শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

আপনাদের জিজ্ঞাসার জবাব

| প্রকাশের সময় : ২৪ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রশ্ন : শিক্ষা, মানবসৃষ্টি ও ধর্ম-এর যোগসূত্র কি?
উত্তর : শিক্ষা, মানবসৃষ্টি ও ধর্ম- এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে গভীর যোগসূত্র রয়েছে। ইংরেজি ঊফঁপধঃরড়হ শব্দটির উদ্ভব হয়েছিল ল্যাটিন শব্দ ঊফঁপধৎব থেকে। যার ভাবার্থ ঃড় ষবধফ ড়ঁঃ বা ঃড় ফৎধি ড়ঁঃ। শিক্ষার আরবি প্রতিশব্দ ‘ইলম’ বা জ্ঞান এবং ক্ষেত্র বিশেষ ‘হিকমত’ বা কৌশল। তবে শিক্ষা বলতে বুঝায়- শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত শক্তিপুঞ্জের বিকাশ সাধন। প্রত্যেকটি ধর্মেই শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। ইসলামের প্রথম বাণী, “তুমি পড়, তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” (সুরা আলাক) মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সা:) শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন, “তোমরা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ কর।” তিনি আরও বলেছেন, “জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আবশ্যক।” শিক্ষা সম্পর্কে ঋক বেদে বলা হয়েছে- “শিক্ষা মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং আত্মঅভ্যাসে উদ্ভুদ্ধ করে। ‘বেদ’ শব্দের অর্থ হলো- বিদ্যা বা নিগূঢ় রহস্য। শিক্ষা সম্পর্কে উপনিষদে বলা হয়েছে, “শিক্ষা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার চূড়ান্ত অর্থ মানবের মুক্তি।” চীনা দার্শনিক কুনফুসিয়াসের শিক্ষাতত্ত্বের মূল কথা হলো- শিক্ষা নানা গুণে গুনান্বিত উন্নত চরিত্রের ভদ্রলোক তৈরি করবে, যে হীনতা জয় করে সত্য অনুসন্ধানে নিয়োজিত থাকবে। শিক্ষাতত্ত্ব সম্পর্কে বিবেকানন্দ বলেছেন, “অশেষ জ্ঞান ও অনন্ত শক্তির আকর ব্রহ্ম প্রত্যেক নর-নারীর অভ্যন্তরে সুপ্তের ন্যায় অবস্থান করিতেছেন, সেই ব্রহ্মকে জাগরিত করাই প্রকৃত শিক্ষার উদ্দেশ্য।” এরিস্টটল বলেছেন,‘‘ ঊফঁপধঃরড়হ রং ঃযব পৎবধঃরড়হ ড়ভ ংড়ঁহফ সরহফ রহ ধ ংড়ঁহফ নড়ফু ’’ অর্থাৎ সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করার নাম-ই শিক্ষা। তবে শিক্ষা সম্পর্কে সকল ধর্ম ও মনীষীর উক্তি এক জায়গায় স্থিতিশীল তা হলো- শিক্ষা মানবের মুক্তি নিশ্চিত করে। শিক্ষার সাথে ধর্মের আবশ্যকতা উপলব্ধি করে একজন মনীষী বলেছেন, “তুমি যদি তোমার সন্তানকে তিনটি বিষয়- পড়া, লেখা ও গণিত শিক্ষা দাও, চতুর্থ ধর্মকে বাদ দিয়ে, তাহলে তুমি পঞ্চম যে বিষয়টি পাবে তা হলো- লাম্পট্য।” মানব জাতির আত্মরক্ষা, আত্মপ্রতিষ্ঠা ও বিকাশ সাধনের জন্য বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ লগ্নে ভদ্রতার খোলসে বিভ্রান্ত জাতি মানবিক গুণাগুণ থেকে বিচ্যুত হয়ে নির্লজ ব্যভিচার, হানাহানি, শক্তিমত্তা প্রদর্শন ও পাশবিক আচরণে লিপ্ত হয়ে পৃথিবীকে নরকে পরিণত করছে। এর কারন হিসেবে বলা যায়- শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় শৃঙ্খলা ও অনুশীলনের অভাব। মানবসভ্যতা ও সৃষ্টির রয়েছে বিস্তৃত ইতিহাস। সৃষ্টিতত্ত্ব অনুসন্ধানের নির্দেশনাও রয়েছে কোরআন শরীফে। সুরা ‘আতত্বারিক’ এ আল্লাহ তায়ালা বলেন, “মানুষের লক্ষ করা উচিত তাকে কী দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে, তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে স্ববেগে স্থলিত নীর বিন্দু হতে। যা নির্গত হয় পুরুষের মেরুদন্ড ও নারীর পঞ্জরাশি হতে।” সৃষ্টির প্রথম মানুষ হযরত আদম (আঃ) তারপর তাঁর স্ত্রী হযরত হাওয়া (আঃ)। বাইবেলে তাঁদের নাম এডাম ও ইভ। প্রথম শিক্ষক স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা এবং প্রথম ছাত্র হযরত আদম (আঃ)। প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান ও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বেহেশতে। প্রতিযোগী ছিল হযরত আদম (আঃ) ও ফেরেশতাগণ। মহান আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর অনেক আবিষ্কার ও তাঁর সৃষ্টির নমুনা ফেরেশতাদের সামনে হাজির করে বললেন, এগুলোর নাম বলে দাও। ফেরেশতাগণ নিজেদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে বললেন, “আমরা আল্লাহর পবিত্রতা বর্ননা করছি, এ ব্যাপারে আমাদের কোন জ্ঞান নেই। আমরা কেবল তা-ই জানি যা আপনি আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন।” এবার আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আ) কে বললেন, এগুলোর নাম বলে দাও। হযরত আদম (আঃ) সব কিছুর নাম বিস্তারিত বলতে লাগলেন। আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের বললেন, তোমরা আদম কে সিজদা কর। ফেরেশতারা তা করল। কেবল ইবলিশ ব্যতীত। ফলে সে অকৃতজ্ঞ শয়তান হয়ে গেল। আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় সৃষ্টি মানবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করলেন। (সুরা বাকারা) প্রাচীনকালে মানুষ লিখতে পড়তে জানতো না, গাছের বাঁকল আর পাতা দিয়ে দেহ আবৃত করতো। কাঁচা মাংস ছিল যাদের খাবার। যারা পাথরে ঘর্ষণ করে আগুন জ্বালাতো। স্বামীর মৃত্যুর পর যারা নববধূকেও জ্বলন্ত চিতায় আরোহণ করাতো। সে মানুষগুলো কালের পরিক্রমায় পড়তে লিখতে শিখেছে। সভ্যতার ছোঁয়া লেগেছে তাদের দেহমনে। নানা রকম উন্নত পোশাকে সজ্জিত হয়ে পরিণত হয়েছে স্বর্গীয় মানুষে। যারা একসময় গ্রহ-নক্ষত্র, গাছ, পাথরকে মাথা ঠুকে কুর্ণিশ করেছে, আজ তারাই গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছুটে বেড়াচ্ছে। জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানের বিকাশের সঙ্গে জড়িত আত্মোন্নতি, আত্মোপলব্ধি, জাতীয় অগ্রগতিসহ ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তি। আমাদের শিক্ষিত হতে হবে আত্মপ্রতিষ্ঠিত হতে, নিজেকে জানতে। সক্রেটিস বলেছেন, “নিজেকে জানো।” একজন মুসলিম দার্শনিক বলেছেন, “যে নিজেকে চিনেছে, সে তার প্রভুকে চিনেছে।” লালন বলেন, “একবার আপনারে চিনতে পারলে পরে যায় অচেনারে চেনা।”

উত্তর দিচ্ছেন : মুহাম্মদ জাকারিয়া, প্রভাষক (বাংলা)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন