ক. এই প্রবন্ধ টি (আশির কবিতা) সম্ভবত কবির একটি অগ্রহ্নিত প্রবন্ধ। ২০০৯ সনে বই মেলা সামনে রেখে আমার সম্পাদনায় আশির দশক, নির্বাচিত কবিতা “প্রকাশ পায়। বিশাল আকৃতির এই সম্পাদনা গ্রহ্নের মূল প্রবন্ধ লেখেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বড়ো কবি আল মাহমুদ। প্রবন্ধটির শিরোনাম -”আশির কবিতা”।
আর এর ভূমিকা লেখেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সমালোচক ও কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ। তাঁর রচনার নাম - “কাব্যকথা কমল সুগন্ধি পরিপুর”। এটিও সম্ভবত তাঁর একটি অগ্রহ্নিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ। এ গ্রন্থে আশির দশকের ৫৭ জন কবির দশটি করে কবিতা সংবদ্ধ হয়েছে। এর সম্পাদকীয় আমি লিখেছিলাম -ক.হৃৎকমলের টানে খ.নানা রঙের চিহ্নগুলো এবং গ.হৃৎকুসুমের পাপড়িগুলো - উপশিরোনাম দিয়ে।
তার বাসায় আশির দশকের কবিদের দশটি করে মোট ৫৭০ টি কবিতার এক বিশাল পাÐুলিপি নিয়ে আমি আর কবি নাসির হেলাল হাজির হয়েছিলাম। পরবর্তীতে এ জন্য বেশ ক,বার তার বাসায় গিয়েছি।
তিনি বেশ সময় নিয়ে ডিকটেশন দিয়ে এবং কিছু লিখে এই প্রবন্ধ টি আমাকে দিয়েছিলেন। আমি এ প্রবন্ধের কিছু কিছু অংশ তুলে ধরে আলোচনা এগিয়ে নেবো।
উদ্ধৃতি -১. দু,দিন পর এক রাতে কবি হাসান আলীম ও কবি নাসির হেলাল এসে পাÐুলিপিটি আমাকে দিয়ে গেল। পাÐুলিপিটি আমি নেড়েচেড়ে দেখেছি।জনাপঞ্চাশেক কবির দশটি করে কবিতা এতে সংপৃক্ত হয়েছে। বলাইবাহুল্য,আশির সব কবির কবিতা তারা সংগ্রহ করতে পারেনি। হয়তো অনেক ভালো কবির কবিতাও বাদ পড়ে গেছে। কিন্তু যেটুকু হয়েছে তাই বা কম কিসে! আশির এতগুলো কবিতা আর কোন সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ভবিষ্যৎ সাহিত্য গবেষকদের জন্য নিঃসন্দেহে এটি গুরুত্বপূর্ণ সংকলন হিসেবেই বিবেচিত হবে।
২.সব মানুষ এই স্বপ্নময় জীবনকে বাস্তবে ধারণ করতে পারেনা,যারা পারে তারা কবি-তাদের কেউ কেউ কবি।
আমাদের বাংলা ভাষার উৎসমুখ চর্যাপদে খুঁজে পাওয়া যায়। কবিরা হলেন কাহ্নপা,সরহপা। এদের দোহায় বৌদ্ধ গূঢ়ার্থবাদ প্রকাশ পেয়েছে। তারা যে শ্লোক বর্ণনা করেছেন তাৎক্ষণিকভাবে সে সবের অর্থ আমাদের সবার কাছে বোধগম্য নয়। পÐিতেরা অভিমত দেন, চর্যাপদের কবিরা যা বলেছেন তা অন্যতর বিষয়ের বর্ণনা মাত্র। চর্যাপদের কবিরা ইঙ্গিত ময় ভাষায় কথা বলেছেন।
এই ইঙ্গিতময়তাই কবিতার প্রাণ।
৩.মধ্য যুগের কবিতার নানা বিষয় আমাদের অনেককেই অভিভূত করে। মধ্যযুগের কবি শাহ মুহম্মদ সগীর “ইউসুফ জুলেখা “ কাব্য রচনা করে অসাধারণ শক্তিমত্তার পরিচয় দেন।আরও পরে বাংলা কবিতার কেন্দ্র আরাকান রাজ্যের কোরেশি মাগন ঠাকুরের এলাকায় স্থানান্তরিত হয়ে যায়। তখন অশ্বারোহী সৈনিক আলাওল হিন্দি কবি মালিক মোহাম্মদ জয়সীর পদুমাবৎ কবিতার বাংলা অনুবাদ করেন পদ্মাবতী নামে। তার এই অবিস্মরণীয় অনুবাদের মধ্য দিয়ে বাংলা কাব্যে নতুন রসের আমদানি ঘটে।
৪.এরপর বাংলা কবিতার যুগান্তকারী বিবর্তন ঘটে বৃটিশ আমলে।এ সময় মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘মেঘনাদ বধ ‘রচনা করে বিপ্লব সৃষ্টি করেন। তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দের সাহায্যে বাংলা কবিতার কাঠামো বদলে দেন।.....কিন্তু মাইকেলের ভাষা সংস্কৃত ও তৎসম শব্দ দ্বারা অধ্যুষিত থাকায় এ ভাষার কাঙ্খিত স্ফূর্তি ঘটেনি।
এরপরই রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব ঘটে। রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষায় এমন এক নমনীয়তা দান করেন যা গীতল কিন্তু আধুনিক। আমার মতে রবীন্দ্রনাথই আজকের ব্যবহৃত আধুনিক বাংলা ভাষার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়ে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে যান এবং এভাবেই বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিকতায় উন্নীত হয়।
৫.কিন্তু বৃটিশ ভারতে ঔপনিবেশিক দাসত্ব ঘুচাতে অন্য একজন কবির আবির্ভাব ঘটে -তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখেন।.......... নজরুলের বিপ্লবী ভাষা, তার কাব্যের ওজস্বী ছন্দস্পন্দন ও বিচিত্র রঙিন চিত্রকল্পের আকর্ষণে তৎকালীন তরুণ লেখকেরা দ্রæতগতিতে তার দিকে ছুটে আসে।...........
৬.এরপর আসে বিংশ শতকের চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট,সত্তর, আশি ও নব্বই দশক।নানা কারণে এ সব দশক আলোচিত সমালোচিত হয়েছে।
এরপর কবি তার প্রবন্ধের শেষে আলোচ্য আশির দশকের কবিদের কাব্য চারিত্র্য সম্পর্কে আলোক পাত করেন। এ স্তবকে তিনি আশির বিশেষ কোন কবির প্রতি মন্তব্য করেন নি। তবে আশির কবিদের থেকে কেউ কাল কে শাসন করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
উদ্ধৃতি -
১. আশির দশকে আকস্মিকভাবে এক সাথে বেশ কিছু কবি বাম ও ডান ঘরনা থেকে এসে আধুনিক কবিতায় প্রবেশ করে। তাদের কলেবরটি বেশ বড়সড়। তাদের বিষয় ভাবনায় বৈচিত্র ও কবিতা নিয়ে নানা পরীক্ষা -নিরীক্ষায় চমৎকারিত্বের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কবিতায় তারা নানামুখী প্রশ্ন উল্থাপন করতে শুরু করে -যা আমার মতো বয়োঃবৃদ্ধ কবিকেও উত্তেজিত করেছে।
২.আমি আগেই উল্লেখ করেছি, আশির কবিরা বাম-ডান উভয় আদর্শ থেকেই আধুনিক কবিতা কেন্দ্রে এসে সমবেত হয়েছে এবং আমার পর্যবেক্ষণ বলে, উভয় পক্ষই এখনো দাপটের সাথে কাব্য জগতে বিচরণ করছে।
৩.সবার সম্পর্কে আলাদা ভাবে মন্তব্য না করেও বলা যায়, আশির এ সব কবি ইতিমধ্যেই তাদের দশক অতিক্রম করে এসেছেন এবং টিকে আছেন।
৪.প্রশ্ন আসতে পারে, আশির এই কবিদের মধ্যে কালকে শাসন করার মতো কেউ আছেন কি না?
এদের কারো পক্ষে কালজয়ী হওয়া সম্ভব কি না?
এ ধরনের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার এখনো সময় আসেনি। এ জন্য আমাদের আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। তবে এদের মধ্য থেকেই হঠাৎ করে কেউ একজন কবিতার শীর্ষ চূড়া স্পর্শ করে ফেললে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আলোচ্য প্রবন্ধটি আল মাহমুদের একটি উন্নত মানের নিবন্ধ। এটিকে তাঁর মৌলিক গদ্য রচনা হিসেবে উল্লেখ করা যায়। এই লেখায় কবি আশির দশকের কবিদের কাব্য বৈশিষ্ট্য এবং তাদের কাব্যিক অবস্থান নিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আমাদের কবিতার কিঞ্চিত ইতিহাস, কাল পরিক্রমায় কবিতার বেড়ে ওঠা, কাব্য ভাষার বিবর্তন প্রসঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করেছেন। কোন নির্দিষ্ট কবি সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেন নি। তবে অন্যত্র তরুণ কবিদের সম্পর্কে তিনি অল্প বিস্তর নিবন্ধ ও স্মৃতি চারন করেছেন, কারো কারো কবিতা চর্চা বিষয়ে তার অভিমত প্রকাশ করেছেন। এ নিবন্ধে যতটুকু লিখেছেন সে হিসেবে তাঁকে কবিতার সমালোচক হিসেবেও চিহ্নিত করা যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন