পাকিস্তানের ক্রিকেটে ‘ফতেজ আজম’ বা জয়ী নেতা হিসেবে পরিচিত একজনই। তিনি ইমরান খান। ২০০৯ সালে ইউনুস খানের নেতৃত্বে একবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতলেও ওয়ানডে বিশ্বকাপের ওজনই আলাদা। ১৯৯২ সালটাই তাই তাদের দেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে গৌরবময় সময়। এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের যাত্রা পথের সঙ্গে ফাইনাল পর্যন্ত হুবহু মিল বিরানব্বই সালের। কাপ জিতে গেলে কাকতালীয় মিল হবে শতভাগ, সেদিক থেকে বাবরও পেতে পারেন ‘ফতেজ আজম’ খেতাব। বিশ্বমঞ্চে এমন সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে ভীষণ রোমাঞ্চিত তিনি। ভেন্যুও এক, অস্ট্রেলিয়ার সেই মেলবোর্ন! আজ এখানেই এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল যে খেলবে পাকিস্তান ও ইংল্যান্ড।
আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে এক পাকিস্তানি সাংবাদিক যখন বললেন, ‘কালকের পর থেকে আপনাকে “ফতেহ আজম” ডাকার আশা করা যেতে পারে কি?’ প্রশ্নটা শুনেই হাসলেন বাবর। তারপর দিলেন জবাব, ‘হ্যাঁ (আশা করা যায়)। আমি বিশ্বাস করি শুরুটা ভালো না হলেও আমরা দারুণ মোমেন্টাম পেয়ে গেছি। গত ৩-৪ ম্যাচ ধরে পাকিস্তান দল হিসেবে ও ব্যক্তি হিসেবেও সবাই ভালো খেলছে। আমরা এটা অর্জন (বিশ্বকাপ ট্রফি) করতে কঠোর পরিশ্রম করছি। ফাইনালে উঠার আমার কাছে স্বপ্ন পূরণের মতো।’ যাদের সেমির আগে বিদায় নেওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রবল, তারা নাটকীয়ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে কাপ জিতে গেলে সেটা হবে তাদের জন্য অসম্ভব পাওয়া। এমন সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে স্নায়ুচাপের চেয়ে রোমাঞ্চে বেশি ভাসছেন বাবর, ‘আমি স্নায়ুচাপে ভোগার চেয়েও রোমাঞ্চিত বেশি। গত তিন ম্যাচে আমরা ভাল খেলেছি। কোন সন্দেহ নেই যে চাপ আছে সেইসঙ্গে আত্মবিশ্বাসও আছে আমাদের। ভালো ফল চাওয়ার তুলনায় চাপটা তুচ্ছ।’
১৯৯২ সালে শুরুর দিকে হেরে বাদ পড়ার শঙ্কায় ছিল পাকিস্তান। ভাগ্যের সহায়তায় পাওয়া সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেমিতে উঠে তারা নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনাল নিশ্চিত করে। ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কাপ জিতে নেয় ইমরান খানের দল। এবারও একই অবস্থা। সুপার টুয়েলভে ভারত ও জিম্বাবুয়ের কাছে হেরে যাওয়ায় তাদের বাদ পড়া ছিল অনেকটা সময়ের ব্যাপার। নিজেদের সব ম্যাচ জিতলেও অপেক্ষায় থাকতে হতো অন্যদের ফলাফলের উপর। শেষ দিনে নাটকীয় এক অঘটন সুবিধা করে দেয় পাকিস্তানের। প্রায় নিশ্চিত সেমিফাইনালের দোয়ার থেকে নেদারল্যান্ডসের কাছে হেরে বিদায় নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশকে হারিয়ে জায়গা করে নেয় সেমিতে। ৯২ সালের মতো এবারও সেমিতে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েই পা রাখে শেষ লড়াইয়ে। সেখানেও প্রতিপক্ষ একই-ইংল্যান্ড! পাকিস্তানি সমর্থকদের মতে ইতিহাস আবার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে।
‘হিস্ট্রি রিপিটস’ কথাটার স্বার্থকথা আছে ইংল্যান্ড অধিনায়ক জস বাটলারের ক্ষেত্রেও। সাদা বলের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের ইতিহাস নতুন করে লেখানো, সবচেয়ে বড় মোড় নেওয়া, অতি ঐতিহ্যপ্রিয়তা আর সনাতনী মানসিকতার আশ্রয়ে ধুঁকতে থাকা দলকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে দেওয়ার নায়ক ওয়েন মর্গ্যান। তার সেই চার বছরের রোমাঞ্চকর অভিযান সাফল্যময় পূর্ণতায় পৌঁছে যায় ২০১৯ বিশ্বকাপ জয়ে। ইংল্যান্ড ও মর্গ্যানের সেই সাফল্যে সহ-অধিনায়ক হিসেবে যেমন, তেমনি পারফরম্যান্সেও বাটলারের ভূমিকা ছিল অনেক। তবে এবার অধিনায়ক হিসেবে করতে পারা মানে তো পুরো ভিন্ন কিছু।
ইমরান-বাবরের তুলনায় মর্গ্যান-বাটলারের তুলনা কিংবা পাশে বসার ব্যাপারটি আরও বেশি মানানসই আরও অনেক দিক থেকে। মর্গ্যানের সাফল্য এখনও তরতাজা, এই তো ২০১৯ সালের কথা! তার ছায়া তাই এখনও রয়ে গেছে অনেক। এই দলে ও এই ঘরানার ক্রিকেটে তার প্রভাবও আছে। মর্গ্যানের সঙ্গে বাটলারের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাও একটা ব্যাপার। সেখানে নিজেকে আলাদা করে উপস্থাপন করা বড় চ্যালেঞ্জ বাটলারের জন্য। ওই দলটা যেমন ‘মর্গ্যানের দল’ বলে চেনে সবাই, তেমনি ‘বাটলারের দল’ পরিচিতি গড়তেও জরুরি বিশ্বকাপ শিরোপা। সেমি-ফাইনালের আগের দিন বাটলারও বলেছিলেন, তার ভাবনাও অনেকটা একইরকম, ‘ওয়েনের (মর্গ্যান) সঙ্গে অনেক কথা হয় আমার। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের একজন সে, সবসময়ই তার সঙ্গে যোগাযোগ হয় এবং সে এমন একজন, কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলেই যার সঙ্গে আমি কথা বলতে পারি। তবে নেতৃত্বের ব্যাপারটি হলো, সবকিছু নিজের মতো করে করাও। ওয়েন আর এখন অধিনায়ক নেই, দায়িত্বটি এখন আমার এবং আমাকে নিজের পথেই এগোতে হবে, নিজের মতো করেই নেতৃত্ব দিতে হবে। আমি সামনে তাকিয়ে আছি অনেক রোমাঞ্চ নিয়ে এবং এই ছেলেদের ওপর আমার বিশ্বাস প্রবল। কোচরা যারা আমাদের নিয়ে কাজ করছেন, তাদের ওপরও ভরসা অনেক। ওয়েন অবশ্যই খুব ভালো বন্ধু এবং আমি যদি কারও মতামত নিতে চাই, তার জ্ঞানের সেই গভীরতা আছে। তবে আমি আমার মতো করেই করতে চাই।’
শুধু ইতিহাসে জায়গা করে নেওয়াই নয়, নিজের শৈশবের স্বপ্ন, ক্রিকেটার ও অধিনায়ক হিসেবে নিজের তৃপ্তির তাড়নাও তো একটা ব্যাপার। বাটলার ফাইনালের আগের দিন শোনালেন সেই গল্পও, ‘অবশ্যই এই ধরনের কিছু করা নিয়ে স্বপ্ন ছিল আমার। ছেলেবেলায় বেড়ে ওঠার সময়, ভাই-বোনদের সঙ্গে বাড়ির আঙিনায় খেলার সময়টায় যখন আমরা ট্রফি উঁচিয়ে ধরার অভিনয় করতাম, সেই সময়টায় ফিরে যাচ্ছি এখন। এখন বাস্তবেই সেটি করার সুযোগ এসেছে, অবিশ্বাস্যরকমের স্পেশাল এটি।’
সেই মেলবোর্ন, সেই বিশ্বকাপেরই ফাইনাল আর প্রতিপক্ষও সেই ইংল্যান্ড। পাকিস্তান কি পারবে ’৯২ ফিরিয়ে আনতে, বাবর কি পাবরেন ইমরান খান হতে? নাকি মর্গ্যানের দেখানো পথে হেঁটে শিরোপা উৎসবে মাতবে ইংল্যান্ড? অপেক্ষা স্রেফ এখন আরেকটি ধাপ এগোনোর। বাবর ইরাম হবেন না বাটলার মর্গ্যান- সেটি সময়ই বলে দেবে!
রোড টু ফাইনাল
পাকিস্তান-ইংল্যান্ড ফাইনালের মধ্যদিয়ে আজ পর্দা নামছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অষ্টম আসরের। অস্ট্রেলিয়ায় ১৬ দলকে নিয়ে গত ১৬ অক্টোবর থেকে শুরু হয় টুর্নামেন্টের এবারের আসর। ৮ দলের প্রথম পর্বের লড়াই থেকে ৪ দলকে নিয়ে সুপার টুয়েলভের লড়াই শুরু হয় ২২ অক্টোবর। সুপার টুয়েলভের গ্রুপ পর্ব শেষ হলে ৯ ও ১০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় দু’টি সেমিফাইনাল ম্যাচ। সুপার টুয়েলভে দুই গ্রুপে ১২ দলের লড়াইয়ের পর সেরা চার দল উঠে সেমিফাইনালে। সেমির লড়াইয়ে জিতে বিশ্বকাপের এবারের আসরের ফাইনাল মঞ্চে ইংল্যান্ড ও পাকিস্তান।
যেভাবে ফাইনালে ইংল্যান্ড
সুপার টুয়েলভ
২২ অক্টোবর ২০২২ : পার্থ, আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৫ উইকেটে জয়
২৬ অক্টোবর ২০২২ : মেলবোর্ন, বৃষ্টি আইনে আয়ারল্যান্ডের কাছে ৫ রানে হার
২৮ অক্টোবর ২০২২ : মেলবোর্ন, বৃষ্টিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ পরিত্যক্ত
১ নভেম্বর ২০২২ : ব্রিজবেন, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২০ রানে জয়
৫ নভেম্বর ২০২২ : সিডনি, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৪ উইকেটে জয়
সেমিফাইনাল
১০ নভেম্বর ২০২২ : অ্যাডিলেড, ভারতের বিপক্ষে ১০ উইকেটে জয়
যেভাবে ফাইনালে পাকিস্তান
সুপার টুয়েলভ
২৩ অক্টোবর ২০২২ : মেলবোর্ন, ভারতের কাছে ৪ উইকেটে হার
২৭ অক্টোবর ২০২২ : পার্থ, জিম্বাবুয়ের কাছে ১ রানে হার
৩০ অক্টোবর ২০২২ : পার্থ, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৬ উইকেটে জয়
৩ নভেম্বর ২০২২ : সিডনি, দ.আফ্রিকার বিপক্ষে বৃষ্টি আইনে ৩৩ রানে জয়
৬ নভেম্বর ২০২২ : অ্যাডিলেড, বাংলাদেশের বিপক্ষে ৫ উইকেটে জয়
সেমিফাইনাল
৯ নভেম্বর ২০২২ : সিডনি, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৭ উইকেটে জয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন