নববর্ষ বা বলতে আমরা নতুন বছরের আগমন এবং নতুন বছরের আগমন উপলক্ষে আয়োজিত সকল প্রকার উৎসবকে বুঝি। আমাদের বাংলাদেশে সাধারণত তিনটি নববর্ষ আসে। বাঙালি হিসেবে বাংলা নববর্ষ যা নানান আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে পালিত হয়।আর দ্বিতীয় টি হলো আরবি নববর্ষ যা আরবি বছরের শুরুতে পালিত হয় আর সর্বশেষ ইংরেজি নববর্ষ যা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পালন করা হয়। সাধারণত সকল নববর্ষ বা নতুন বছর বারো মাস পরপর আসে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়া’লা ইরশাদ করেন। ‘নিশ্চয়ই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস বারোটি’। (সুরা তাওবা : ৩৬)।
বর্তমান আমাদের পৃথিবীতে যে ইংরেজি নববর্ষ চালু আছে সেটি ১৫৮২ সালে খ্রিস্টানদের ধর্মযাজক পোপ গ্রেগরির নামানুসারে যে ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করা হয় ওই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পহেলা জানুয়ারিকে পাকাপোক্তভাবে নববর্ষের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়। ধীরে ধীরে ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ পালন করা হচ্ছে। তবে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম জুলিয়াস সিজার ইংরেজি নববর্ষ উৎসবের প্রচলন করেন খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সাল। প্রাচীনকালে নববর্ষের প্রথম দিন মন্দ অভ্যাস ত্যাগ করে ভালো ও সুন্দর অভ্যাস অর্জনের প্রতিজ্ঞা করা হতো। তখন বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন তারিখে নববর্ষ পালন করা হতো।মেসোপটেমিয়ায় নববর্ষ শুরু হতো নতুন চাঁদের সঙ্গে।
মিসর, ফিনিসিয়া ও পারসিকদের নতুন বছর শুরু হতো ২১ সেপ্টেম্বর। ইরানে নববর্ষ শুরু হতো পুরনো বছরের শেষ বুধবার এবং উৎসব চলতে থাকে নতুন বছরের ১৩ তারিখ পর্যন্ত। প্রাচীন পারস্যের সম্রাট জমশিদ খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ সালে এই নববর্ষের প্রবর্তন করেছিলেন। ব্যাবিলনিয়ায় নববর্ষ শুরু হতো মহাবিষুবের দিনে ২০ মার্চ। অ্যাসিরিয়ায় শুরু হতো জলবিষুবের দিনে ২১ সেপ্টেম্বর। গ্রিকদের নববর্ষ শুরু হতো খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত ২১ ডিসেম্বর। রোমান প্রজাতন্ত্রের পঞ্জিকা অনুযায়ী নববর্ষ শুরু হতো ১ মার্চ এবং খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩ সালের পর ১ জানুয়ারি। মধ্যযুগে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে নববর্ষ শুরু হতো ২৫ মার্চ। এভাবেই বিভিন্ন দেশে চলতে থাকে নববর্ষের উৎসব।
নববর্ষ বা নতুন বছরের আগমন উপলক্ষে খ্রিস্টানদেরকে অনুসরণ করে ইংরেজি বছরের শেষ দিন নতুন বছরের শুরুতে ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ (১২টা ১ মিনিট) পালন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে বিভিন্ন আতশবাজি করা,নাচানাচি, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, সৌন্দর্যের প্রদর্শনী। অশ্লীলতা-নগ্নতার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে অনেকে। মুসলিমরা ইসলাম ধর্মের অনুসারী। মুসলমানদের আলাদা সংস্কৃতি আছে। তারা তাদের ধর্মের নির্দেশ অনুযায়ী তাদের জীবনের যাবতীয় কার্য সম্পাদন করবে।এর বাহিরে কোনোকিছু করা মানে আল্লাহ তায়া’লার অসন্তুষ্টি অর্জন করা। তাছাড়া একজন ঈমানদারের জন্য প্রতিটি দিন-রাত ই উৎসব ও আনন্দের। বছরে নির্দিষ্ট কোনো দিনে নেচে-গেয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে শুধুমাত্র একটি দিনকে পালন করতে হবে বিষয় টা এমন নয় বরং সবগুলো দিনই আমাদের জন্য মুল্যবান ও আনন্দের।
নববর্ষ বা নতুন বছর যখন আগমন করবে তখন একজন মুমিনের সর্বপ্রথম ও প্রধানতম কাজ হলো বিজাতীয় সংস্কৃতি বর্জন করা।নববর্ষ উপলক্ষে যেসব ইসলাম পরিপন্থী কার্যকলাপ ও অনুষ্ঠান উৎসব পালন করা হয় এগুলোর বিরুদ্ধে সচেতনতার সাথে সোচ্চার থাকা। স্বাভাবিকবাবে আমাদের দেশে ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে ইসলামের সাংঘর্ষিক ও শিরকের সাথে সম্পর্কযুক্ত সংগীত এবং বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠান করা হয়। বেহায়াপনা,অশ্লীলতা নগ্নতায়পূর্ণ অনুষ্ঠান করা হয় বাদ্য ও ঢোল বাজিয়ে। যেটা ইসলাম কোনোভাবেই সমর্থন করে না। সেই অনুষ্ঠান গুলো কোনো উপকারী না হওয়ায় সময় গুলো কেটে যায় অনর্থক বাজে কাজে।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ইংরেজি নববর্ষ-সংক্রান্ত পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণে যাবতীয় অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ কোনো মুমিনের জন্য বিজাতীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করা বা উদযাপন করা কোনোভাবেই জায়েজ নয়। মুমিনদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। আমাদেরকে বিজাতীয় সংস্কৃতি উদযাপন থেকে বিরত থাকতে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে সরাসরি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া (ইসলামি রীতিনীতি) অন্য কোনো ধর্মের অনুসরণ করবে কখনো তার সেই আমল গ্রহণ করা হবে না। আর পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’। (সূরা আল ইমরান : ৮৫)। হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিস শরীফে বলেছেন, ‘যে অন্য জাতির সঙ্গে আচার-আচরণে, কৃষ্টি-কালচারে সামঞ্জস্য গ্রহণ করবে সে তাদের দলভুক্ত বিবেচিত হবে। (সুনানে আবু দাউদ : ২৭৩২)।
নববর্ষ বা নতুন বছর আসা মানে জীবনের নির্ধারিত বেঁধে দেওয়া সময় থেকে একটি বছর চলে যাওয়া। আর জীবন থেকে এক বছর চলে যাওয়া মানে মৃত্যুর কাছাকাছি আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। নববর্ষের আগমনে একজন মুমিনের অনুভূতি কেমন হওয়া উচিৎ এটা জানা খুব ই জরুরি। প্রথমত তার অনুভূতি হবে যে দিনগুলো আমার শেষ হয়ে গেল, তা তো আমার জীবনেরই একটি মহামূল্যবান অংশ ছিলো। আমার জীবন থেকে একটি বছর চলে গিয়ে এটি আমার জীবনকে সংকীর্ণ করে দিয়ে গেলো। এটা আমার জন্য আনন্দের ব্যাপার তো নয় ই বরং এটা আমার জন্য বড় চিন্তার ব্যাপার। জীবনের হিসাব মিলানোর সময় চলে এসেছে।
তাই নতুন বছরের অন্যতম প্রধান কাজ হবে মৃত্যুর স্মরণ ও পুরোপুরিভাবে পরকালের প্রস্তুতি নেওয়া কারণ আমরা প্রতিদিন মৃত্যুর দিকে ধীরে ধীরে আগাচ্ছি।বছরের শেষ ও নতুন বছরের শুরুতেই মৃত্যুর প্রস্তুতি হিসেবে নিজের জীবনের হিসাব গোছানো। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় পাথেয় সংগ্রহ করা। যাতে করে আল্লাহ তায়া’লা আমাদের কাছ থেকে হিসাব নেওয়ার আগেই নিজেই যেন নিজের জীবনের হিসাব গুছিয়ে নিতে পারি।আর যদি এরুপ করা যায় তাহলে জীবনের পরবর্তী প্রতিটি ধাপে ভালো কিছু করা সম্ভব। মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) একবার মিম্বরে দাঁড়িয়ে তার খুতবায় এক ঐতিহাসিক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘হিসাব চাওয়ার আগে নিজের হিসাব করে নাও, তোমার কাজ পরিমাপ করার আগে নিজেই নিজের কাজের পরিমাপ করে নাও। (জামে তিরমিজি, ৪/৬৩৮)।
নতুন বছর যখন উপস্থিত হবে তখন একজন মুমিন তার মৃত্যুর প্রস্তুতি হিসেবে তার জীবন থেকে চলে যাওয়া বিগত জীবনের জন্য আত্মসমালোচনা করবে। জীবনে চলার পথে বিগত দিনে যে ভুল ও গোনাহ গুলো হয়েছে সেগুলোর জন্য মহান আল্লাহ তায়া’লার কাছে ক্ষমা চাওয়া। ভবিষ্যতে আর এমন গুনাহের পুনরাবৃত্তি হবে না বলে আল্লাহ তায়া’লার সাথে ওয়াদা বদ্ধ হওয়া। ভবিষ্যৎ অর্থাৎ নতুন করে ভালো আমল করার দৃঢ় সংকল্প করা। বিগত বছরে কি কি ভালো কাজ করার কথা ছিলো আর কি কি ভালো কাজ করা হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে নতুন বছরের জন্য সুন্দর একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করা। এবছর যেন আরো বেশি ভালোকাজ করতে পারে সেই লক্ষ্যে নিজের পরিকল্পনার মধ্যে তাহাজ্জুদ নামাজ এবং বিশেষ ইবাদত বন্দেগী সংযুক্ত করা।
নিজেদের মানবিক দুর্বলতার জন্য মহান আল্লাহ তায়া’লার কাছে রহমত কামনা করা এবং বেশি বেশি করে আল্লাহ তায়া’লার কাছে দোয়া করা। আল্লাহ তায়া’লার কাছে এই দোয়া করা যে, হে আল্লাহ! আমাদের আগত বছর যেন বিগত বছরের ন্যায় আমলের ক্ষেত্রে দুর্বল না হয় বরং আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি সময়,প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ ও পদচারণা যেন হয় একমাত্র তোমার সন্তুষ্টির জন্য। নিজে নিজে চিন্তা করা যে, আল্লাহ তায়া’লা আমাদের একটি মহৎ উদ্দেশ্য (তার ইবাদাত করার জন্য) দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন সে পথে কতটুকু অগ্রসর হতে পেরেছি? অথবা সে পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য আমার পরিকল্পনা ও চেষ্টা কতটুকু আর কতটুকু! সে পথে আমার প্রাপ্তি বা সফলতা কতটুকু?
একটা বিষয় আমাদেরকে ভালোভাবে বুঝতে হবে যে, নতুন বছরের সাথে মানুব জীবনের কল্যাণ বা অকল্যাণের নূন্যতম কোনো সম্পর্ক নেই। ইমামে আযম আবু হানিফা রহ:-এর দাদা তাঁর পিতাকে পারস্যের নওরোজের দিন (নববর্ষের দিন) আলী (রা.) এর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তার জন্য নববর্ষ বা নওরোজ উপলক্ষে কিছু হাদিয়াও পেশ করেছিলেন।তখন আলী (রা.) বললেন, ‘নওরোজুনা কুল্লা ইয়াওম’ মুমিনের প্রতিটি দিনই তো নববর্ষ। অর্থাৎ মুমিন প্রতিদিনই তার আমলের হিসাব-নিকাশ করবে এবং নতুন করে আখিরাতের পাথেয় সংগ্রহ করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন