শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

‘ওরা এখনো অপেক্ষা করছে হারিয়ে যাওয়া স্বজনরা ফিরে আসবে’

আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস

হাসান-উজ- জামান | প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০৪ এএম

আজ ১০ ডিসেম্বর, বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। ১৯৪৮ সালের এই দিনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। দিবসটি সারাবিশ্বে পালিত হবে। বাংলাদেশেও দিবসটি পালিন হবে। কিন্তু মানবাধিকার দিবসে বিভিন্ন সময়ে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তির স্বজনরা কেমন আছেন? কিভাবে তারা দিবসটি পালন করবেন?

জানতে চাইলে গুম নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন মায়ের ডাক’এর সমন্বয়কারি আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, তাদের সংগঠনের হিসাব মতে, গত ১ দশকে দেশে গুমের শিকার হয়েছেন ৬১৯ জন। বিগত ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে র‌্যাব পরিচয়ে তার ভাই সুমনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই থেকে তিনি নিখোঁজ। ভাই জীবিত না মৃত তারা জানেন না। তার পরিবার দিবসটি উপলক্ষ্যে জীবিত অথবা মৃত্য ভাইয়ের সন্ধান চান।
দেশের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ২০২০ সালের ২৯ আগস্ট প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০০৭ থেকে ২০২০ সাল (২৫ আগস্ট) পর্যন্ত ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৭৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী গ্রেপ্তার দেখিয়েছে ৮৯ জনকে। ফেরত এসেছে ৫৭ জন। বাকিদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য গণমাধ্যমে পাওয়া যায়নি।
এইসব গুম কিংবা নিখোঁজের ব্যাপারে একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার কর্মী ও বিশিষ্টজনেরা। তারা বলছেন, গঠিত তদন্ত কমিশন গুমের মতো এই যে মানবতা বিরোধী অপরাধ, এসব অপরাধের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের চিহিৃত করা।
এদিকে এ পর্যন্ত যারা গুম হয়েছেন, তাদের বিষয়ে জাতিসংঘের তত্বাবধানে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন ভূক্তভোগীর পরিবারগুলো। তারা দ্রæত স্বজনদের কাছে তাদের প্রিয়জনদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান।
আদনান হোসেন। তখন সবেমাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছেন। তেজগাঁও বিজ্ঞান কলেজ থেকে পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন তার ভর্তির প্রস্তুতি। তার বাবা সিভিল এভিয়েশন স্কুলের অংকের শিক্ষক রুহুল আমিন চৌধুরীর অনেক স্বপ্ন মেধাবী ছেলেকে নিয়ে। গত ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গুম হন। ছেলেকে ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশায় রুহল অমিন চৌধুরী বলেন, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগের ঘটনা। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বরের রাত। পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুমিয়েছিলাম শাহীনবাগের ৬৪০ নম্বর বাড়িতে। হঠাৎ আইনশৃঙ্খলা বাহিনির পরিচয় দেয়া লোকগুলো আদনানের কাছ থেকে একটি তথ্যের জন্য তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। আমি নিজেই ছেলেকে তাদের হাতে তুলে দেই। আদনান কখন ফিরবে জানতে চাইলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনির পরিচয়ে আসা ব্যক্তিরা জানায়, তারা নিজেরাই ওকে বাসায় পৌঁছে দিবে। আমার ছেলে সেই যে গেলো আর ফিরে এলো না। কেউ ফিরিয়ে দিয়ে গেলোনা।
কাওসার হোসেন। ২৪-২৫ বছরের টকবগে যুবক। পেশায় ছিলেন গাড়ি চালক। নেত্রকোনার এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। থাকতেন শাহীনবাগের একটি টিনসেড ভাড়া বাড়িতে। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ওই বাড়ি থেকে রাতে আাইন-শৃঙ্খলা বাহিনির পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় কাওসারকে। আজো তার খোঁজ মেলেনি। কাওসারের স্ত্রী বলেন, ছেলের চিন্তা করতে করতে কাওসারের মা মারা গেলেন অকালেই। স্বামী একদিন ঠিকই ফিরে আসবে এমন প্রত্যাশায় কাওসারের স্ত্রী অন্যের সন্তানকে আরবি শিক্ষার বিনিময়ে সামান্য পয়সায় একমাত্র সন্তান মীমকে বুকে আগলে রেখে এখনো পথ চেয়ে আছেন।
সাজেদুল ইসলাম সুমন। ঢাকা মহানগর তৎকালীন ৩৮ নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার খালার বাড়ি থেকে নিখোঁজ হন সুমন।
সুমনের বোন আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, সেদিন রাত প্রায় সাড়ে আটটা। বসুন্ধরা থেকে আমার খালা ফোন করে জানায়, সেখান থেকে আমার ভাই সুমনসহ তার আরও পাঁচ বন্ধুকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সে সময় আমার খালার বাসার কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছিলো।
শাহীনবাগের ৫৫৩ নম্বর নিজ বাড়িতে সুমনের বড় আকারে একটি ছবি বাধাই করা রয়েছে। সেই ছবির দিকে তাকিয়েই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটান সুমনের মা হাজেরা খাতুন। সুমনের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে হাফসা ইসলাম রায়তা একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। ছোট মেয়ে আরওয়া ইসলামের বয়স ১০ বছর। বাবা নিখোঁজের সময় আরওয়ার বয়স ছিল ২ বছর। বাবার চেহারা তার মনে নেই। তবে ছবি দেখলে বলে এটা আমার বাবা। সুমন গুমের পর আশপাশের থানা, ডিবি অফিস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তার স্ত্রী-স্বজনরা। কিন্তু এখন পর্যন্ত সুমনের সন্ধান দিতে পারেননি কেউ। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় তবুও অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না। সুমন বেঁচে আছে কিনা মরে গেছে- এই সংবাদও তার পরিবারের কারও কাছে নেই। প্রতিদিন স্বজনরা অপেক্ষায় থাকে এই বুঝি ফিরে আসবে।
ইসমাইল হোসেন বাতেন : ২০১৯ সালের ১৯ জুন মিরপুর ১ নম্বর শাহআলী মাজার সংলগ্ন নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বাসায় ফিরছিলেন ইসমাইল হোসেন বাতেন। পথে আইন শৃঙ্খলা বাহিনির সদস্য পরিচয়ে তাকে তুলে নেয়া হয়। আজো তার খোঁজ মেলেনি। বাতেনের স্ত্রী নাসিমা আক্তার বলেন, স্বামী নিখোঁজের পরদিন আমরা সংবাদ সম্মেলন করেছি। সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর কাছে অনুরোধ করেছি, তাকে উদ্ধার করতে। নাসিমা বলেন, তার স্বামী জাসাস করতেন। তবে সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করতেন না। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, স্বামী নিখোঁজের দীর্ঘদিন পার হয়ে গেছে, আমি জানি না, আমি সদভা নাকি বিধবা। স্কুলে কাজ ও টিউশনি করে দুই সন্তান নিয়ে কোনভাবে বেঁচে আছেন নাছিমা।
মানবাধিকার সংগঠক ও আসকের নির্বাহী পরিচালক মো. ন‚র খান লিটন বলেন, গত ১০ বছরের রিপোর্টে আমরা দেখতে পাই, অনেক সময় গুম বেড়েছে, ক্রসফায়ার কমেছে। আবার ক্রসফায়ার বেড়েছে, গুম কমেছে। তিনি বলেন, এক কথায় বলা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশের মানবাধিকার অবস্থা বিভিষিকাময়। রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে বিশেষ তকমা লাগিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে। গুম করা হচ্ছে। জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। মায়ের ডাকের সমন্বয়ক আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, আমার ভাই সুমন গুম হবার পর র‌্যাব, পুলিশ, মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন কোথাও যেতে বাদ দেইনি। পরে সুমনের মতো এমন গুমের শিকার পরিবারগুলো নিয়ে একত্রিত হয়েছি‘মায়ের ডাক’ নামে ব্যানারে। গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলো একটা স্বাধীন নিরপেক্ষ, বিচারবিভাগীয় তদন্ত চায়। #

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন