প্রথমে খবরটি বিশ^াসই হচ্ছিল না। নিজের কাছেই নিজে প্রশ্ন করছিলাম, আমি কি ভুল পড়ছি? আবার ভালো করে দেখলাম। না, ভুল নয়। সঠিক খবরই পড়ছি। আর তারপরেই আমার যে মানসিক অবস্থা হলো সেটিকে একজন বিখ্যাত কথা সাহিত্যিকের ভাষায় বলা যায়, এ যেন আমার স্তম্ভিত চেতনার ওপর এক বিদ্যুৎ প্রহার। বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে কি পেছনে যাচ্ছে? না হলে একজন রাজবন্দিকে প্যারোলে বের করা হয় ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে কেন? সেই প্যারোলও সাধারণ কোনো প্যারোল নয়। ওই রাজবন্দির মায়ের আকস্মিক মৃত্যুর পর সেই মাকে দেখার এবং তার জানাজা পড়ার জন্য আসতে ডান্ডাবেড়ি পরানো। শুধু তাই নয়, ওই রাজবন্দি নিজেই তার আম্মার জানাজা পড়িয়েছেন। যখন তিনি জানাজা পড়ান তখনও তার হাতে ছিল হাতকড়া, আর পায়ে ছিল ডান্ডাবেড়ি। ওই রকম হাতকড়া এবং ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থাতেই তিনি জানাজা পড়ান। জানাজায় উপস্থিত মানুষ এবং তার আত্মীয়-স্বজনরা পুলিশকে অনুরোধ করেছিল, অন্তত উনি যখন জানাজা পড়াবেন তখন যেন তার হাতকড়া এবং ডান্ডাবেড়ি খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশ মানুষজনের কথাকে পাত্তাই দেয়নি। ৩ ঘণ্টার জন্য তাকে প্যারোলে বের করা হয়েছিল। এই ৩ ঘণ্টার সমগ্র সময় তিনি হাতকড়া এবং ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় ছিলেন। সেজন্যই শুরুতে প্রশ্ন করেছি, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
এই জানাজায় রয়েছে মুসলমানের গভীর ধর্মীয় অনুভূতি। সাথে রয়েছে গর্ভধারিনী মায়ের আকস্মিক মৃত্যুজনিত গভীর শোক। এসবের কি কোনোই মূল্য নাই সরকার তথা তাদের পুলিশ বাহিনীর কাছে? রাজবন্দি আলী আজমকে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ৯ জন পুলিশ। ওই ৯ জন পুলিশ এবং তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ কারা কর্তৃপক্ষের কারো যদি এমন বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটে তাহলে তারা টের পাবেন যে আলী আজমের সাথে কতখানি অমানবিক এবং হৃদয়হীন ব্যবহার করা হয়েছে। এই ব্যবহারে সারা দেশবাসী শুধু হতভম্ব ও ক্রুদ্ধই নন, রীতিমত বাক্যহারা। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহদীন মালিক বলেছেন, ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে মায়ের জানাজায় নিয়ে যাওয়া আমাদের মধ্যযুগে ফিরে যাওয়ার একটি বিভৎস উদাহরণ। এমনকি তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদও বলেছেন যে, জানাজার সময় আলী আজমের হাতকড়া এবং ডান্ডাবেড়ি খুলে দেওয়া উচিত ছিল। প্রশ্ন হলো, ‘উচিত ছিল’, এটুকু বলাই কি যথেষ্ট? যারা এই অমানুষিক এবং বিভৎস কাজটি করলো তাদের বিরুদ্ধে আর কি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না? উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গত ২৯ নভেম্বর বিএনপির কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আলী আজমের বিরুদ্ধে জনৈক ব্যক্তি বিষ্ফোরক দ্রব্য আইনের অধীনে একটি মামলা করে। ঐ মামলার সূত্র ধরে পুলিশ আলী আজমকে গ্রেফতার করে। মামলার বাদী হলেন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের অফিস সহকারী আব্দুল মান্নান শেখ। অভিযোগে বলা হয় যে, ২৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা হয়। এরপর আলী আজমের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয় এবং ২ ডিসেম্বর তাকে গ্রেফতার করা হয়।
এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই (জহিরুল ইসলাম) খান পান্না বলেন যে, এটি একটি গায়েবী মামলা। তিনি বলেন, আলী আজমকে ডান্ডাবেড়ি পরানো অবস্থায় জানাজায় আনা আমাদের সংবিধান, আইন এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরিপন্থী। ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় জানাজায় অংশগ্রণ করতে বাধ্য করায় আলী আজমের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী কোনো আসামী বা অভিযুক্ত ব্যক্তি, এমনকি দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির সঙ্গেও এমন আচরণ করার কোনো সুযোগ নাই। জেড আই খান পান্না বলেন, এর আগে আলী আজমের চেয়েও অনেক গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত আটক এবং দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর ক্ষেত্রেও হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি না পরানোর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। প্রয়োজন মনে করলে ৯ জনের জায়গায় আরো বেশি সংখ্যক পুলিশ পাঠানো যেত। যদি পালানোর প্রশ্ন ওঠে তাহলে ওই ৯ জনই কি পালানো আটকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না?
॥দুই॥
এ ব্যাপারে জেএসডির সভাপতি আ স ম আব্দুর রবের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। আব্দুর রব এবং দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেন, ক্ষমতার প্রচন্ড উন্মত্ততায় সরকার কার্যত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার হাতে হাতকড়া আর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে দিয়েছে। তারা আরো বলেন, এ ঘটনা বিরোধী রাজনীতির প্রতি কর্তৃত্ববাদী সরকারের চরম জিঘাংসার বহিঃপ্রকাশ। মনে হচ্ছে যে, সরকার এই ধরনের নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতাকে গৌরবজনক মনে করে। বেশকিছু তাবেদার দল সংগঠন ও ব্যক্তির স্তাবকতার মাধ্যমে সরকারের সমস্ত অন্যায্য, অমানবিক ও অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপকে অব্যাহত সমর্থন দিয়ে রাষ্ট্রটিকেই গভীর সংকটে ফেলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে একজন বুদ্ধিজীবী বলেছেন, এখন দেখছি, বাংলাদেশে নতুন নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টি হচ্ছে। সেই নতুন মূল্যবোধ অনুযায়ী মায়ের মৃত্যুতে সন্তানের কান্নাকেও ডান্ডাবেড়ি পরানো যায়। অশ্রু বিসর্জনকে পরানো যায় হাতকড়া। তিনি বলেছেন, এ কেমন দুর্ভাগা সন্তান, মায়ের জানাজা পড়াতে যাকে দাঁড়াতে হয় হাতে পায়ে শিকল নিয়ে? এইখানে রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ঐ কবিতার লাইন ক’টিতে বলা হয়েছে,
হে মোর দুর্ভাগা দেশ
যাদের করেছ অপমান
অপমানে হতে হবে
তাহাদের সবার সমান।
ঐ বুদ্ধিজীবী আফসোস করে বলেছেন, বাংলাদেশে এমন দৃশ্যও আমাদের দেখতে হলো? আপনি আসামী হতে পারেন, দণ্ডিতও হতে পারেন। কিন্তু আপনার শোকের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না। কিন্তু সব সম্ভবের দেশ এই বাংলাদেশ। ঐ বুদ্ধিজীবী বলেছেন, ‘রাষ্ট্র ও তার পুলিশ, যাকে আমরা কর্তৃপক্ষ বলে থাকি, তারা এমন পাষাণ কীভাবে হলো? মাতৃহারা সন্তানের জন্যও তাদের মনে কোনো রহম জাগল না? নাকি অভিযুক্ত ব্যক্তি বিএনপির কেউ হলে তাকে নিয়ে যা খুশি করা যায়?’
বলা হয়েছে, এটি একটি গায়েবী মামলা। আলী আজম কি ভয়ঙ্কর কোনো ব্যক্তি? তিনি কি কোনো দস্যু সরদার? সরকার কি জানে যে, এই বিভৎস দৃশ্য ছবিসহ সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় ফলাও করে ছাপা হওয়ায় সরকারের ভাবমূর্তির ওপর নিষ্ঠুরতার সিল মোহর বসে গেছে? কাকে দোষ দেবো? পুলিশ বলুন, কারাকর্তৃপক্ষ বলুন, আর সরকার বলুন, তারা কি আইন কানুনের কোনো খোঁজ-খবর রাখেন না? তারা কি জানেন না, এ সম্পর্কে ২০১৭ সালে উচ্চ আদালত কি রায় দিয়েছেন? ২০১৭ সালে উচ্চ আদালত এক রায়ে বিচারাধীন আসামীকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতের কাঠগড়ায় তোলার বিরুদ্ধে নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই নির্দেশে বলা হয়েছে, ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে কোনো আদালতের এজলাসে বিচারাধীন আসামীকে তোলা যাবে না। ঐ মামলায় ডান্ডাবেড়ি পরানোর জন্য কারা বিভাগের ডিআইজির ব্যাখ্যা দাবী করা হয়েছিল। ডিআইজি প্রিজন এই ঘটনার জন্য আদালতের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চান। আমাদের সংবিধানেও এমন আচরণের বিরুদ্ধে নীতিমালা রাখা হয়েছে। জেল কোডেও বিশেষ কিছু পরিস্থিতি ছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তি শুধু নয়, দণ্ডিত আসামির হাতে-পায়ে বেড়ি পরানোয় নিষেধ আছে।
॥তিন॥
সংবিধানের ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদটা কি আবার পড়ে দেখবেন? সেখানে বলা হয়েছে: কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না। আলী আজম কেন সংবিধানে দেওয়া এই সুরক্ষার দাবিদার হবেন না? বিএনপি করেন বলে? বিএনপি করেন বলেই এমন এক মামলার আসামি করা হয়েছে তাঁকে, স্বয়ং মামলাকারীই যে মামলাকে অস্বীকার করেছেন! প্রথম আলোর ২১ ডিসেম্বরের খবরে জানা যাচ্ছে, মামলার বাদী মামলা সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন। আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলার মামলা সম্পর্কে তিনি আরও বলেছেন, ‘আমি ছিলামও না, দেখিও নাই।’ তারপরও আলী আজমসহ ১১ জনকে স্বনামে এবং আরও ১৫০ জনকে আসামি করা হয় অজ্ঞাতনামা হিসেবে। মামলার মেরিট তাহলে কোথায়?
আলী আজমের ছোট ভাই আতাউর রহমান বলেন, ‘ভাই কারাগারে থাকায় এবং জামিন না হওয়ায় মা সাহেরা বেগম দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে গত রোববার বিকেলে মারা যান। মিথ্যা মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে পুলিশ ভাইকে গ্রেপ্তার করে। তিনি ঘটনার সময় ওই স্থানে ছিলেন না। রাজনৈতিক জীবনে ভাইয়ের এটাই প্রথম জেলে যাওয়া। জানাজার দিন সকাল সোয়া ১০টার দিকে পুলিশ ভাইকে বাড়িতে নিয়ে আসে। আলী ভাই মায়ের জানাজায় ইমামতি করেন। নামাজ শেষে অল্প সময়ের মধ্যে মরদেহ কবরস্থানে নেওয়া হয়। ভাইয়ের হাতকড়া ও পায়ের ডান্ডাবেড়ি খুলে দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিলাম পুলিশকে। পুলিশ আমাদের কথা রাখেনি। মাটি দেওয়া শেষ না হওয়ায় পরিবারের পক্ষ থেকে ভাইকে আরেকটু সময় থাকার এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ চাইলেও দেওয়া হয়নি। পানি খেতে চাইলেও তাকে সে সুযোগও দেয়নি পুলিশ।’
॥চার॥
প্রিয় পাঠক, লেখাটি হয়তো এখানেই শেষ হতো। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যায় অনলাইন সংবাদগুলোর ওপর চোখ বুলাচ্ছিলাম। শুক্রবার ছিল ২৪ ডিসেম্বর। ঢাকা ছাড়া মফস্বলে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচী হিসেবে বিএনপি এবং সমমনা দল ও জোটসমূহের গণমিছিলের কর্মসূচী। কিন্তু যেসব খবর পাওয়া গেল তাতে দেখতে পেলাম, রাজনীতির দিগন্তে অশুভ সংকেত। পঞ্চগড়ে বিএনপির মিছিলে পুলিশ শর্টগানের গুলি চালায়। ফলে একজন বিএনপি নেতা নিহত হন। এই নিয়ে ১০টি মিটিং এবং ২৪ তারিখের গণমিছিলে হামলায় মোট ১০ জন নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন। মাগুরায় পুলিশ বাধা দেওয়ায় বিএনপি মিছিল করতে পারেনি। একই অবস্থা মুন্সিগঞ্জেও হয়েছে। মুন্সিগঞ্জে পথসভাও করতে দেওয়া হয়নি। নোয়াখালীতে জামায়াতে ইসলামীর মিছিলে পুলিশের শর্টগানের গুলিবর্ষণ, আটক ১০ ব্যক্তি। নাটোরে জামায়াতের মিছিল শেষে ৮ ব্যক্তি আটক। খুলনায় পুলিশ ব্যারিকেড দেয়। ফলে কেউ মিছিল মিটিং কিছুই করতে পারেনি। অন্যান্য জেলা থেকেও একই ধরণের খবর আসছে।
শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ নিজেদেরকেই প্রশ্ন করছেন, এই সরকার চায় কি? কয়েক মাস আগে তারা নিজেরাই বলেছিলেন যে, মিছিল মিটিংয়ে কোনো বাধা দেওয়া হবে না। ওপরে যেসব ঘটনার উল্লেখ করলাম সেগুলো কি সেই বাধা না দেওয়ার নমুনা? এখনই যদি মিছিল মিটিংয়ের ওপর হামলা আসে তাহলে ইলেকশন যতই ঘনিয়ে আসবে ততই সরকারি ও দলীয় আক্রমণ সাঁড়াশী হবে। এর অবশ্যাম্ভাবি পরিণতি কী? স্পষ্ট পরিণতি হলো, গণতন্ত্রের নির্বাসন। দেশ কি সেই দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে? বিবেকবান মানুষেরা ভাবুন। ভাবুন, কোথায় চলেছি আমরা।
Email: journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন