বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এক জরিপে দেখা গেছে, শীর্ষস্থানীয় ৭০ শতাংশ অর্থনীতিবিদই মনে করছেন, ২০২৩ সালে দেখা দেবে বিশ্বমন্দা। অন্যদিকে জাতিসংঘ বলছে, একটু সতর্কতা অবলম্বন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এই সংকট এড়ানো সম্ভব। মন্দা প্রতিরোধে যে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, বিশ্বনেতাদের পক্ষ থেকে তা গ্রহণের কোনো লক্ষণ আপাতত পরিলক্ষিত হচ্ছে না; বরং যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ, ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়ন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থনীতির যে প্রথাগত তাত্ত্বিক নীতিমালা (নীতি সুদহার) গ্রহণ করেছে, তা অনেকের মতে, মন্দাকে আরও ত্বরান্বিত করবে। আমাদের অর্থনীতির ওপর নানামুখী চাপ করোনার আগে থেকেই। অসহনীয় মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি, রেমিট্যান্সের ক্রমাবনতির ফলে ডলার সংকটে ২০২১ সালের আগস্ট মাস থেকে হু হু করে কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান শিগগিরই হবে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এমনিতেই বেসরকারি বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৪ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে বহুদিন ধরে। এটা মোটেও সন্তোষজনক নয়। এর মধ্যেই বাংলাদেশের জাতীয় আয় প্রায় দুই দশক ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ৫-৭ শতাংশ হারে বেড়েছে। সরকারি বিনিয়োগ-জিডিপির অনুপাত বেড়ে ৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অর্থনীতির প্রতিটি সূচকই যেখানে নড়বড়ে, সেখানে দেশ উন্নয়নের তথাকথিত মূল নির্ণায়ক জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বরাবরের মতো দেখা যায় একই গতি। এমনকি বৈশ্বিক এই মহাবিপর্যয়ের মধ্যেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশাবাদী বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬ দশমিক ১ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার গড় প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৮ শতাংশের বেশি। প্রশ্ন হলো, এই প্রবৃদ্ধি কতটুকু অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সাধারণ জনগণের জন্য অর্থবহ। তা বিশ্লেষণে এক বৈষম্যপূর্ণ বিষাদের চিত্র ফুটে ওঠে। যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেশের জনগণের জীবনমানের নিশ্চয়তা দিতে পারে না, তা বাড়ুক অথবা সংকুচিত হোক, এ নিয়ে সাধারণ জনগণের কোনো ভাবনা নেই। তবে একশ্রেণির মানুষের এই খোঁজ রাখতে হয়। আর এই শ্রেণি হলো শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারী শ্রেণি। একটি দেশের সামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক গতিবিধি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জনগণের অর্থনৈতিক জ্ঞান ও সরকারি নীতিমালা শেয়ারবাজারকে প্রভাবিত করে, এটিই যৌক্তিক। কিন্তু শেয়ারবাজার সর্বদা যৌক্তিকভাবে চলে না। স্বল্পমেয়াদে শেয়ারবাজারে সবসময়ই কিছু গরমিল থাকে। দীর্ঘমেয়াদে শেয়ারবাজার ও অর্থনীতি বেশিরভাগ সময়েই সমান্তরালে চলে। ভালো অর্থনৈতিক অবস্থা কোম্পানিগুলোকে ভালো বাণিজ্যের সুবিধা করে দেয়। ফলে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি আসে। মোট দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। আর দেশে যখন জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঊর্র্ধ্বমুখী হয়, তখন স্বভাবতই শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা উল্লসিত হন এবং শেয়ারদর বৃদ্ধির আশায় আরও বেশি বিনিয়োগ করতে আরম্ভ করেন। ফলে শেয়ারবাজার গতিশীল থাকে।
একটি দেশের শেয়ারবাজার কতটা চাঙা, কতটা যৌক্তিক পর্যায়ে অবস্থান করছে বা বিনিয়োগকারীর আর্থিক জ্ঞান, তা জিডিপি টু শেয়ারবাজার রেশিও দেখলেই বুঝা যায়। সাধারণত উন্নত দেশে এই অনুপাত ১০০ শতাংশেরও ওপর বা এর আশপাশে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে এই অনুপাত ১২৫-১৫০ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। আর উন্নয়নশীল দেশে ৫০-৮০ শতাংশের মধ্যে থাকে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশে এই অনুপাত কাক্সিক্ষত পর্যায় নয়। ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত এই অনুপাত ছিল ২-৬ শতাংশের মধ্যে। আর ২০০৭ সালে এটি প্রথম ১০ শতাংশের উপরে ওঠে। ২০১০ সালে এই অনুপাত ছিল শেয়ারবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪০-৫০ শতাংশ। অথচ, ২০০৯ সালের জুনে এই অনুপাত ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ। সেখান থেকে এক বছরের মাথায় শেয়ারবাজারে মূলধন বেড়ে হয় কয়েকগুণ। ফলে শেয়ারবাজারে ধস ছিল এক প্রকার অবধারিত। ২০১০ সালের ধস-উত্তর বাজার মূলধন টু জিডিপি রেশিও ধীরে ধীরে কমতে থাকে, যা ২০১৬ সালে ২০ শতাংশ থেকে ক্রমন্বয়ে কমে এ বছরের জুলাই মাসে ছিল ১২ শতাংশের নিচে। অথচ, ২০১০ সাল থেকে জিডিপির আকার বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ছয়গুণ। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং শেয়ারবাজার উন্নয়নের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কখনই উপেক্ষনীয় নয়। প্রকৃতপক্ষে শেয়ারবাজারÑ শেয়ার, ডিভেঞ্চার, বন্ড, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, ট্রেজারি বিল ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের প্ল্যাটফর্ম প্রদানের মাধ্যমে দেশের শিল্পোন্নয়নে অর্থায়নের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে। কিন্তু কখনই আমরা সেভাবে শেয়ারবাজারকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ভূমিকায় বা চালিকাশক্তিতে পরিণত করতে পারিনি। যেখানে শেয়ারবাজার শিল্পোন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদে অর্থ সংস্থানের একমাত্র উৎস হওয়ার কথা, সেখানে আমাদের দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা এখনো ব্যাংক খাতনির্ভর। এই বৈপরীত্য অর্থ সংস্থানের মূল উৎস মুদ্রাবাজার ও পুঁজিবাজার, দুটোকেই ধ্বংস করছে। শেয়ারবাজরকে দেশের জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিগত বছরে যে মৌলিক গুণগত পরিবর্তনগুলো হয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল নতুন করে ৫৪টি ট্রেক হোল্ডার হস্তান্তর, যা দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। ফলে নতুন নতুন অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন এবং বাজারের গভীরতা বাড়বে, এমনটাই সবার প্রত্যাশা। কিন্তু সিডিবিএলের তথ্য বলছে, ৩ নভেম্বর আমাদের বাজারে বিও হিসাব সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৪৮ হাজার ৯৮২টি, যা আমাদের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশের কিছু বেশি। এটি মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। অথচ, উন্নত দেশগুলোতে তাদের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ শেয়ারবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যুক্তরাষ্ট্রের ৫৮ শতাংশ নাগরিক শেয়ারবাজারে ব্যবসা করেন। ফলে উন্নত দেশে শেয়ারবাজারের মূলধন সব সময় জিডিপির আশপাশে থাকে বা কোথাও বেশি থাকে। এটি তাদের দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির উপর বিনিয়োগকারীদের এক প্রকার আস্থার বহিঃপ্রকাশ। আমাদের দেশের জনগণ অর্থনীতির এই উল্লম্ফনের মধ্যেও শেয়ারবাজারকে কখনো আস্থায় নিতে পারেনি। যেখানে উচ্চমূল্যস্ফীতি ব্যাংকের আমানতের সুদ খেয়ে ফেলছে, তারপরও বছর বছর ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১৪ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি মহোৎসবে বেড়ে চলছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চÑ ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে অনেকের মতে, এই পরিমাণ আরও বেশিÑ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠনসহ নানান ছাড়ের কারণে খেলাপি ঋণ কম দেখাচ্ছে। প্রকৃত ঋণ হিসাব করলে নাকি এটি ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
একটি দেশের মোট ব্যাংকিং আমানতের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি টাকা যদি খেলাপি হয়, তা হলে আর্থিক খাত তথা অর্থনীতির অবস্থা কতটা নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এর মূল কারণ হলোÑ আমাদের শিল্পোদ্যোক্তাদের অর্থ সংস্থানে অতিরিক্ত ব্যাংকনির্ভরতা। ব্যাংকের স্থায়ী আমানতের হিসাব সংখ্যা এখন ৪৮ লাখ। এর বিপরীতে শেয়ার আছেÑ এমন বিও হিসাব সংখ্যা মাত্র ১৪ লাখ। আবার আমাদের দেশে শিল্পোদ্যোক্তাদেরও অর্থায়নে শেয়ারবাজারকে উৎস হিসেবে নেওয়ার সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। শীর্ষ ৫০ ব্যবসায়ী গ্রুপের ১৫টিও শেয়ারবাজারে নেই। সাধারণ বিনিয়োগকারী বা ব্যবসায়ীশ্রেণিÑ কারও আস্থাতেই নেই শেয়ারবাজার। ভালো মৌলভিত্তি কোম্পানির শেয়ার ছেড়ে বাজারে গভীরতা বাড়াতে সরকারি কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা শোনা যায় বহুদিন থেকে। ২০০৫ সালের মাঝামাঝিতে বিএনপির আমলের অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান থেকে শুরু করে ২০১০ সালের ধসের আগে জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। কিন্তু গুটিকয়েক কোম্পানি ছাড়া কেউই বাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের মুখেও সম্প্রতি শোনা গেল হতাশার বাণী। অবশেষে আইন সংশোধন করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে তালিকাভুক্ত করা যায় কি না, সেটি নিয়ে সরকারকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। ১৭ বছর ধরে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বারবার সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানগুলো পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে তালিকাভুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থেকে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো কোম্পানি পরিচালনা করতেই তালিকাভুক্তিতে যত অনীহা। বেসরকারি খাতের বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীরও একই অবস্থা। এখানে তাদের পারিবারিক নেতৃত্বের আড়ালে কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব কাজ করছে। তাই-তো শেয়ারবাজারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে উপাদানÑ ভালো মৌলভিত্তি কোম্পানি, সেটিই আমাদের অপ্রতুল। জাঙ্ক বা মন্দ শেয়ার দিয়ে চলছে লেনদেন। মৌলভিত্তি শেয়ার বা কোনো কোনো দিনÑ মোট লেনদেনকৃত শেয়ারের তিন-চতুর্থাংশ পড়ে থাকে ফ্লোর প্রাইসে। এটাকে সুষ্ঠু স্বাভাবিক শেয়ারবাজার বলা যায় না। এভাবে শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা আশা করা বৃথা। শেয়ারবাজার গতিশীল করতে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে হবে, ভালো লভ্যাংশ নিশ্চিত করতে হবে, বিনিয়োগকারীর পুঁজির নিশ্চয়তা দিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সুশাসন নিশ্চিত করে শেয়ারবাজারকে শিল্পোদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীÑ উভয়েরই অর্থ সংস্থান এবং বিনিয়োগের আকর্ষণীয় জায়গায় পরিণত করতে হবে। তা হলে শেয়ারবাজার আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়নের সহযাত্রী হবে। সত্যি কথা বলতে কি, সুশাসন ঘাটতির মধ্যেই এগিয়ে চলছে দেশ। গত পাঁচ দশকে বিভিন্ন সরকারের সময় জবাবদিহির অভাব ছিল সীমাহীন। তবে এর মধ্যেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। আমাদের এই আর্থসামাজিক উন্নয়ন যদি টেকসই করতে হয়, তা হলে আর্থিক খাতের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক
monirulislammi888@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন