বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে পরাশক্তিগুলোর গোপন অবস্থান এখন অনেকটা প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে কথা বলছে দীর্ঘদিন ধরে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের একতরফা-বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পশ্চিমা দেশগুলো নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে গ্রহণযোগ্য মধ্যবর্তী নির্বাচনের বিষয়েও কথা শোনা গেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রাজনৈতিক সমঝোতা হলে আরেকটি নির্বাচনের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবে তিনি কখনোই রাজনৈতিক ডিসপিউট নিরসনে সংলাপের উদ্যোগে সায় দেননি। এহেন বাস্তবতা সামনে রেখে দেশে আরেকটি জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে সংবিধানের দোহাই দিয়ে আগের মতোই নিজেদের অধীনে নির্বাচন করার জন্য অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পক্ষান্তরে বিএনপিসহ বড়-ছোট বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে একাত্ম-একাট্টা দেখা যাচ্ছে। অনেক প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে বিএনপির প্রতিটি বিভাগীয় সমাবেশ এবং ১০ ডিসেম্বরের ঢাকা মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শিত হয়েছে তা মূলত বিএনপি কর্মীদের দৃঢ়তা এবং সাধারণ জনগণের সরকারবিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। ঢাকা সমাবেশ থেকে বিএনপির ১০ দফা ঘোষণা এবং ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার রেডিসন হোটেলে সাংবাদিক সম্মেলন থেকে রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা ঘোষণাকে ক্ষমতাসীনদের বাইরে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সমর্থন করেছে। তবে বিএনপির ঢাকা সমাবেশ ঘিরে রাজপথে পুলিশের গুলি, পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়কে রণক্ষেত্রে পরিণত করা, কার্যালয় ভাঙচুর-তছনছ, মির্জা ফখরুল-আব্বাসের মতো শীর্ষ নেতাদের সাথে আলোচনার কথা বলে মধ্যরাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারের ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করলে এটাই বোঝা যায়, আগামী নির্বাচনের আগে বিএনপির সাথে সমঝোতার সদিচ্ছা এখনো সরকারের নেই। কিছু কিছু রাজনৈতিক দাবিকে দলীয় সঙ্কীর্ণতার মোড়কে আবদ্ধ করা যায় না। বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তেমনই একটি গণদাবি। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়া, নতুন প্রজন্মের কোটি কোটি ভোটার বিগত দুইটি নির্বাচনে নিজের ইচ্ছামতো ভোট দিতে না পারার বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তিন জোটের রূপরেখাসহ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী জোটের ১৭৩ দিন হরতাল পালনের ইতিহাস এই দাবিকে একটি অকাট্য সার্বজনীন দাবিতে পরিণত করেছে। দেশের কোনো রাজনৈতিক দল বা জোটের পক্ষে এই দাবি প্রত্যাখ্যানের কোনো যৌক্তিক, নৈতিক বা আদর্শিক ভিত্তি নেই। দেশি-বিদেশি চক্রান্তে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ওয়ান-ইলেভেন সরকারের অভ্যুদয় এবং পরবর্তী তিনটি জাতীয় নির্বাচনের গতি-প্রকৃতি, ফলাফল এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের শত্রুমিত্র ইতোমধ্যে অনেকটাই চিহ্নিত হয়ে গেছে। উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এরই মধ্যে একটি বড় মানবিক বিপর্যয়কর ঘটনা হচ্ছে, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের গণহত্যার শিকার দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ও মিয়ানমারের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের পরও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে ভারত-চীন-রাশিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলোর আচরণ এসব দেশের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। পক্ষান্তরে পশ্চিমা দেশগুলো মাঝে মধ্যে দরদ দেখালেও বাস্তবে প্রত্যাশিত ভূমিকায় দেখা যায়নি।
অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক সমস্যা ঘিরে পরাশক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক চালবাজি বিশ্বে বড় বড় স্থায়ী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সঙ্কট, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষের ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধোত্তরকালে দুই জার্মানি একীভূত হলেও দুই কোরিয়া এখনো সাপে-নেউলে অবস্থায় রয়েছে। ভিয়েতনামে এবং আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কার্যত পরাজিত হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। চীন-রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতার বর্তমান দৃষ্টান্ত হলো ইউক্রেন যুদ্ধ। রাশিয়ান সেনাবাহিনী এবং কিয়েভে জেলনস্কির বাহিনীর পাল্টাপাল্টি হামলা ও প্রতিরোধের মুখে ইউক্রেনের সমৃদ্ধ জনপদগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে, লাখ লাখ ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য হয়েছে। হাজার হাজার সাধারণ ইউক্রেনীয় ইতোমধ্যেই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। যত দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের কাছে জেলনস্কি সরকারের যুদ্ধখরচ ও সম্ভাব্য পুনর্গঠন ব্যয়ের চাহিদার সম্ভার বেড়েই চলেছে। মাত্র চার কোটি জনসংখ্যার ইউক্রেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে, তা দিয়ে পুরো আফ্রিকা মহাদেশের শত শত মিলিয়ন মানুষের ক্ষুধা-দারিদ্র্য নিরসন করা সম্ভব। এ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, ইউক্রেনে রাশিয়ার প্রতিপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর প্রক্সিযুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধে ইউক্রেনের শাসক এবং জনগণের স্বার্থ ও জয়-পরাজয়ের ফলাফল খুব সীমিত। যদিও আফগানিস্তান বা সিরিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের সাথে ইউক্রেনের তুলনা চলে না, তথাপি এটুকু সহজেই অনুমান করা যায়, পেরিফেরির যুদ্ধে পরাশক্তির দ্বন্দ্ব একটি যুদ্ধেই শেষ হয়ে যায় না। আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেই তালেবান ও আলকায়েদার প্রতিরোধ যুদ্ধে সহায়তার হাত বাড়িয়েছিল। আলকায়েদা গঠিত হয়েছিল মূলত সিআইএ এবং পাকিস্তানের আইএসআইএর যৌথ ভূমিকায়। সেই আলকায়েদা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বুমেরাং হয়েছিল অথবা সিআইএ-মোসাদের বিশেষ পরিকল্পনায় তাদের ইসলামোফোবিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। নাইন-ইলেভেনে সন্ত্রাসী বিমান হামলার ঘটনা বরাবরই বিতর্কিত, প্রশ্নবিদ্ধ ও অমীমাংসিত। এই ঘটনাকে পুঁজি করেই আলকায়েদার ওপর দায় চাপিয়ে কোনো তদন্ত বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনুমোদন ছাড়াই আফগানিস্তানে নজিরবিহীন সামরিক আগ্রাসন শুরু করেছিল প্রেসিডেন্ট বুশের পেন্টাগন প্রশাসন। সোভিয়েত বাহিনীকে বিতাড়িত করে আফগান তালেবানদের নতুন ইতিহাস সৃষ্টির সাথে সহায়ক শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মাত্র এক দশকের মধ্যেই আফগানিস্তান দখল করে নিতে একটুও দ্বিধান্বিত হয়নি। দুই দশক ধরে চলা আফগান যুদ্ধে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরাজিত হয়ে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে। নতুন রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আফগানিস্তানের তালেবানরা আগের চেয়ে শক্তিশালী হলেও আফগান জনগণকে এখনো ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে মানবিক বিপর্যয়ের সাথে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। মার্কিন বাজেট ও পশ্চিমা সামরিক সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে জেলেনস্কির বাহিনীর চরম পরাজয়ের মধ্য দিয়ে হয়তো এক সপ্তাহের মধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে। ইউক্রেন এমন একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে, পরাজয় ছাড়া সে যুদ্ধের কোনো পরিসমাপ্তি নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজেটের ওপর নির্ভর করে চলা যুদ্ধ সারাবিশ্বের অর্থনীতি, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
রাষ্ট্রসমূহের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নিয়ে পরাশক্তির দ্বন্দ্ব কোনো নতুন বিষয় নয়। তাদের রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে জনগণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও মানবিক অধিকারের দাবি খুব গৌণ বিষয়। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ভয়ঙ্কর যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর পর আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় অস্ত্রবিরতির মধ্যে থাকলেও পরাশক্তিগুলোর আপসহীন ভূমিকার কারণে ৭০ বছর ধরে দুই কোরিয়া মূলত যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং পশ্চিমাদের বাণিজ্যিক আনুকূল্যে দক্ষিণ কোরিয়া শিল্পোন্নত রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হলেও একানায়কতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভার এবং বেপরোয়া আচরণ এখন ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। পশ্চিমাদের বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উত্তর কোরিয়া বা ইরানের আত্মরক্ষা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে খর্ব করতে না পারলেও সেখানকার সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে দুরূহ করে তুলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের সামরিক-অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও সহায়তায় যুদ্ধ প্রলম্বিত করা যায় বটে, যুদ্ধের জয়পরাজয় নিশ্চিত করতে হলে ময়দানের একটি পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। প্রতিপক্ষকে হত্যার করার মধ্য দিয়ে কোনো পক্ষে বিজয় নিশ্চিত করার স্বীকৃতি বিশ্বসম্প্রদায় দিতে পারে না। শর্তহীন ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক-অর্থনৈতিক সহায়তা নিয়ে ৭০ বছরেও ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যুদ্ধ থামিয়ে বা স্তিমিত করে দিতে পারেনি ইসরাইল। ফ্যাসিবাদী জার্মান নেতা এডলফ হিটলারের ইহুদিবিদ্বেষী নীতি ও কথিত হলোকস্টের (ইহুদি নিধন) প্রোপাগান্ডা কাজে লাগিয়ে ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করার পর জায়নবাদ ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে কোনো ফারাক দেখা যাচ্ছে না। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে এখন হিটলারের চেয়েও ভয়ঙ্কর নাৎসী শাসকের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এ সপ্তাহে প্রকাশিত আল জাজিরার সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক-অধ্যাপক মারওয়ান বিশারার লেখা একটি নিবন্ধের শিরোনাম, ‘নেতানিয়াহু দ্য গডফাদার অব মডার্ন ইসরাইলি ফ্যাসিজম’। ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘন, হত্যা, ভূমিদস্যুতা ও বেপরোয়া বোমাবর্ষণ, টার্গেট কিলিংয়ের মতো ঘৃণ্য অপরাধের পাশাপাশি দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের দায়ে অভিযুক্ত নেতানিয়াহুকে পশ্চিমারা কোনো সমস্যা বলে মনে করে না। অন্যদিকে নিজ দেশের মানুষের অধিকারের প্রশ্নে আপসহীন ভূমিকার কারণে সাদ্দাম, গাদ্দাফি, মুরসির মতো নেতাদের করুণ মৃত্যুর শিকারে পরিণত হতে হয়েছে। একইভাবে মার্কিন প্রক্সিযুদ্ধের শিকার হলেও রাশিয়া-ইরানের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ এখনো টিকে আছেন। তবে সিরিয়ার জনগণ যে বিভীষিকাময় ট্রমা এবং ধ্বংসযজ্ঞের সম্মুখীন হয়েছে তা পুনর্গঠনের সহায়তায় পশ্চিমাদের কোনো আগ্রহ নেই।
বিশ্বরাজনীতির মোড়লেরা এখন পরস্পর ধ্বংস আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের খেলায় মেতে উঠেছে। সেখানে স্ট্র্যাটেজিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ দুর্বল দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক সঙ্কটকে পুঁজি করে পরস্পরবিরোধী পরাশক্তিগুলো দু’টি রাজনৈতিক পক্ষে বিভক্ত হয়ে রাজনৈতিক সংঘাত উস্কে দিয়ে জাতিকে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়ার রাজনৈতিক গৃহযুদ্ধের ফাঁদ পাতা হচ্ছে। সিরিয়া ও ইউক্রেনের পর বাংলাদেশকে ঘিরে এখন পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং রাশিয়া-চীনের নতুন খেলা শুরু হয়েছে। নন-ওয়েস্টার্ন কোনো দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের ভূমিকার পেছনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটা ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডা সক্রিয় থাকে। গত ৮ বছর ধরে বাংলাদেশ নিয়ে পশ্চিমাদের অবস্থানে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রশ্নে দেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতো ও আকাক্সক্ষার সাথে পশ্চিমাদের মতের প্রতিফলন ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এমন একটি বাস্তবতায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রশ্নে দীর্ঘদিনের নীরবতা ভেঙে হঠাৎ করেই রাশিয়ানদের মুখে পাল্টা বিপরীতমুখী কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। ঢাকায় বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ঢাকায় একজন মানবাধিকার অ্যাক্টিভিস্টের বাসায় সাক্ষাৎ করতে গেলে সেখানে সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতায় আরেকটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা জড়ো হলে তার নিরাপত্তা হুমকি দেখা দেয়। এরই প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়। সেই প্রতিক্রিয়ার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাশিয়ান দূতাবাসের পক্ষ থেকে মার্কিন ভূমিকাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে মন্তব্য করলে ইউক্রেনে রাশিয়ান হস্তক্ষেপ নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তোলা হয়। ঘটনাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইউরোপে ইউক্রেন নিয়ে রুশ-মার্কিন দ্বন্দ্ব দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের নাক গলানো বা হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করে না। ইতোমধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সে বিষয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। তবে কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দুই পরাশক্তি এবং সরকারের অবস্থানের ক্ষেত্রে দ্বিমুখিতার নীতি স্পষ্ট। সবাই যার যার স্বার্থেই নিজের সুবিধাজনক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নির্বাচনে ভারতীয় কূটনীতিকদের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের নজির এ দেশের মানুষ দেখেছে। সেটা সরকারের মদতেই হয়েছে। মূলত পশ্চিমাদের নীরবতার সুযোগে ভারতীয়দের একপাক্ষিক ভূমিকার কারণেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমঝোতা ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব হয়নি। এখন পরিবর্তিত বাস্তবতায় নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রশ্নে দেশের মানুষ দেশি-বিদেশি সব পক্ষকে ইতিবাচক ভূমিকায় দেখতে চায়।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা এখন রাশিয়া ও চায়নার সাথে সমঝোতা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ উন্নয়ন সহযোগীদের প্রত্যাশিত অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে চায় বলে বিরোধীরা মনে করছে। বাংলাদেশের জনগণ কোনো পরাশক্তির হস্তক্ষেপ যেমন কামনা করে না, একইভাবে দেশে গণতন্ত্রহীনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক লুটপাট, রাজনৈতিক মামলাবাজি, পুলিশের দলবাজি এবং একপাক্ষিক নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে মানুষ মুক্তি চায়। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি এবং মূল্যবোধের তোয়াক্কা না করে তাহলে বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ দেশি-বিদেশি যারাই সাধারণ জনগণের আকাক্সক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ভূমিকা রাখবে তাদেরই সমর্থন করবে। এর বাইরে স্বাধীনচেতা জনগণ কোনো পরাশক্তিকে পরোয়া করে না। মাত্র দুই দশকের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র ও অনগ্রসর আফগানিস্তান রাশিয়া ও মার্কিন সামরিক বাহিনীকে হটিয়ে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুই প্রতিপক্ষের সমর্থন ও আগ্রাসী ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশের সরকার, সকল রাজনৈতিক শক্তি ও জনগণকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কোনো রাজনৈতিক পক্ষের একগুঁয়েমি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে স্বাধীন বাংলাদেশ যদি আফগানিস্তান বা ইউক্রেনের মতো আঞ্চলিক আধিপত্যবাদ ও পরাশক্তির চেসবোর্ড হয়ে ওঠে, এ দেশের মানুষ তাদের কখনো ক্ষমা করবে না। কোনো পরাশক্তি নয়, জনণের ঐক্যই আমাদের জাতিরাষ্ট্রের মূল শক্তি।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন