শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এত বিলম্ব কেন?

ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক | প্রকাশের সময় : ২৫ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০২ এএম

সা¤প্রতিক সময়ে নানা কৌশল অবলম্বন করে বাংলাদেশকে যুদ্ধের ফাঁদে ফেলে আরাকানে বসবাসকারী বাকি ছয় লাখ রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশের সীমানায় ঠেলে দেওয়ার লক্ষ্যে আপ্রাণ চেষ্টা হয়েছে। কয়েকমাস ধরে বান্দরবানের তুমব্রæ সীমান্ত সংলগ্ন রাখাইনে উত্তেজনা তারই প্রমাণ বহন করে। বাংলাদেশের ভেতরে মর্টার শেল পড়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিহত ও আহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে মায়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত অং মিন্টকে চতুর্থবার তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তিন দেশের সংযোগস্থলে উত্তপ্ত অবস্থা ভূরাজনৈতিক ক্রীড়নকদের পূর্বপরিকল্পিত কিনা তা নিয়ে অনেকের মনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

সময়ের পরিক্রমায় এটা স্পষ্ট হয়েছে, রোহিঙ্গা সংকট শুধুমাত্র জাতিগত নির্মূল অভিযানই নয়, বরং এর পেছনে অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক বৃহৎ স্বার্থ জড়িত রয়েছে। বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী রাষ্ট্রগুলো পরাশক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক দাবার অন্যতম ঘুটি। এতে চীন, ভারত ও রাশিয়ার পাশাপাশি পশ্চিমাদের কৌশলগত স্বার্থও নিহিত। বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপক‚লীয় এলাকায় হাইড্রোকার্বনের বিপুল রিজার্ভের দিকেই নাকি পরাশক্তিগুলোর কুদৃষ্টি। সেই জন্যই পর্দার অন্তরালে আঞ্চলিক সংঘাতে পৃষ্ঠপোষকতা করে স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মূল্যবান জ্বালানি সম্পদ কুক্ষিগত করাই নাকি তাদের মূল টার্গেট।
পরাশক্তিগুলোর অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থসহ অভ্যন্তরীণ ও বহিঃদেশীয় বহুমাত্রিক কারণে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কা দৃশ্যমান। অনেকের মতে, বড় বড় ভূরাজনৈতিক ক্রীড়নকদের মাধ্যমেই নাকি রোহিঙ্গা পরিস্থিতি আরও উসকে দেওয়া হচ্ছে। হয়তো এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করতে শতাব্দি ধরে চলা সংঘাতকে ব্যবহার করতে চাচ্ছে ভূরাজনৈতিক খেলোয়াড়রা। সা¤প্রতিক সময়ে সমগ্র মায়ানমারে গৃহযুদ্ধ চলমান থাকায় হতাহতের পরিমাণ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। বিভিন্ন সময় আরাকানে জাতিগত নিধনের শিকার প্রায় ১২ লক্ষ শরণার্থীর সাথে প্রতি বছর যুক্ত হচ্ছে নব্যভূমিষ্ট প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু। মানবিক দিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও ভয়াবহ সহিংসতার পাঁচ বছর এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে ঐতিহাসিক মামলার পরও ভূরাজনৈতিক কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।

প্রকৃতপক্ষে আরাকান ও কক্সবাজার অঞ্চলে ২০০৪ সালে গভীর সমুদ্রে প্রায় ২০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই এই অঞ্চলে পরাশক্তিগুলোর কুনজর পড়তে শুরু করে। ইতোমধ্যে মিয়ানমারে চীন গ্যাসের পাইপলাইন স্থাপন করে সেই গ্যাস চীনের কুনমিংয়ে নিচ্ছে। উপরন্তু চীন রাখাইন রাজ্যের কাইয়াকুক পিউইয়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে, যা ভারতের বিরোধিতায় কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি ভারত নিজেও এ অঞ্চলে বড় ধরনের বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে। সুতরাং রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীন ও ভারত প্রতিবেশী মায়ানমারের পাশে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। চীন, ভারত ও রাশিয়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ভোট দানে বিরত থেকে তারই প্রমাণ দিয়েছে। এদিকে পশ্চিমা শক্তিগুলো শতবছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরে একটি নৌঘাঁটি নির্মাণের জন্য। তাই, এ ক্ষেত্রে মুখে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলে গলাবাজি করলেও ভূরাজনৈতিক স্বার্থের জন্য পশ্চিমারা কি রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রæত সমাধান করবে নাকি এর থেকে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন?

মানবতার খাতিরে বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। এতে বিশ্বে প্রশংসিত হলেও এর নেতিবাচক দিক বহুমাত্রিক। সিরিয়া ও ইরাকের কিছু অংশ নিয়ে তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট’ এর মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলো অনিয়ন্ত্রিত রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে আরাকানসহ বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারতের সীমান্তবর্তী একাধিক জেলাকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। ইতোমধ্যে মার্কিন গোপন দলিলে ইসরাইলের মাধ্যমে তথাকথিত ‘রোহিঙ্গা ল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠার খবরও গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই এখন থেকেই খুব সাবধানে ভূরাজনৈতিক বিভিন্ন ফ্যাক্টর বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশকে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে এগুতে হবে।

দ্রæত মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের পরিসমাপ্তি না ঘটলে তা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কুটিলতা, ছলনা ও ক‚টবুদ্ধি নিয়ে চলা নেইপিদো কথা দিয়ে কথা না রাখার নজির সৃষ্টি করেছে। তাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক, অধ্যাপক, সাংবাদিক, সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে রোহিঙ্গা সংকট উত্তরণে আলাদা বিশেষজ্ঞ ইউনিট গঠনের মাধ্যমে ঢাকাকে প্রমাণ করতে হবে, মানবিকতার মতো রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ক‚টনীতিতেও সে সফল।

ভূরাজনীতির অপকৌশলের ঘৃণ্য আবরণে তথাকথিত প্রতিশ্রæতিতে আশ্বস্ত না হয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ক‚টনৈতিক ও বহুপক্ষীয় আলোচনার পাশাপাশি জাতিসংঘসহ বহির্বিশ্বে নানামুখী ক‚টনৈতিক প্রজ্ঞা ও মেধার সমন্বিত চেষ্টায় এই সঙ্কটের ইতি টানা সম্ভব।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন