নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে নতুন রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি পেতে অথবা নিবন্ধনের জন্য সর্বোমোট ৯৮টি নতুন দল আবেদন করেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন দলগুলোকে নিবন্ধন দেয়ার জন্য এই আবেদন। নতুন দল হিসেবে নিবন্ধিত হতে হলে একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, দেশের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর কমিটি এবং সদস্য হিসেবে অন্তত ১০০টি উপজেলা, মহানগর থানায় প্রত্যেকটিতে কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থন সম্বলিত দলিল থাকার শর্ত পূরণ করতে হয়। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের নিবন্ধন যাচাই-বাছাই কমিটি প্রাথমিকভাবে আবেদনগুলো দেখেছেন। ইসির শর্ত পূরণ করছে কিনা তা পরীক্ষা করতে নিবন্ধনযোগ্য দলগুলোর দলিলাদি মাঠ পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। আগামী বছরের জুনের মধ্যেই নতুন দলের নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ করার পর যারা নিবন্ধন পাবে তাদের জানিয়ে দেওয়া হবে, আর যারা পাবে না তাদেরকেও জানিয়ে দেওয়া হবে কোন শর্ত পূরণ না করার জন্য তাদের নিবন্ধন দেওয়া হয়নি।
সবশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ৭৬টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করলেও ২০১৮ সালে একটিও নিবন্ধন যোগ্য বিবেচিত হয়নি। আগ্রহী দলগুলো শর্তপূরণ করেছে বললেও যাচাই-বাছাইয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। অবশ্য ভোটের পরে আদালতের আদেশে নিবন্ধন পেয়েছে দুটি দল। ইসি জানিয়েছে, প্রতি সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন দলগুলোকে নিবন্ধন দেয়ার জন্য আবেদন আহŸান করার বিধান আছে। সে মোতাবেক গত ২৬ মে দলগুলোর কাছে আবেদন আহŸান করে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। এ সময় পর্যন্ত ১০টির মতো দল আবেদনপত্র তুলেছিল। এদের মধ্যে আবেদনপত্র জমা দিয়েছিল দুটি দল। এরপরই সময় বাড়ানোর জন্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দাবি জানালে আরও দুই মাস বাড়িয়ে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। আবেদনের শেষ দিনে মোট ৮০টি দল আবেদন জমা দিলেও পরের দিন পর্যন্ত তা দাঁড়ায় ৯৮টিতে।
উল্লেখ্য, তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময় ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন ২০০৮ সালে দেশে প্রথমবারের মতো দলগুলোকে নিবন্ধন দেয়। সেসময় ১১৭টি দল আবেদন করেছিল। যাচাই-বাছাইয়ের পর নিবন্ধন পায় ৩৯টি দল। সবশেষ দল নিবন্ধনের জন্য ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল ইসি। তখন সময় দেয়া হয়েছিল, ওই বছর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। নিবন্ধন পেতে আবেদন করেছিল ৭৬টি রাজনৈতিক দল। কে এম নুরুল হুদা কমিশন নানা কারণে সবার আবেদন বাতিল করেছিল। পরবর্তীতে আদালতের আদেশে নিবন্ধন পায় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন- এনডিএম ও বাংলাদেশ কংগ্রেস। সবমিলিয়ে গত ১৪ বছরে মোট ৪৪টি দলকে নিবন্ধন দিয়েছে ইসি। এর মধ্যে শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় ও আদালতের নির্দেশে এ পর্যন্ত পাঁচটি দলের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। ফলে বর্তমানে ইসিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এখন রয়েছে মোট ৩৯টি।এদিকে সা¤প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণে আলোচনায় থাকা গণ অধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, এবি পার্টি ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি নিবন্ধনের জন্য যেমন আবেদন করেছে, তেমনি নাকফুল পার্টি, ইত্যাদি পার্টি, মুসকিল লীগ পার্টি আর বেকার সমাজ-এর মতো উদ্ভট নাম সম্বলিত নতুন রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। এসব দলের কার্যালয়, ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে গলদঘর্ম অবস্থা নির্বাচন কমিশনের। তথ্য তালাশ করতে গিয়ে তারা এসব দলের কোনোটির নেতা খুঁজে পাননি। কোনোটির অফিসের ঠিকানাই নেই। কোনোটি পাওয়া গেছে মুরগির খামারে, মেস বাড়িতে বা আবাসিক হোটেলে। কোনো কোনোটির ঠিকানা দেয়া হয়েছে মুদি দোকান, গোডাউন, গ্যারেজ, আশ্রম, পীরের আস্তানা। বলা হয়ে থাকে, নামে কিছু আসে যায় না। মানুষের ক্ষেত্রে নামকরণের এমন স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের নাম নিয়ে এ ধরনের তামাশ করা ঠিক নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের তামাশা তারা কেন করছে? এরা কারা? কে বা কারা আছে এদের পেছনে? উদ্ভট নামসম্বলিত এতগুলো দলের একসঙ্গে নিবন্ধনের আবেদন করা নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে হাস্যকর ও প্রশ্নবিদ্ধ করা। কারো মদত বা উসকানি ছাড়া এমনি এমনি এরা গজিয়ে গেছে, এমন মনে করা যায় না। রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলকে হাস্যকর করার মতলবে কেউ এ কাজ করছে কিনা, রাজনীতিকদেরই আগে তা পরখ করে দেখতে হবে। দল গঠন, ইসির নিবন্ধন কোনো খেলার বিষয় নয়। এখানে নির্বাচন, গণরায় তথা রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয় স¤পৃক্ত। রাজনীতিকরা অতীতে ইসির এ ধরনের নামসর্বস্ব দলকে নিবন্ধন দেয়া এবং সেসব দল থেকে কারো কারো এমপি হয়ে আসার সমালোচনা করেছেন। এ ক্ষেত্রে দায় রয়েছে এ নির্বাচন কমিশনের। অতীতে ইসি এ রকম কিছু দলকে নিবন্ধন দিয়েছে বলে অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছে এবং এবারো তার পুনরাবৃত্তি হয়েছে।
রাজনৈতিক দল নিবন্ধন নীতিমালা ২০০৮-এ উল্লেখ করা হয়েছে, নিবন্ধনের জন্য একটি দলের কার্যকরী কেন্দ্রীয় কার্যালয় থাকতে হবে, কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় অফিস এবং অন্তত ১০০ উপজেলা বা মেট্রোপলিটন থানায় অফিস থাকতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় দলের সদস্য হিসেবে কমপক্ষে ২০০ ভোটার থাকতে হবে। নিবন্ধন প্রার্থী কয়টি দলের তা আছে? ইসি তা যথাযথভাবে খোঁজ নিলেই জানতে পারবে। ইসি সে ধরনের উদ্যোগ নিলে মুরগির খামারে, মেস বাড়িতে, আবাসিক হোটেলে, মুদি দোকান বা গোডাউন, গ্যারেজে ঠিকানা দেয়া এই গোষ্ঠী তামাশা করতে পারবে না। ইসি চাইলে অতীতে নিবন্ধন পাওয়া এ ধরনের পার্টির নিবন্ধন বাতিল করে দিতে পারে। এ নিয়ে আইনি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই এ ধরনের তামাশার বিষয়টি আমলে নিতে হবে। এসব উদ্ভট নামের দল রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর এবং গুরুত্বহীন করার শামিল। রাজনীতিতে বহুদিন ধরেই প্রচলিত, দুজন মানুষ একসঙ্গে হতে পারলেই একজন সভাপতি আরেকজন সাধারণ স¤পাদক হয়ে একটি দল ঘোষণা করে দিতে পারে। কিছুদিন পর আলাদা হয়ে দুটি স্বতন্ত্র দলও বানিয়ে ফেলে। আবার এ দুটি দল মিলে একটি রাজনৈতিক জোটও গঠন করে। রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে এমন অপসংস্কৃতি রাজনীতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন সংস্কৃতির আগমন বহুল আলোচিত ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময়। সে সময় সরকারঘনিষ্ঠ অনেক লোক রাতারাতি দল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়। সেগুলোকে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে আখ্যায়িক করা হয়েছিল। নিবন্ধিত ওইসব দল কি এখন আছে? ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের আগে তৎকালীন ইসি তিনটি দলকে নিবন্ধন দিয়েছিল। দলগুলো বিতর্কিত ঐ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়াতে সহযোগিতা করেছিল। যে তিনটি দল নিবন্ধন পেয়েছিল তাদের মধ্যে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট বা বিএনএফের কথা মনে আছে কি? দলটির নেতা ওই নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন, যদিও নির্বাচনের সময় দলটির সমর্থক দূরে থাক, কোনো নেতাকর্মীও কেউ দেখেনি। ওরা এখন কোথায়, তাও জানে না। তারপরও ইসি জানিয়েছে, শর্ত পূরণ করে যেকোনো দলই নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারবে। তবে যে নামেই আসুক, শতভাগ শর্তপূরণ না হলে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন মিলবে না। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের ক্ষেত্রে নির্ধারিত শর্তাবলীর সাথে দলের নাম করণের ক্ষেত্রেও নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। উদ্ভট নাম দিয়ে রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিকে হাস্যকর করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন