প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলার ‘দুরন্ত নেশা’ পেয়ে বসেছে উঠতি বয়সী বাইকারদের। সড়ক-মহাসড়কে উড়ন্ত গতিতে বাইক চালানো তাদের কাছে এটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি। যে দুরন্ত রোমাঞ্চের ভালোবাসায় উড়ে যায় বিপদের সব শঙ্কা। প্রতিদিন গণমাধ্যমে ছাপা হচ্ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার খবর। টিভিগুলোর খবরে সচিত্র খবরের ভয়াবহ দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। শুধু মোটরসাইকেল নয়; রেসের নেশার বাহন স্পোর্টস কারও। গুলশান-বারিধারার অভিজাত ঘরের ছেলেমেয়েরা স্পোর্টস কার নিয়ে রাতে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে। এতেও দুর্ঘটনা ঘটছে।
জানা যায়, দেশ-বিদেশের কিছু বাইক প্রস্তুতকারক কোম্পানি অধিক হর্স পাওয়ারের বাইক তৈরি করে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে তরুণদের আকৃষ্ট করে। এ ছাড়া বাইক নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা করেও তরুণকে অধিক হর্স পাওয়ারের বাইকে সর্বোচ্চ গতিতে চলাতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। ফলে তরুণ বয়সের ছেলেমেয়েরা নিজেদের সক্ষমতা বন্ধু ও বান্ধবীদের দেখাতে অতি দ্রুত বাইক চালান। এতে দুর্ঘটনা ঘটছে বেশি। ঢাকার আশপাশের মহাসড়কগুলোতে প্রতিদিন দেখা যায় ঝাঁকে ঝাঁকে বাইকার বের হয়েছেন। অন্যান্য কম ও বেশি গতির যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একই সড়কে বাইক চালাচ্ছেন, যা প্রায়ই ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছে।
রাজধানীর অলি-গলিতে, মহাসড়কে মোটরবাইকে গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে উদ্দাম গতিতে চলেছে কিশোর-তরুণ-যুবকেরা। তাদের মিউজিক্যাল হর্নযুক্ত বাইকের কান ফাটানো আওয়াজে সাধারণ মানুষের প্রাণান্তকর অবস্থা। গতি এবং আরো গতি এ যেন তাদের বাইক চালানোর আদর্শ। এই গতির ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা মাঝেমধ্যেই হয়ে ওঠে প্রাণঘাতী। কেড়ে নেয় কখনও পথচারী, কখনও খোদ আরোহীর জীবন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের জরিপ মতে, নিয়ন্ত্রণহীন গতির কারণেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গত ১০ মাসে দেশে ২ হাজার ৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৯৭ জন। দুর্ঘটনায় ১ হাজার ২৮৬ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ১৩ থেকে ১৭ বছরের ৩৪৭ জন এবং ১৮ থেকে ৫০ বছরের ১ হাজার ৫৩৩ জন। এ ছাড়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় পথচারী নিহত হয়েছেন ৯২ জন। আর ৮৩৭টি দুর্ঘটনার জন্য মোটরসাইকেলচালক নিজেই এককভাবে দায়ী।
গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দুর্ঘটনা ২১ শতাংশ এবং প্রাণহানি ১৯ শতাংশ বেড়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েটের) রোড রিসার্স ইনস্টিটিউট (এআরআই)-এর সহকারী অধ্যাপক শাহনেওয়াজ হাসানাত-ই-রাব্বি বলেন, স্বল্প সময়ে দ্রুত বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের জন্য মোটরসাইকেল এখন বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন গতিতে গাড়ি চালানোর ফলশ্রুতিতে বাড়ছে মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনা। আর মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনাজনিত ঘটনা মৃত্যু বৃদ্ধির একটি বড় কারণ অনিরাপদ হেলমেট ব্যবহার করা। এ ব্যাপারে আইনের সংস্কার দরকার।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান ৯৪৫ জন। ২০২০ সালে তা বেড়ে হয় ১ হাজার ৪৬৩ জন। আর ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান ২ হাজার ২১৪ জন। চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসেই মৃত্যুর সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
কেস স্ট্যাডি (এক) : বয়সে দু’জনই তরুণী। একজন বৃষ্টি। অপরজন জান্নাতুল ফেরদৌস। একে অপরের বান্ধবী। বাসা ঢাকার বাড্ডার শাহজাদপুরে। দু’জনেরই রয়েছে তরুণ বয়সী বয়ফ্রেন্ড। চলতি বছরের ১৮ জুলাইয়ের ঘটনা। সন্ধ্যার পর বাড্ডার বাসা থেকে তিন ছেলে বন্ধুর সাথে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন দুই বান্ধবী। মোটরসাইকেলে চেপে প্রথমে ঘুরে বেরিয়েছেন বাড্ডা ও গুলশানে। সেখান থেকে হাতিরঝিলের লেক। মধ্য রাতে তাদের গন্তব্য ঢাকা-মাওয়া। রাত ২টার দিকে মাওয়া চার লেনের রাস্তায় তাদের দেড়শ’ সিসির মোটরসাইকেল ছুটছে একশ’ কিলোর গতি নিয়ে। নিজেদের মধ্যেই চলে মোটরসাইকেলের গতির প্রতিযোগিতা। আর পথেই বিপত্তি। মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরের হাসাড়ায় মর্মান্তিক মোটর বাইক দুর্ঘটনা। একটি মোটরবাইক থেকে কয়েক শ’ গজ দূরে ছিটকে পড়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন বৃষ্টি। আহত হন ফেরদৌসসহ তাদের তিন ছেলে বন্ধু রবি, মোশারফ হোসেন ও সুমন ।
ঘটনার পর হতাহত দুই বান্ধবীকে রাস্তায় ফেলেই পালিয়ে যাচ্ছিলেন ছেলে বন্ধুরা। কিন্তু পদ্মা সেতুর মাওয়া টোল প্লাজায় ওই তিন বন্ধুকে আটক করে পুলিশ। অতিরিক্ত মাদক সেবনে আটকের সময় মাতাল ছিলেন তারা। পুলিশ জানিয়েছে, বেপরোয়া গতিতে চালাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক ব্যারিকেডে ধাক্কায় দুর্ঘটনায় পতিত হয় তাদের মোটরসাইকেল। আহতদেরও সুস্থ হতে অনেক সময় লাগবে।
কেস স্ট্যাডি (দুই) : ডাক নাম মিলা। বয়স ১৮। ঢাকার লালবাগের শেখ সাহেব বাজার এলাকার বাসিন্দা। ব্যবসায়ী বাবার একমাত্র কন্যা। তার বয়ফ্রেন্ড পুরান ঢাকার বাসিন্দা মো. ইয়াসিন। বান্ধবীর অনুরোধ রক্ষায় গেল থার্টিফার্স্ট নাইটে তারা দু’জন বাইকে ঘুরতে বের হয়। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে রাত ১টার দিকে মাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। রেস টাইপের বাইক ইয়াসিনের। চলছে বেপরোয়া গতিতে। শ্রীনগর এলাকায় কখন যে মিলা বাইক থেকে ছিটকে পড়ে গেছে সে খেয়ালও নেই তার। কিছুক্ষণ পর দেখতে পায় মিলা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে রাস্তায়। হাসপাতালে নেয়ার পথেই মিলার মৃত্যু হয়।
কেস স্ট্যাডি (তিন) : গত শুক্রবার (১৯ নভেম্বর) রাত তিনটার দিকে খিলগাঁও ফ্লাইওভার ঢালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রায় একই সঙ্গে প্রাণ হারান আরোহী তিন বন্ধু আল-আমিন (৩৫), মেহেদী হাসান (২৮) ও জজ মিয়া (৩৫)। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলের আশপাশের সবগুলো সিসি ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করে। সেখানে দেখা গেছে, এক মোটরসাইকেলে তিন আরোহী থাকলেও মোটরসাইকেলের গতি ছিল বেপরোয়া। চালক বাইকের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সামনে থাকা ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা খায়। মুহূর্ত্যইে তিন বন্ধুর জীবন প্রদীপ নিভে যায়।
গত রোববার রাতে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় দুইটি মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে আনিজুল ইসলাম (১৮) ও রাতুল আলী (১৯) নামে দুই যুবক নিহত হয়েছেন। এছাড়া গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন হৃদয়, রাজুসহ ৩ যুবক। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, দু’টি মোটরসাইকেলের গতি ছিল বেপরোয়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার মোটরসাইকেলকে সহজলভ্য করেছে, উৎসাহ দিয়েছে। কিন্তু মোটরসাইকেল চলার উপযুক্ত সড়ক করেনি, আলাদা লেন করেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। আইনের সঠিক প্রয়োগ যেখানে অনুপস্থিত সেখানে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, অভিভাবক, আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ দায়িত্বশীলরা বলেছেন, রোমাঞ্চকর কোনো কিছুর প্রতি আকর্ষণ তারুণ্যের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। তাদের বোঝাতে হবে, আনন্দের বিকল্প অনেক উৎস আছে। বাইকে গতির ভযাবহতা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা তুলে ধরে ভয়ঙ্কর পরিণতি থেকে তাদের নিবৃত্ত করতে হবে।
গত রোববার (২০ নভেম্বর) দুর্ঘটনায় হতাহতদের স্মরণ দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, সড়ক নিরাপদ করতে সিদ্বান্ত হয় কিন্তু তা কখনোই বাস্তবায়ন হয় না। একই অনুষ্ঠানে হতাশা ব্যক্ত করে এটিএন নিউজের প্রয়াত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিশুক মুনীরের স্ত্রী মঞ্জুলী কাজী বলেন, সড়ক নিরাপদ করতে কোনো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আগে যা দেখেছি, এখন দিন দিন আরো অবনতি ঘটছে। সড়ক আইন বাস্তবায়ন করতে পারলে অনেক দুর্ঘটনা কমে যাবে। কিন্তু সরকারের মধ্যে থাকা কিছু মানুষের ক্ষতি হবে বলে আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে কাজ করা ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের মহাসচিব এবং নিটোরের সাবেক মহাপরিচালক খন্দকার আবদুল আউয়াল বলেন, তথ্য-উপাত্ত থেকে সহজেই ধারণা নেয়া যায়, আগামী এক দশকে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশের বেশি বাড়বে। সড়ক নিরাপদ করতে দেশে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলেই এমনটি হচ্ছে।
রাজপথে তরুণ বাইকারদের গতির প্রতিযোগিতা এবং এটা নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক-দক্ষিণ) এস এম মেহেদী হাসান গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, সাধারণত যুবকদের মনে সব সময়ই এক ধরনের উচ্ছলতা ও চঞ্চলতা কাজ করে। রাতের ডিউটি শেষে ট্রাফিক সদস্যরা চলে যাবার পর যানজটহীন ফাঁকা রাস্তায় যুবকরা রেসে মেতে ওঠে। বিশেষ করে ঢাকার গুলশান এভিনিউ, খিলগাঁও, ধানমন্ডি, এয়ারপোর্ট রোডসহ বিভিন্ন রাস্তায় এ সুযোগটা নেয় বাইকার যুবকরা। আমাদের দেশে দেড়শ’ সিসির মোটরসাইকেল পারমিট আছে। কিন্তু এটার গতিও ভয়ঙ্কর। আসলে আমাদের অভিভাবকদের আগে সচেতন হতে হবে। অভিভাবকরা তার সন্তানদের অতি গতিতে বাইক চালাতে নিরুৎসাহিত করবেন। এছাড়া প্রয়োজন ছাড়া রাতে বের না হওয়ার পরামর্শ দিবেন। পারিবারিকভাবে সন্তানদের বেপরোয়া আচরণকে প্রশ্রয় দেয়া বন্ধ করতে হবে।
অভিভাবকদের সহযোগিতা না থাকলে শুধু আইন প্রয়োগ কিংবা পুলিশ দিয়ে এ নেশা থেকে যুবকদের ফেরানো সম্ভব নয়।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার বৃদ্ধি প্রসঙ্গে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, দেশে সড়ক সংখ্যার উন্নতি হওয়ায় বেড়েছে সড়কের পরিধিও। তবে গণপরিবহনের সেবা প্রত্যাশিত না হওয়ায় সাধারণ মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহারে ঝুঁকেছেন। দেশে নিবন্ধিত মোটরযানের ৭১ শতাংশই মোটরসাইকেল। শুধু রাজধানীতেই চলছে ১৫ লাখের বেশি মোটরসাইকেল।
এদিকে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া, ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’-এর সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা, দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বাড়ানো, গণপরিবহন উন্নত করা, সড়ক-মহাসড়কে সড়ক বিভাজক নির্মাণ করা এবং বিআরটিএর সক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। তারা বাইকারদের হেলমেট ও লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা, দূর থেকে নজরে পড়ে স্পিডব্রেকারগুলো এমনভাবে মার্কিং করা, সঙ্কীর্র্ণ রাস্তায় গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাসহ মোটরসাইকেলে দুইয়ের অধিক সওয়ারি হলেই ধরে জরিমানা নিশ্চিতের দাবি জানান।
বিশেষজ্ঞরা নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করে বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালনাকে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই ব্যাধি দূর করতে প্রশাসন ও পুলিশকে কঠোর হতে বলেছেন। নয়তো আগামী দিনে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন