন করে নিজেদের জনগণের খাদেম বলে বিবেচনা করতে হবে। অর্থাৎ জনগণের সেবক হিসেবেই নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে হবে। আমি চাই জনগণের সেবা করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং উন্নত করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের যেমন গবেষণার দিকে মনোযোগ দিতে হবে, দেশকে চেনা এবং মানুষের কল্যাণেও কাজ করতে হবে। কারণ, মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি যত বেশি হবে ক্রয়ক্ষমতা যত বাড়বে আমাদের দেশে শিল্পায়নও বাড়বে। আর শিল্পায়নের ক্ষেত্রে কৃষিভিত্তিক শিল্প ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলা এবং উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, ১শ’টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলেছি এই উদ্দেশ্যে যে, যত্রতত্র কেউ যেন কোনো শিল্প গড়ে তুলতে না পারে। কারণ, আমার কৃষিজমি বাঁচাতে হবে। শিল্পায়ন যেখানে হবে এর সঙ্গে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেকটি গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। আবার বর্জ্য থেকে সার এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, সেদিকেও আমাদের লক্ষ রাখতে হবে। সাথে সাথে মানুষকেও সচেতন করতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দেশের মানুষকে একটু সুযোগ দিলে বা বোঝাতে পারলে তারা কিন্তু অসাধ্য সাধন করতে পারে। বৈশ্বিক করোনা মহামারির অভিঘাতের পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞায় সঙ্কটের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, সঙ্কট শুধু বাংলাদেশে নয়, উন্নত দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে। আমি জানি, উন্নত দেশগুলোর অবস্থা। এমনকি আমেরিকা, ইউরোপ, ইংল্যান্ডসহ প্রত্যেকটা দেশ এখন অর্থনৈতিক মন্দার কবলে। বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না, খাদ্যের দাম অতিরিক্ত বেড়ে গেছে, সেখানে সব জায়গায় রেশনিং করে দেয়া হয়েছে। এমন একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বহু আগে থেকেই এটা বলে যাচ্ছি যে, এক ইঞ্চি জমি যেন খালি না থাকে। কারণ, আমাদের নিজের খাদ্য নিজেদেরই উৎপাদন করতে হবে। খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করার জন্য আমাদের শিল্পায়ন দরকার এবং দেশের মানুষের খাদ্যে এবং পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা এখন একটা অত্যন্ত কঠিন সময় অতিক্রম করছি। কাজেই সেই অবস্থায় আমরা যদি নিজেরা দাঁড়াতে পারি সেটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো হয়। সে জন্য আমাদের সবাইকে কৃচ্ছ্রতাসাধন করতে হবে। কৃচ্ছ্রতাসাধন করেই আমাদের চেষ্টা করতে হবে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম এবং একাডেমির রেক্টর (সচিব) মোমিনুর রশিদ আমিন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। ১২৪, ১২৫ ও ১২৬তম ব্যাচে শীর্ষস্থান অর্জন করে রেক্টরস পদক লাভকারী তানিয়া তাবাসসুম, মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ও ফারহানা নাসরিন অনুষ্ঠানে নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন